বিশ্বজমিন
কেউই বলছে না শেষটা কেমন হবে?
মানবজমিন ডেস্ক
১৯ জুন ২০২৫, বৃহস্পতিবার
একজন প্রেসিডেন্ট- ঘটনাপ্রবাহ, গণবিধ্বংসী অস্ত্র ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা এবং নিজের বক্তব্যের পেছনে দাঁড়ানোর চাপে, মধ্যপ্রাচ্যকে এমন এক যুদ্ধের দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে, যার সমাপ্তি অস্পষ্ট। ওয়াশিংটনে প্রত্যাশা বাড়ছে যে ডনাল্ড ট্রাম্প শিগগিরই ইসরাইলের আহ্বানে সাড়া দিয়ে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির বিরুদ্ধে একটি সুনির্দিষ্ট হামলার চেষ্টা করবেন। এমন ভূগর্ভস্থ-ধ্বংসকারী অস্ত্র ব্যবহার করবেন যা কেবলমাত্র যুক্তরাষ্ট্রই ব্যবহার করতে পারে। ইসরাইলের প্রথম হামলায় শীর্ষ সামরিক নেতা ও পরমাণু বিজ্ঞানীদের হত্যা এবং ইরানের আত্মরক্ষামূলক ক্ষমতা ধ্বংসের পর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ভাষা হঠাৎই আগ্রাসী হয়ে উঠেছে। সিএনএনের খবরে বলা হয়েছে, ট্রাম্প এখন ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে হামলার জন্য মার্কিন সামরিক শক্তি ব্যবহারের বিষয়ে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন এবং পূর্ববর্তী কূটনৈতিক প্রচেষ্টা থেকে বিরক্ত হয়ে সরে এসেছেন।
ট্রাম্প কী আসলেই যুদ্ধ চান, নাকি এটা চাপ সৃষ্টি করার কৌশল: সম্ভবত তিনি ইরানকে আবার কূটনীতিতে ফিরিয়ে আনতে চান, সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে যে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ তিনি চেয়েছেন, তার জন্য চাপ সৃষ্টি করছেন। কিন্তু এটা অবাস্তব স্বপ্ন বলেই মনে করছেন অনেকে। ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের ইরান প্রকল্পের পরিচালক আলী ভায়েজ বলেন, যতক্ষণ ট্রাম্প ইসরাইলের আগ্রাসনের সুবিধা নিতে চাচ্ছেন ইরানকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করতে, ততক্ষণ এটা কাজ করবে না। তারা একে দেখে একটি খাদের শেষ প্রান্তে নিয়ে যাওয়া- যেখানে সরকার পতন অনিবার্য। ইসরাইলের এই আগাম হামলার পেছনে যদি যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক প্রচেষ্টা ব্যাহত করার অভিপ্রায় থাকে, তাহলে ট্রাম্প কি ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুকে থামাতে পারবেন, যিনি রাশিয়ার পুতিন বা চীনের শি জিনপিং-এর মতোই ট্রাম্পের কথায় গুরুত্ব দিচ্ছেন না? নিজের বিরুদ্ধ মতাদর্শে যুদ্ধের দিকে ট্রাম্পের পদক্ষেপ: ট্রাম্প দীর্ঘদিন ধরে যে ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতির পক্ষে, যেখানে অন্য দেশের ঝামেলায় জড়ানো থেকে বিরত থাকা ছিল মূলমন্ত্র, সেখানে এখন তিনি নিজেই সেই ধরনের হস্তক্ষেপকারী নেতায় পরিণত হচ্ছেন, যাদের তিনি এক সময় ঘৃণা করতেন। তবে, ট্রাম্পের অবস্থানে একটি ফাঁক ছিল- ইরান যেন কখনো পারমাণবিক অস্ত্র না পায়। এ বিষয়ে তিনি সবসময়ই কঠোর ছিলেন।
