ঢাকা, ১ জুন ২০২৫, রবিবার, ১৮ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ৩ জিলহজ্জ ১৪৪৬ হিঃ

শেষের পাতা

বাজেট ২০২৫-২৬

ব্যয় কমানো ও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ গুরুত্ব পাবে বাজেটে

এম এম মাসুদ
৩১ মে ২০২৫, শনিবার
mzamin

আগামী অর্থবছরে ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার জাতীয় বাজেট দেয়ার পরিকল্পনা করছে ছাত্র-
জনতার গণঅভ্যুত্থানে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার। যা চলতি অর্থবছরের তুলনায় ৭ হাজার কোটি টাকা কম। এটি এই সরকারের প্রথম বাজেট। নতুন বাজেটে অগ্রাধিকার পাবে ব্যয় কমানো, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, কর্মসংস্থান, মানুষের জীবনমান, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সামাজিক সুরক্ষা ও খাদ্য নিরাপত্তা। এসবে বাড়তি গুরুত্ব দিয়ে আসন্ন বাজেটের অর্থ ব্যয়ের ছক করা হচ্ছে বলে অর্থ মন্ত্রণালয় ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্রে জানা গেছে। আসন্ন বাজেট চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের মূল বাজেটের তুলনায় প্রায় ১ শতাংশ কম। চলতি অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার বাজেট দিয়েছিল পতিত আওয়ামী লীগ সরকার।

সূত্রমতে, গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতার পরিবর্তনের ফলে বদলে যাওয়া বাংলাদেশের ভিন্ন বাস্তবতায় এবার ভিন্ন আঙ্গিকে সংসদের বাইরে বাজেট উপস্থাপন করা হবে। 

সরকারের এক তথ্য বিবরণীতে জানানো হয়, আগামী ২রা জুন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহ্‌উদ্দিন আহমেদ জাতির উদ্দেশ্যে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট উপস্থাপন করবেন। ওইদিন বিকাল ৪টায় ধারণকৃত বাজেট বক্তব্য বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বাংলাদেশ বেতারে প্রচারিত হবে।
সেইসঙ্গে অর্থ বিভাগের ওয়েবসাইটেও বাজেট ঘোষণা প্রচার করা হবে। 

অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বাজেটের আকার কমানো হলেও সমাজে বৈষম্য কমানোর পাশাপাশি মূল্যস্ফীতির চাপে নিম্নআয়ের মানুষের স্বস্তি দিতে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিতে উপকারভোগী ও কিছু ক্ষেত্রে ভাতার পরিমাণ বাড়ানোর উদ্যোগ থাকছে নতুন অর্থবছরের বাজেটে। একই সঙ্গে কৃষি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতকে অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে। আগামী অর্থবছরের জন্য সরকার জিডিপি’র প্রবৃদ্ধি সাড়ে ৫ শতাংশ ধরতে পারে। চলতি অর্থবছরে যা ছিল ৬.৭৫ শতাংশ। 

সূত্রমতে, নতুন অর্থবছরের বাজেটে ঘাটতি ধরা হতে পারে ২ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা। ঘাটতির অর্ধেকেরও বেশি বিদেশি উৎস থেকে এবং বাকিটা ব্যাংক ও সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ করার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। বাজেটে পরিচালন বা অনুন্নয়নখাতে বরাদ্দ ধরা হতে পারে ৫ লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকা। অপরদিকে উন্নয়ন ব্যয় ধরা হতে পারে ২ লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) বরাদ্দ রাখা হতে পারে ২ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। জিডিপি’র প্রবৃদ্ধি সাড়ে ৫ শতাংশ ধরা হতে পারে। আর মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৬ শতাংশে নামিয়ে আনার পরিকল্পনার কথা শোনাতে পারেন অর্থ উপদেষ্টা। জুনের প্রথম সপ্তাহে ঈদুল আজহা উদ্‌যাপিত হবে। ফলে প্রথমবারেরমতো বৃহস্পতিবারের পরিবর্তে ২রা জুন বাজেট পেশ করা হবে। 

জানা গেছে, সবকিছু ঠিক থাকলে অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বাজেট ঘোষণা করবেন। পরে তা উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে পাস হবে। রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশের মাধ্যমে এ বাজেট ঘোষণা করা হবে। সর্বশেষ ২০০৭-০৮ সালে টেলিভিশনে ভাষণের মাধ্যমে দুইটি বাজেট ঘোষণা করেছিলেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মীর্জ্জা আজিজুল ইসলাম।

