অনলাইন
নজরুল-প্রমীলার প্রেমের সাক্ষী যে বাড়ি
রিপন আনসারী
(১ দিন আগে) ১ এপ্রিল ২০২৫, মঙ্গলবার, ৪:৩৭ অপরাহ্ন
সর্বশেষ আপডেট: ৭:১৬ অপরাহ্ন

যমুনা নদীর তীরঘেঁষা মানিকগঞ্জের শিবালয় উপজেলার তেওতা জমিদার বাড়ি। জমিদারি প্রথা ও প্রজা নিপীড়নের জ্বলন্ত সাক্ষী, নানা রহস্য ভরা এই জমিদার বাড়িটি অযত্ন আর অবহেলায় হারিয়ে যেতে বসেছে। একই সঙ্গে মুছে যাচ্ছে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম ও তার প্রিয়তম পত্নী প্রমীলা দেবীর প্রেমের ইতিহাস।
জমিদার বাড়ির সঙ্গে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের অনেক স্মৃতি বিজড়িত থাকলেও তা সংরক্ষণের কোনো উদ্যোগ নেই। এ জমিদার বাড়ির পাশেই ছিল নজরুলের প্রিয়তমা স্ত্রী প্রমীলা দেবীর বাড়ি। প্রমীলা দেবীর বাবা বসন্ত সেনের ভ্রাতুষ্পুত্র বীরেন সেনের সঙ্গে কবি নজরুল ইসলামের পরিচয় ঘটে এবং তাদের বন্ধুত্বের সৃষ্টি হলে নজরুল মাঝে মধ্যেই তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু বীরেন সেনের সঙ্গে তাদের বাড়িতে যাতায়াত করতেন। এরই মাধ্যমে বসন্ত সেনের পরমা সুন্দরী কন্যা প্রমীলা দেবী দুলির সঙ্গে আলাপ পরিচয়ে এক পর্যায়ে নজরুলের প্রেমের সম্পর্ক সৃষ্টি হয়। প্রমীলা নজরুলকে কবিদা বলে ডাকতেন।
জনশ্রুতি রয়েছে, নজরুল যখন প্রমীলা অনুরক্ত, তখন একদিন জমিদার বাড়ির অন্দরমহলের পুকুরে স্নানরত প্রমীলার অপরূপ সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে প্রেমিক নজরুল গান গেয়ে ওঠেন, তুমি সুন্দর তাই চেয়ে থাকি প্রিয়, সে কি মোর অপরাধ। এরপর প্রেম প্রণয়ের অনেকটা জায়গা জুড়েই আছে জমিদার বাড়ি, পুকুর ঘাট, নাটমন্দির ও নবরত্ন মঠ।
এক সময়কার সৌন্দর্যমণ্ডিত তেওতা জমিদার বাড়িটি সম্পর্কে এলাকার বয়োবৃদ্ধের মুখে মুখে এখনো কিংবদন্তির মতো অনেক অজানা কাহিনী, যা এক সময় মানুষকে অবলীলায় বিস্ময়ের আবর্তে টেনে নেয়।
জানা গেছে, পঞ্চদশ শতকের প্রারম্ভে পাচুসেন নামক এক পিতৃহীন যুবক তার সততা ও আন্তরিক চেষ্টায় তামাকের ব্যবসা করে প্রচুর অর্থ-সম্পদের মালিক হন। পাচুসেন দিনাজপুর অঞ্চলে প্রথম জমিদারী ক্রয় করে তার পাচু নাম পরিবর্তন করে পঞ্চনন্দ সেন নাম গ্রহণ করেন। পঞ্চনন্দ সেনের পুত্র শঙ্কর রায় বাহাদুর ১৬৭০;এর দশকে (বাংলা ১০৮০) তৎকালীন নাগপুরের নীলকুঠির ম্যানেজার উডীন সাহেবের কাছ থেকে কিনে নিয়ে তেওতা জমিদার বাড়ি প্রতিষ্ঠা করেন।
সৌন্দর্যমণ্ডিত এ জমিদার বাড়ির নবরত্ন মঠটির শিলালিপি থেকে জানা যায়, এ মঠটি ১৭০২-১৭০৩ খ্রিস্টাব্দে স্থাপিত। এই হিসাবে প্রায় ৩০০ বছর পূর্ব থেকে তেওতা জমিদার বাড়ি সমৃদ্ধিশীল ছিল। জমিদার বাড়ির উত্তর দিকের ভবনগুলো নিয়ে হেম শংকর এস্টেট এবং দক্ষিণ দিকের ভবনগুলো নিয়ে জয় শংকর এস্টেট গঠিত। প্রতিটি এস্টেটের সামনের অংশে যে অট্টালিকা আছে তা বর্গাকৃতির এবং এর মাঝখানে আছে দৃষ্টিনন্দন নাট মন্দির। এ মন্দিরে পূজা ও নাচ গানের আসর হতো। এস্টেটের পূর্ব দিকে ছিল অন্দরমহল। দক্ষিণ দিকে ভবনের নিচে ভূগর্ভে আজও একটি চোরা কুঠি রয়েছে। যা এ এলাকার অন্ধকূপ নামে পরিচিত ছিল। এটি ক্রমান্বয়ে ভরে গেছে। সেখানে বর্তমানে সাপ বিচ্ছুদের আস্তানা। জমিদার বাড়ির সামনের একটি ভবনে রয়েছে দুটি কয়েদখানা। সাধারণ প্রজারা খাজনা দিতে বিলম্ব করলে তাদের কয়েকখানার ভেতরে বন্দি করে নির্যাতন