একটি নতুন যুদ্ধ, তবে পরিকল্পনার অভাব: ট্রাম্প বর্তমানে চিন্তা করছেন ফর্ডো পারমাণবিক কেন্দ্রে হামলার জন্য ৩০ হাজার পাউন্ড ওজনের ম্যাসিভ অর্ডন্যান্স পেনিট্রেটর ব্যবহার করা হবে কিনা। এই কেন্দ্রটি পাহাড়ের নিচে কংক্রিটে ঘেরা। কিন্তু সবচেয়ে বড় যে বিষয়টির ঘাটতি রয়েছে, তা হলো- এই হামলার পর কী হবে তা নিয়ে কোনো স্পষ্ট সরকারি আলোচনার অনুপস্থিতি। ২১শ’ শতকের ইরাক ও আফগানিস্তানের যুদ্ধের অভিজ্ঞতা যেখানে যুক্তরাষ্ট্র ঢুকে আবার বের হতে দুই দশক লেগে গেছে, সেখানে নতুন আরেকটি যুদ্ধের আগে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা না বলা অদ্ভুত। সিনেটর ক্রিস মারফি সিএনএন’কে বলেন, যারা যুদ্ধের পক্ষে স্লোগান দিচ্ছেন, তারা খুব দ্রুত ভুলে গেছেন ইরাক ও আফগানিস্তান যুদ্ধের বিপর্যয়। এই যুদ্ধগুলো হাজার হাজার আমেরিকানকে প্রাণ হারাতে বাধ্য করেছে এবং নতুন জঙ্গিগোষ্ঠী তৈরি করেছে। পূর্বের যুদ্ধগুলো কী শিক্ষা দেয়: ২০০৩ সালে ইরাক আক্রমণের মাধ্যমে সাদ্দাম হোসেনকে সরিয়ে দেয়া হলেও, রাষ্ট্রীয় কাঠামো ভেঙে পড়ে এবং এক ভয়ঙ্কর বিদ্রোহ সৃষ্টি হয়। এরপর যুক্তরাষ্ট্রকে পিছিয়ে আসতে হয়।
আফগানিস্তানে তালেবানকে সরিয়ে দিয়েও, ২০ বছরের ‘নেশন বিল্ডিং’ ব্যর্থ হয়ে ২০২১ সালে আমেরিকাকে অপমানজনকভাবে সরে আসতে হয়। ২০১১ সালে লিবিয়ার গাদ্দাফিকে সরিয়ে দিলেও দেশটিতে অরাজকতা ও দারিদ্র্য এখনো বিরাজ করছে। ২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় তিনি জেব বুশকে প্রকাশ্যে আক্রমণ করেন ইরাক যুদ্ধের জন্য, বলেন- ইরাক যুদ্ধ ছিল একটি বড় ভুল। গত মাসেই তিনি সৌদি আরবে বলেন, যারা জাতি গঠন করতে গিয়েছিল, তারা আরও বেশি জাতি ধ্বংস করেছে। তবে ট্রাম্প নিজেই কি নিজের পুরনো কথার বিরোধিতা করছেন? ইরানের সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া: লিবিয়া, ইরাক বা আফগানিস্তান নয় ইরান। হয়তো এবার সত্যিই একটি সীমিত হামলায় ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি ধ্বংস করা সম্ভব। কিন্তু ইরানের ধর্মীয় সরকার নিশ্চয়ই প্রতিশোধ নেবে- হয়তো মার্কিন ঘাঁটি বা সেনাদের ওপর হামলার মাধ্যমে। এই পরিস্থিতিতে যুদ্ধের পালে হাওয়া লাগবে এবং এর শেষ কোথায় তা কেউ জানে না। ইরান হয়তো হরমুজ প্রণালি বন্ধ করে দিয়ে বৈশ্বিক জ্বালানি সংকট সৃষ্টি করবে, অথবা সৌদি আরবের তেলক্ষেত্র লক্ষ্য করে হামলা চালাবে।