সম্প্রতি অর্থ উপদেষ্টরা সালেহ্‌উদ্দিন আহমেদ বলেছেন, আমাদের লক্ষ্য হলো একটা বাস্তবভিত্তিক বাজেট করা। সীমিত সম্পদ নিয়ে উচ্চাভিলাষী বাজেট প্রণয়ন করবো না। বড় কোনো প্রকল্প নেয়া হবে না। এটি হবে সমতাভিত্তিক ও কল্যাণকামী বাজেট। এ বাজেট হবে জনগণের জীবন-জীবিকা উন্নত করার বাজেট। 
এবারের বাজেটে থাকছে কর প্রশাসন সহজ করার উপায়। অর্থনীতিতে স্বচ্ছতা আনা এবং বিনিয়োগ ও ব্যবসার উপযোগী পরিবেশ তৈরির কয়েকটি কৌশলও থাকছে এতে। এবারের বাজেটের লক্ষ্য হচ্ছে মূল্যস্ফীতি কমানো এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটানো। বাজেটে ব্যক্তি করমুক্ত আয়সীমা ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত বাড়ানো হতে পারে। 
মূল্যস্ফীতিতে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার: বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসেবে গত আড়াই বছরেরও বেশি সময় দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপরে রয়েছে। গত জানুয়ারি মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ৯.৯৪ শতাংশ। তবে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ১০.৭২ শতাংশ। গত জুলাই মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১৪.১০ শতাংশে উঠেছিল। আগামী অর্থবছর (২০২৫-২৬) শেষে গড় মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৬ শতাংশ নামিয়ে আনতে চায় সরকার। তাই সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির সঙ্গে সমন্বয় করে সরকারি ব্যয়ে সাশ্রয়ী পদক্ষেপ অব্যাহত রাখা হবে। বাজেট তৈরির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানিতে শুল্ক-কর হ্রাস অব্যাহত রাখা হবে। অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি রোধে প্রতিযোগিতা কমিশনকে শক্তিশালী করার উদ্যোগ নেয়া হবে। 

শুল্কে বড় পরিবর্তন আসছে: আগামী অর্থবছরের বাজেটে শুল্ক-করে বড় ধরনের পরিবর্তন আসছে। আমদানি শুল্ক স্তরে যেমন পুনর্বিন্যাস করা হচ্ছে, তেমনি সম্পূরক শুল্কেও পরিবর্তন আসছে। অনেক পণ্যে নতুন করে শুল্ক বসতে পারে, আবার কিছু পণ্যে শুল্ক কমানো হতে পারে। 
কালোটাকা সাদা করার সুযোগ থাকছে: বাড়ি ও অ্যাপার্টমেন্ট কেনার ক্ষেত্রে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ থাকছে। কালোটাকা সাদা করার ক্ষেত্রে করহার বাড়ানো হলেও জমি ও ফ্ল্যাট নিবন্ধনের কর কমানোর সুপারিশ করা হয়েছে। বাজারমূল্যে দলিল নিবন্ধন উৎসাহিত করতে এ সুপারিশ করা হয়েছে।
ভাতা ও সুবিধাভোগী বাড়বে: সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় ভাতার পরিমাণ ও সুবিধাভোগী বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে সরকার। বয়স্ক, বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা ভাতা ১৫০ টাকা থেকে ২০০ টাকা বাড়তে পারে। বর্তমানে সারা দেশে ৬০ লাখ বয়স্ক নাগরিককে মাসিক ৬০০ টাকা করে ভাতা দেয়া হয়। মাসিক ৫৫০ টাকা করে ২৭ লাখ ৭৫ হাজার বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা নারীকে ভাতা দেয়া হচ্ছে। আর ৩২ লাখ ৩৪ হাজার অসচ্ছল প্রতিবন্ধী ভাতা পান ৮৫০ টাকা করে। হিজড়া, বেদে, চা শ্রমিক ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে ভাতা দিচ্ছে সরকার। তাদের ভাতাও বাড়তে পারে। 

