ঢাকা, ২০ জুন ২০২৫, শুক্রবার, ৬ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ২২ জিলহজ্জ ১৪৪৬ হিঃ

বিশ্বজমিন

রাশিয়ার জন্য ভয়ঙ্কর ধাক্কা

মানবজমিন ডেস্ক
২০ জুন ২০২৫, শুক্রবার
mzamin

‘এক পরিবর্তনশীল বিশ্বে রুশ-ইরান সহযোগিতা’ শীর্ষক এক সম্মেলনের জন্য রাশিয়া ও ইরানের পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক কর্মকর্তারা যখন মস্কোতে মিলিত হলেন, তারা হয়তো ভাবেননি এই শিরোনামটি এতটা তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠবে। ক্রেমলিনের কাছাকাছি প্রেসিডেন্ট হোটেলে বুধবার এক গোলটেবিল বৈঠকে বসা কর্মকর্তারা এক কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হন। তাহলো মস্কোর ঘনিষ্ঠ মিত্র তেহরানের সরকার কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে গুরুতর হুমকির মুখে। ইসরাইল এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প যখন তেহরানের নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ দাবি করছেন, তখন মস্কো ইরানের ভবিষ্যৎ নিয়ে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। যদিও বাস্তবে এই পরিস্থিতিকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা যে সীমিত, তা তারা নীরবে স্বীকার করে নিচ্ছে। রাশিয়া-ইরান সম্পর্কের একজন স্বতন্ত্র বিশ্লেষক নিকিতা স্মাগিন বলেন, অনেকদিন ধরেই পরিষ্কার ছিল যে, রাশিয়া সামরিকভাবে ইরানকে রক্ষা করবে না। কারণ তারা ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ানোর ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত নয়। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, মস্কোর সতর্ক প্রতিক্রিয়া একটি শীতল রাজনৈতিক হিসাবের ফল-  ইউক্রেন যুদ্ধকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়া এবং একইসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রকে ইরান-বিষয়ক সরাসরি সামরিক হস্তক্ষেপ থেকে বিরত রাখতে চাওয়া। রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র জানায়, ক্রেমলিন ইরানকে অস্ত্র সরবরাহের কথা ভাবছে না, যুদ্ধে জড়ানো তো দূরের কথা। তারা স্পষ্টতই ট্রাম্পের সঙ্গে সংঘাতে যেতে চায় না, বরং যুক্তরাষ্ট্রকে কূটনীতির পথে ফেরাতে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। রাশিয়ার মূল লক্ষ্য হলো নতুন মার্কিন প্রশাসনের সঙ্গে গড়ে ওঠা সম্পর্ক নষ্ট না করা এবং ট্রাম্পের ইউক্রেন বিষয়ে অবস্থানে কোনো নেতিবাচক পরিবর্তন না আসা নিশ্চিত করা। তবে যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত ইসরাইলের একটি দীর্ঘস্থায়ী সামরিক অভিযান যদি ইরানের অর্থনীতি ও সেনা অবকাঠামো ধ্বংস করে দেয় এবং তেহরানের সরকার পতনের দিকে ঠেলে দেয়, তাহলে ক্রেমলিন নিজেই চরম ক্ষতির মুখে পড়বে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ঘনিষ্ঠ ওই সূত্রটি বলেন, বর্তমান ইরানি সরকারের যদি পতন হয়, তাহলে রাশিয়ার জন্য এটা কেবল কৌশলগত নয়, সম্মানজনক দিক থেকেও বড় ধরনের ধাক্কা হবে। তিনি আরও বলেন, এটা হবে দামেস্ক পতনের চেয়েও বড় ক্ষতি। তিনি বোঝাতে চাইছেন, সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের পতনের ফলে রাশিয়ার যে প্রভাব কমে গিয়েছিল, এই পরিস্থিতি তার চেয়েও বেশি ক্ষতিকর হতে পারে। 
রাশিয়ার নিঃশব্দ প্রতিক্রিয়া ও সীমিত প্রতিবাদ ইরানের সঙ্গে তাদের দৃঢ় সম্পর্কের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ মনে হতে পারে। বিশেষ করে ২০২২ সালে ইউক্রেন আক্রমণের পর থেকে যখন ইরান ও রাশিয়া উভয়ই পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়ে তখন তারা আরও ঘনিষ্ঠ হয়। ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর দিকে ইরান রাশিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হয়ে ওঠে- তারা মস্কোকে হাজার হাজার সামরিক ড্রোন সরবরাহ করে, যা ইউক্রেনীয় শহরে হামলায় ব্যবহৃত হয়। পরবর্তীতে ইরান রাশিয়ায় একটি ড্রোন কারখানা স্থাপনে কারিগরি সহায়তা ও প্রশিক্ষক পাঠায়, যা উরাল পর্বতমালার গভীরে স্থাপন করা হয়। এই সম্পর্ক গভীর হওয়ার ফলে জানুয়ারিতে ভ্লাদিমির পুতিন এবং ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসউদ পেজেশকিয়ান একটি বিস্তৃত ‘কৌশলগত অংশীদারিত্ব চুক্তি’ স্বাক্ষর করেন, যাতে সামরিক সহযোগিতা ও গোয়েন্দা তথ্য বিনিময়ের দিক তুলে ধরা হয়। তবে পর্যবেক্ষকরা বলেন, দুই দেশের সম্পর্ক সবসময়ই জটিল। এই সামরিক চুক্তিতে ‘পারস্পরিক প্রতিরক্ষা ধারা’ অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। এর মানে রাশিয়া আইনত ইরানকে কোনো সামরিক সহায়তা দিতে বাধ্য নয়। এ ছাড়াও ইরানের অনুরোধ সত্ত্বেও রাশিয়া তাদের চাওয়া বহু অস্ত্র-যেমন বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ও ফাইটার জেট- এখনো সরবরাহ করেনি। নিকিতা স্মাগিন বলেন, ইরান বিভিন্ন অস্ত্র ব্যবস্থার অনুরোধ করলেও এখনো পর্যন্ত রাশিয়া সেগুলোর কোনোটি সরবরাহ করেনি। এর কারণ আংশিকভাবে রাশিয়ার ইউক্রেনে জড়িয়ে থাকা এবং সৌদি আরবসহ অন্য আঞ্চলিক শক্তির সঙ্গে তাদের ক্রমবর্ধমান সম্পর্ক। এর ফলে এমনকি হিজবুল্লাহর ওপর বড় ধাক্কার পরেও, তেহরানের দুর্বল অবস্থান সত্ত্বেও মস্কোকে তেমন সক্রিয় দেখা যাচ্ছে না। এদিকে রাশিয়া এখন ইরান থেকে সামরিক সহায়তার ওপর নির্ভর করছে না। কারণ তারা ইতিমধ্যে নিজ দেশে ড্রোন উৎপাদনে দক্ষতা অর্জন করেছে। 
মস্কোর কিছু মহল এমনকি ইরানে ইসরাইলের হামলাকে ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখছে। কারণ, তেলের মূল্য ইতিমধ্যে চার মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ হয়েছে এবং তা আরও বাড়তে পারে- যা রাশিয়ার যুদ্ধকালীন অর্থনীতিতে বাড়তি আয়ের সুযোগ তৈরি করছে। আরেকটি সুবিধা হচ্ছে, এই সংঘাত ডনাল্ড ট্রাম্পের দৃষ্টি ইউক্রেন থেকে সরিয়ে নিয়েছে। তিনি সম্প্রতি জি-৭ সম্মেলন থেকে সফর সংক্ষিপ্ত করে চলে যান এবং ইউক্রেনীয় প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গে নির্ধারিত বৈঠক বাতিল করেন। রুশ প্রতিরক্ষা থিংক ট্যাংক ক্যাস্ট-এর পরিচালক রুসলান পুখভ বলেন, এই পরিস্থিতিতে ইউক্রেন সবচেয়ে বড় সামরিক ও রাজনৈতিক ক্ষতির মুখে পড়বে- ইরান বাদে, অবশ্যই। মধ্যপ্রাচ্যে নতুন যুদ্ধ বিশ্ব জুড়ে ইউক্রেন ইস্যু থেকে মনোযোগ সরিয়ে দেবে এবং যুক্তরাষ্ট্রের ফোকাস ইসরাইলকে সামরিক সহায়তায় নিয়ে আসবে। তবে এই স্বল্পমেয়াদি সুবিধাগুলোর বিপরীতে, দীর্ঘমেয়াদি চিত্র রাশিয়ার জন্য অনেক বেশি অনিশ্চিত ও বিপজ্জনক- বিশ্লেষক ও নীতিনির্ধারকদের এমনটাই মত। 
যদি তেহরানে সরকারের পতন ঘটে, তবে রাশিয়া তার একটি কৌশলগত মিত্রকে হারাবে, যার সঙ্গে গত কয়েক বছরে তারা রাজনীতি ও অর্থনীতিতে বিপুল বিনিয়োগ করেছে। গ্যাস, জ্বালানি ও অবকাঠামো প্রকল্পে রাশিয়া কয়েক বিলিয়ন ডলার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে- সবই অনিশ্চয়তায় পড়বে। বেলারুশের মতো মিত্রদের তুলনায়, ইরানের সঙ্গে রাশিয়ার ঐতিহাসিক বা সাংস্কৃতিক বন্ধন খুবই দুর্বল। এই সম্পর্কটি গড়ে উঠেছে মূলত পশ্চিম-বিরোধিতার ভিত্তিতে এবং নিষেধাজ্ঞার বাস্তবতা ভাগাভাগির অভিজ্ঞতায়। বার্লিনভিত্তিক রুশ পররাষ্ট্রনীতি বিশ্লেষক হান্না নোটে বলেন, যদি (ইরানের) এই শাসনব্যবস্থা পতিত হয়, তাহলে রাশিয়ার পক্ষে তাদের সম্পদ ও প্রভাব ধরে রাখা কঠিন হয়ে যাবে। তিনি আরও বলেন, মস্কোর জন্য সবচেয়ে ভয়াবহ দৃশ্যপট হবে- একটি মধ্যপ্রাচ্য, যেটি যুক্তরাষ্ট্রপন্থি শক্তির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত থাকবে। সেটাই হবে রাশিয়ার জন্য একটি ভয়ঙ্কর ধাক্কা।
(অনলাইন গার্ডিয়ান থেকে অনুবাদ) 
 

বিশ্বজমিন থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

বিশ্বজমিন সর্বাধিক পঠিত

ইরানের আকাশসীমা দখলের দাবি ইসরাইলের/ ‘আকাশে যুদ্ধবিমান দেখা যাবে, তেহরান জ্বলবে’

   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2025
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status