এমন পরিস্থিতিতে নেতৃত্ব দেয়ার একমাত্র শক্তি হবে যুক্তরাষ্ট্র- অর্থাৎ আরও গভীরভাবে মধ্যপ্রাচ্য যুদ্ধের মধ্যে জড়িয়ে পড়া। ইরান হয়তো বড় ধরনের সাইবার হামলাও চালাতে পারে- যা সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে যুদ্ধ নিয়ে আসবে। যদিও ইরানের বর্তমান শাসনের পতন অনেক আমেরিকানকে খুশি করতে পারে, তবে তার ফলাফল ভয়াবহ হতে পারে- ৯ কোটিরও বেশি মানুষের দেশে অরাজকতা ছড়িয়ে পড়তে পারে। জাতিগতভাবে বিভক্ত ইরান যদি একক নেতৃত্ব হারায়, তাহলে দেশটিতে গৃহযুদ্ধ, সামরিক দখল বা জঙ্গি নিয়ন্ত্রণ দেখা দিতে পারে। সিরিয়া, ইরাক, আফগানিস্তান এবং লিবিয়া এর জ্বলন্ত উদাহরণ। এ ছাড়া প্রশ্ন ওঠে: পারমাণবিক কেন্দ্রগুলোতে বোমা বর্ষণের পর অবশিষ্ট পারমাণবিক পদার্থ সুরক্ষিত না থাকলে তা যদি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী বা দুষ্ট রাষ্ট্রগুলোর হাতে পড়ে।
ইসরাইলের ভাবনা- এই যুদ্ধ যেকোনো মূল্যে প্রয়োজন: ইসরাইলের জন্য এই যুদ্ধ হতে পারে অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই। নেতানিয়াহু মনে করেন, ইরান পারমাণবিক বোমা পেলে ইসরাইল ও ইহুদি জাতির বিলুপ্তি অনিবার্য। তবে ইতিহাস বলছে, যৌথভাবে চালানো যুদ্ধও দীর্ঘ ও জটিল হয়ে উঠতে পারে। গাজায় বহু মাসের হামলার পরেও হামাস নিশ্চিহ্ন হয়নি। ইরান তো আরও বড় চ্যালেঞ্জ। ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের আগের হস্তক্ষেপ- যেমন ১৯৫৩ সালের সিআইএ-সমর্থিত অভ্যুত্থান, শাহের প্রতি সমর্থন, কিংবা ইরান-ইরাক যুদ্ধে সাদ্দাম হোসেনকে সমর্থন- সবই পরিস্থিতি আরও খারাপ করেছে।
ট্রাম্পের অবস্থান হঠাৎ কেন বদলালো: সম্ভবত ইসরাইলের প্রাথমিক সাফল্যই ট্রাম্পকে আগ্রহী করে তুলেছে। তিনি বলেছেন, আমরা এখন ইরানের আকাশের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে। এমন একটি ‘নিম্ন ঝুঁকির’ পরিবেশ ট্রাম্পকে প্রলুব্ধ করতে পারে- বিশেষত তিনি জেনারেল প্যাটনের ভক্ত। তিনি হয়তো দ্রুত একটি ‘বিজয়’ দেখাতে চান- যেখানে তিনি দাবি করতে পারবেন, আমি ইরান সমস্যার সমাধান করেছি। ওবামা, বুশ বা বাইডেন নয়। ট্রাম্প যুদ্ধের জন্য আমেরিকাকে প্রস্তুত করেননি, বরং দেশের মধ্যে বিভাজনকেই উসকে দিয়েছেন। এমন একজন নেতা- যিনি কেবল নিজের সমর্থকদের কথা ভাবেন, যুদ্ধকালীন জাতীয় ঐক্য আনতে পারবেন কি? অবশেষে, সেই মানুষ- যিনি গর্ব করে বলেন, তিনি কখনো নতুন যুদ্ধ শুরু করেননি- এখন এমন সিদ্ধান্তের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন, যেখানে আবারো ‘অস্ত্র ব্যবস্থার ভুল তথ্য’-এর ওপর ভিত্তি করে আমেরিকান সেনা পাঠানো হবে মধ্যপ্রাচ্যে। আর্লিংটন ন্যাশনাল কবরস্থানের ৬০ নম্বর সেকশনে যারা ইরাক ও আফগানিস্তান যুদ্ধে নিহত হয়েছেন, তাদের প্রতি অন্তত এইটুকু ঋণ রয়েছে: যদি ইরানে প্রথম মার্কিন বোমা পড়ে, তাহলে আমাদের জানা দরকার, এরপর কী হবে।
(সিএনএন থেকে অনূদিত)