কর্মসংস্থান বাড়ানোর উদ্যোগ: সার্বিকভাবে কর্মসংস্থানে ধীরগতি রয়েছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে বাজেটে কর্মসংস্থান বাড়ানোর বিষয়ে থাকছে বিশেষ নজর। কর্মসংস্থান বাড়ানোর বিষয়টি মাথায় নিয়ে বাজেটে বরাদ্দ কিছুটা বড় করা হতে পারে। একই সঙ্গে অতিদরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থান, খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি, ভালনারেবল গ্রুপ ডেভেলপমেন্ট (ভিজিডি) কর্মসূচি ও ন্যাশনাল সার্ভিস কর্মসূচির বরাদ্দ বাড়ানোর পরিকল্পনা করা হচ্ছে।  
এবার জমি ও ফ্ল্যাট রেজিস্ট্রেশন ফি ও করহার প্রায় ৪০ শতাংশ কমতে পারে। বর্তমানে জমি ও ফ্ল্যাট রেজিস্ট্রেশনের ক্ষেত্রে অঞ্চলভেদে প্রায় ১৪ শতাংশ থেকে ১৫ শতাংশ হারে বিভিন্ন ধরনের কর ও ফি রয়েছে। আগামী অর্থবছর এটি কমিয়ে ৮ শতাংশ থেকে ৯ শতাংশে নামিয়ে আনা হতে পারে বলে জানা গেছে।

কর হার কমাতে পারে সরকার: আগামী অর্থবছর থেকে জমি ও ফ্ল্যাট রেজিস্ট্রেশন ফি ও করহার প্রায় ৪০ শতাংশ কমতে পারে। তবে করহার কমিয়ে সরকার চায় গতানুগতি মৌজামূল্য থেকে সরে এসে বাজারমূল্যের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে এসব সম্পত্তির দলিল মূল্য নির্ধারণ করা হবে। সরকার মনে করছে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়া হলে আবাসন খাতে কালোটাকার অপ্রতিরোধ্য দাপট কমে যাবে এবং একই সঙ্গে বাড়বে সরকারের রাজস্ব আহরণ।

করমুক্ত আয়সীমা বাড়তে পারে: আসন্ন জাতীয় বাজেটে ব্যক্তি ও ব্যবসায়ীদের ওপর করের চাপ কমাতে করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়ানো ও নির্দিষ্ট কিছু নিয়ম শিথিলসহ বেশকিছু উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে সরকার। বর্তমানে করমুক্ত আয়সীমা সাড়ে ৩ লাখ টাকা। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি), এফবিসিসিআই এই আয়সীমা বাড়িয়ে ৪-৪.৫ লাখ টাকা করার প্রস্তাব করেছে বিভিন্ন সময়।

এসি-ফ্রিজ-মোবাইল ফোনে ভ্যাট বাড়ছে: বর্তমানে ফ্রিজ ও এয়ার কন্ডিশনারের উৎপাদন পর্যায়ে সাড়ে ৭ শতাংশ হারে ভ্যাট আরোপিত রয়েছে, তবে এনবিআর আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছর তা ১৫ শতাংশ করার পরিকল্পনা করছে। একইভাবে, মোবাইল ফোন তৈরিতে স্থানীয় মূল্য সংযোজনের ওপর নির্ভর করে ৫ ও সাড়ে ৭ শতাংশ হারে যে ভ্যাট আরোপিত রয়েছে, তা বাড়িয়ে সাড়ে ৭ শতাংশ ও ১০ শতাংশ করারও প্রস্তাব করা হচ্ছে। এ ছাড়া ব্যাটারি তৈরির ওপরও বিদ্যমান সাড়ে ৭ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে দ্বিগুণ করা হতে পারে।

সংবাদপত্রের নিউজপ্রিন্টে শুল্কছাড়ের উদ্যোগ: সংবাদপত্রের শিল্পে ব্যবহৃত নিউজপ্রিন্ট আমদানিতে কাস্টমস শুল্ক কমানোর প্রস্তাব অর্থ উপদেষ্টার কাছে পাঠিয়েছে এনবিআর। সেই প্রস্তাবে তারা বলেছে, দেশীয় গণমাধ্যমকে আরও সহায়তা দিতে রেয়াতি সুবিধা কিছুটা বাড়ানো প্রয়োজন। সেজন্য কাস্টমস শুল্ক ৫ থেকে কমিয়ে ৩ শতাংশ করার প্রস্তাব দিয়েছে সংস্থাটি।

সিপিডি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, যদি আয়কর ও শুল্ক বাড়িয়ে ঘাটতি পুষিয়ে নিতে চায়, তবে তা জনগণের ওপর চরম চাপ তৈরি করবে। মূল্যস্ফীতির সময় এসব পদক্ষেপ হিতে বিপরীত হতে পারে।

 

পাঠকের মতামত

অপ্রয়োজনীয় কোডে বরাদ্দ বাতিল করে প্রয়োজনীয় কোডে বরাদ্দ প্রদান করা হোক।

ইরফান
৩১ মে ২০২৫, শনিবার, ৮:১৪ পূর্বাহ্ন

শেষের পাতা থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

শেষের পাতা সর্বাধিক পঠিত

   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2025
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status