বিশ্বজমিন
হারেৎজ পত্রিকার চোখে
ইরান যুদ্ধে ইসরাইলের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা
বার পেলেগ
(১৬ ঘন্টা আগে) ২৬ জুন ২০২৫, বৃহস্পতিবার, ১২:২১ অপরাহ্ন
সর্বশেষ আপডেট: ৩:০০ অপরাহ্ন

ইরানের বিরুদ্ধে ১২ দিনের অভূতপূর্ব সামরিক সাফল্যের মধ্যেও ইসরাইলের অভ্যন্তরে এক ভয়াবহ বাস্তবতা সামনে এসেছে। তাহলো অসংখ্য সাধারণ নাগরিক রয়ে গেছে সম্পূর্ণ সুরক্ষাহীন, পরিত্যক্ত, অরক্ষিত অবস্থায়। বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার আধুনিকায়ন এবং গোয়েন্দা সাফল্য যেখানে আন্তর্জাতিক প্রশংসা কুড়িয়েছে, সেখানে রাজধানী তেল আবিব থেকে শুরু করে হাইফা ও বাত ইয়ামের মতো শহরগুলোতে সাধারণ মানুষ বিপর্যস্ত অবস্থায় দিন কাটিছে।
তেল আবিবের এক ধনাঢ্য এলাকায় বাস করা এক নারী জানান, তার নিজস্ব আবাসিক শেল্টার অকার্যকর। কাঠের দরজার সেই ঘরটি ছিল ব্যবহার অনুপযোগী। প্রতিবার সাইরেন বাজলে তাকে বাড়ি থেকে দুই মিনিট দূরের প্রতিবেশীর বাড়িতে ছোট একটি টানেলের মতো শেল্টারে যেতে হতো, যা একমাত্র নিরাপদ আশ্রয় ছিল। বাত ইয়ামে অ্যারিয়েল নামের এক ব্যক্তি দেখান, তার ভবনের নিচে থাকা ‘শেল্টার’ আসলে একটি বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি রাখার কুঠুরি। অনেকেই পার্কিং গ্যারেজে রাত কাটিয়েছেন, যাতে হঠাৎ হামলার সময় নিরাপদে থাকতে পারেন। এমনকি দেশজুড়ে ৫২টি স্থানে ক্ষেপণাস্ত্র সরাসরি আঘাত হেনেছে। শুধু তেল আবিবেই পাঁচটি স্থানে সরাসরি ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত করেছে।
ইসরাইলি বাহিনী দীর্ঘদিনের পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় সুনির্দিষ্ট হামলা চালাতে সক্ষম হয়েছে। তবে নিজ দেশের জনগণের জন্য আশ্রয়স্থলগুলোর সংস্কার বা প্রস্তুতির কোনো উদ্যোগ ছিল না। যুদ্ধ শুরুর ৭ দিন পর সরকার মাত্র ১০০ মিলিয়ন শেকেল (প্রায় ৩০ মিলিয়ন ডলার) বরাদ্দ দেয় বিদ্যমান শেল্টার মেরামত ও চলমান শেল্টার স্থাপনের জন্য। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই সংকট নতুন নয়। ২০ মাসেরও বেশি সময় ধরে চলা গাজা যুদ্ধের মধ্যেও কেন্দ্রীয় অঞ্চলের বহু শেল্টার ছিল পরিত্যক্ত ও অকার্যকর। এমনকি অবৈধভাবে বসবাসরত বেদুইন গ্রামগুলোতে কোনো ধরনের মোবাইল শেল্টার ছিল না। যেখানে রাষ্ট্রীয় কাঠামো ব্যর্থ হয়েছে, সেখানেই এগিয়ে এসেছে সুশীল সমাজ। ব্রাদার্স অ্যান্ড সিস্টার্স ইন আর্মস এবং স্ট্যান্ডিং টুগেদার নামের সংগঠনগুলো সরকারি অবহেলার মাঝেও আশ্রয়কেন্দ্রগুলো পরিষ্কার ও রক্ষণাবেক্ষণে এগিয়ে আসে। ইসরাইলি সেনাবাহিনীর হোম ফ্রন্ট কমান্ড ইউনিটগুলো যেকোনো আঘাতস্থলে উদ্ধার অভিযানে সক্রিয় ছিল।
ইরানের দিক থেকে ছোড়া প্রায় ৫০০ ক্ষেপণাস্ত্র ও ১,০০০ ড্রোনে নিহত হয়েছেন অন্তত ২৯ জন। তার মধ্যে অনেকেই ছিলেন বিদেশি নাগরিক। বাত ইয়ামে এক ইউক্রেনীয় পরিবারের পাঁচ সদস্যসহ মোট ৯ জন নিহত হয়েছেন। হাইফা, বিয়ের শেভা, রামাত গ্যান, রিশন লেৎসিয়ন ও তামরার মতো শহরগুলোতেও ব্যাপক হতাহত ও ধ্বংসযজ্ঞ হয়েছে। সেনাবাহিনী বলছে, তারা অনেক বড় ক্ষয়ক্ষতির জন্য প্রস্তুত ছিল এবং ক্ষয়ক্ষতি হয়তো প্রত্যাশার চেয়ে কম হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে হাজার হাজার মানুষের ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়ে গেছে। প্রায় ১০০০০ ইসরাইলি শরণার্থী হয়ে পড়েছে। আর অগণিত মানুষ মানসিকভাবে বিধ্বস্ত হয়েছে।
সরকারি বিবৃতিতে যুদ্ধকে সম্পূর্ণ বিজয় হিসেবে আখ্যা দেওয়া হলেও বাস্তবতার সঙ্গে এর ফারাক স্পষ্ট। দীর্ঘদিন ধরে উপেক্ষিত নিরাপত্তাহীন মানুষগুলোর প্রতি দায়িত্ব এড়িয়ে গিয়ে এখন সেই নেতারাই সাধারণ মানুষের ধৈর্য ও সহ্যশক্তির প্রশংসা করছেন, যারা আগে তাদের আবেদন ও প্রতিবাদকে তাচ্ছিল্য করেছিলেন। বিশেষ করে, যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন অথচ আশ্রয়কেন্দ্রে পৌঁছাতে পারেননি, তাদের দোষারোপ করা হয়েছেÑ এই বাস্তবতা নিয়েও তীব্র সমালোচনা হয়েছে।
যুদ্ধ শেষ হলেও ৬২৭ দিনের গাজা সংঘর্ষ এখনো চলছে। এই সময়েও কেউ কেউ গাজাবাসীর কথা স্মরণ করেছেন। কেউ প্রতিবাদ করেছেন সামাজিক মাধ্যমে বা রাস্তায়। কিন্তু পুলিশি দমন-পীড়ন, একক প্রতিবাদকারীকে গ্রেপ্তার, নগ্ন তল্লাশি ইত্যাদির মাধ্যমে সরকার সমালোচনার কণ্ঠরোধ করেছে।
ইরানে ১২ দিনের যুদ্ধ ইসরাইলের সামরিক পরিকল্পনায় দক্ষতার প্রমাণ দিলেও, দেশের ভিতরে সাধারণ নাগরিকদের রক্ষা করতে সরকার ব্যর্থ হয়েছে। যুদ্ধের প্রস্তুতি ছিল, কিন্তু সাধারণ মানুষের জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে কার্যত কোনো দায়বদ্ধতা ছিল না। আগামী যেকোনো যুদ্ধের আগে যদি এই শিক্ষা থেকে সরকার না শিখে, তবে আরও অনেক জীবন বিপন্ন হবে।
(অনলাইন হারেৎজ পত্রিকা থেকে অনুবাদ)