চালানো হতো। কয়েদখানাটি এখন আর নেই। সেখানে প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণার জন্য ব্যবহার করা হয়েছে। জমিদার বাড়ির সামনে টলমলে দিঘিতে ছিল বাঁধানো ঘাট। ঘাট সংলগ্ন প্রায় ৮০ ফুট উচ্চতাবিশিষ্ট সেই নবরত্ন মঠ। চারতলাবিশিষ্ট এই নবরত্নের প্রথম ও দ্বিতীয় তলার চারদিকে ক্ষুদ্রাকৃতির মঠ বা রত্ন এবং মাথার মঠ বা রত্ন নিয়ে মোট আটটি মঠ থাকায় একে নবরত্ন হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছিল বলে সেখানকার মানুষজনের কাছ থেকে শোনা গেছে।
এ নবরত্ন মঠটিতে সে সময় জাঁকজমকপূর্ণ দোল পূজা অনুষ্ঠিত হতো।
তেওতা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক শরৎচন্দ্র জমিদার বাড়ি প্রসঙ্গে বলেন, তেওতা জমিদার বাড়ি মূলত জমিদারদের সময় থেকেই ঐতিহ্য বহন করে আসছে। এরপর আমরা ছোট থেকে আস্তে আস্তে জেনেছি এখানে প্রেমের কবি, দ্রোহের কবি কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে আমাদের এলাকার আশালতা সেনগুপ্তা প্রমীলা দেবীর একটা প্রেমের সম্পর্ক তৈরি হয়। প্রমীলা দেবীর বাড়ি জমিদার বাড়ির পাশেই ছিল। আমরা যতটুকু জেনেছি প্রমীলা দেবীর সঙ্গে নজরুলের পরিচয়ের যে ব্যাপারটা ছিল সেটা মূলত তার বাবা বসন্ত সেনের ভ্রাতুষ্পুত্র বীরেন সেন। বীরেন সেনের সঙ্গে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের একটা সখ্যতা ছিল। তিনিও সাহিত্যপ্রেমী ছিলেন এবং কবিতা ভালোবাসতেন। এই সূত্রে কাজী নজরুল ইসলামের বেশ কয়েকবার তেওতা জমিদার বাড়িতে আসা। এখানে প্রমীলা দেবী দুলির সঙ্গে নজরুলের পরিচয় ঘটে। বিভিন্ন সময় আমরা দেখেছি বিশেষ করে ছোট হিটলার কবিতায় তেওতার কথাটা নজরুল তার কবিতায় লিখেছিলেন। সেখানে তিনি একটা লাইন লিখেছিলেন, ভয় করি না পুলিশদের, জার্মানির ওই ভাঁওতাকে কাঁপিয়ে দিতে পারি আমার মামার বাড়ি তেওতাকে।’ এ ছাড়া লোকমুখে শোনা গেছে আরও বেশ কয়েকটি গান, আমার কোন কূলে আজ ভিড়লো তরী এ কোন সোনার গাঁয় অথবা তুমি সুন্দর তাই চেয়ে থাকি প্রিয় সে কি মোর অপরাধ। এটা শুনেছি প্রমীলা দেবীকে দেখেই নজরুলের গান লেখা।
এই শিক্ষক জানান, প্রতিনিয়তই দেশি-বিদেশি অনেক দর্শনার্থী আসেন, দেখেন- তাদের ভালো লাগে। এটা আসলেই ভালোলাগার একটা জায়গা। কারণ এটা কাজী নজরুল ও প্রমীলার স্মৃতি বিজড়িত এলাকা। যত দিন যাচ্ছে আর দর্শনার্থীদের সংখ্যা বাড়ছে। দেশে-বিদেশে পর্যন্ত তেওতা জমিদার বাড়ির নাম ডাক ছড়িয়ে পড়ছে। বিশেষ করে এখানকার জমিদাররা পরবর্তীতে ইন্ডিয়া চলে যায়। ইন্ডিয়া থেকে অনেকেই মায়ার টানে, নাড়ির টানে এখানে ছুটে আসেন।
এদিকে, বিপন্নপ্রায় তেওতা জমিদার বাড়ির কিছু অংশ প্রত্নতাত্ত্বিকরা গবেষণার জন্য ব্যবহার করছেন। জমিদার বাড়ির প্রায় আট একর জমির বেশির ভাগ অবৈধ দখলদারদের কব্জায়। ইটপাথরে গাঁথা অতি প্রাচীন অট্টালিকাগুলো আজ রক্ষণাবেক্ষণের কারণে ধসে পড়ছে।
তবে জমিদার বাড়ির সম্মুখ রাস্তার পাশে নজরুল এবং প্রমীলার স্মৃতিস্তম্ভ হিসেবে ইট পাথরে গাঁথা ছবি দর্শনার্থীদের দৃষ্টি কেড়েছে। দর্শনার্থীরা জমিদার বাড়ির প্রবেশের আগেই নিজেদের সঙ্গে নজরুল-প্রমীলার ছবি ক্যামেরাবন্দি করেন। বিভিন্ন দিবসের মধ্যে বিশেষ করে ঈদের আগে-পরে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা দর্শনার্থীদের পদচারণায় মুখরিত হয়ে ওঠে জমিদার বাড়িটি।