বাংলারজমিন
দিনাজপুরে জাল সার্টিফিকেট দিয়ে প্রধান শিক্ষক
দিনাজপুর প্রতিনিধি
৮ জানুয়ারি ২০২৫, বুধবার
দিনাজপুরের কাশিপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের অব্যাহতিপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক লোকমান হাকিমের বিরুদ্ধে অর্থ জালিয়াতি, উপবৃত্তির টাকা আত্মসাৎ ও বই ক্রয়ে বড় দুর্নীতিসহ নানা অভিযোগ উঠেছে। শুধু তাই না, তার বিরুদ্ধে বিএড কোর্সের জাল সার্টিফিকেট দিয়ে চাকরি করার গুরুতর অভিযোগও রয়েছে। লোকমান হাকিম এসব অভিযোগে ইতিপূর্বে কারাভোগও করেন।
অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, প্রধান শিক্ষক লোকমান হাকিম ২০১৩ সালের ১লা এপ্রিল প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। পরে নানা অনিয়ম ও জালিয়াতির কারণে ২০১৪ সালের ১২ই মার্চ চূড়ান্ত বরখাস্ত হন। এর পর সাবেক হুইপ ও তার ছোট ভাই মাতলুব মামুনের প্রভাব খাটিয়ে পুনরায় বিদ্যালয়ে যোগদান করেন। এই বিদ্যালয়ে যোগদানের আগে দিনাজপুর ইকবাল হাই স্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক থাকা অবস্থায় দুর্নীতি, অনিয়ম ও রাতে বিদ্যালয়ের গাছ কাটার অভিযোগে বরখাস্ত হন। এ ছাড়া দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে ভুয়া ক্যাম্পাস খুলে জাল সনদ বিক্রি করার দায়ে ৩০ সেপ্টেম্বর’১১ ভ্রাম্যমাণ আদালত কর্তৃক গ্রেপ্তার হয়ে জেল হাজতে যান। অত্র বিদ্যালয়ে যোগদানের পর ৫০ লাখ টাকার নিয়োগ বাণিজ্য এবং অভ্যন্তরীণ আয়ের প্রায় ৪০ লাখ টাকা দিয়ে সে নিজের বিলাসবহুল বাড়ি নির্মাণ করেন। অভিযোগে আরও জানা যায়, প্রতিষ্ঠান প্রধান হতে হলে সহকারী শিক্ষক হিসেবে ১২ বছর অভিজ্ঞতা প্রয়োজন হলেও লোকমান হাকিম ১০ বছরের অভিজ্ঞতা দেখান। আবার সেটিও নিয়মবহির্ভূতভাবে করা হয়। নিয়মানুযায়ী এক প্রতিষ্ঠান থেকে অন্য প্রতিষ্ঠানে গেলে কর্মরত প্রতিষ্ঠানের প্রধান শিক্ষকের কাছে ছাড়পত্র প্রয়োজন। কিন্তু তিনি তা সভাপতির কাছ থেকে নিয়েছেন। শুধু তাই না, তিনি নিয়োগের সময় এক ধরনের এবং এমপিও করার সময় আরেক ধরনের অভিজ্ঞতাপত্র প্রদর্শন করেন। জালিয়াতি এমনভাবে করেন যে, অভিজ্ঞতা প্রদানের তারিখ ০৪-০৩-২০১৩ এবং সত্যায়িতের তারিখ ০৩-০৩-২০১৩ইং। অন্তহীন জালিয়াতির হোতা লোকমান হাকিম পারফরমেন্স বেজড গ্রান্টস ফর সেকেন্ডারি ইন্সটিটিউশনস (পিবিজিএসআই) স্কিমের আওতায় ২০২২-২৩ অর্থ বছরে স্কুল/মাদ্রাসা/কলেজ ব্যবস্থাপনা জবাবদিহি অনুদানের প্রাপ্ত ৫ লাখ টাকার বিল ভাউচার ভুয়াভাবে তৈরি করেন। উপজেলা নির্বাহী অফিসার রমিজ আলম কর্তৃক প্রদত্ত বিদ্যালয়ের আসবাবপত্র (বেঞ্চ) বাবদ প্রদানকৃত ৫২ হাজার টাকার ব্যয়ের কোনো হিসাব প্রদান করেননি। তিনি শিক্ষার্থীদের নিয়েও জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছেন। বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এক বিষয়ে নির্বাচনী পরীক্ষায় ২৭ জন ফেল করার কারণে এসএসসি পরীক্ষার ফরম পূরণ করতে পারেনি। অপরদিকে সেন্ট ফিলিপস্ স্কুলের ১০ জন শিক্ষার্থী নির্বাচনী পরীক্ষায় ফেল করলে লোকমান হাকিম তাদের কাছ থেকে ১৮ লাখ টাকার বিনিময়ে ফরম পূরণ করেন। ক্ষমতার অপব্যবহার করে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী মো. আবুল কাশেমকে বাধ্যতামূলকভাবে অবসরে যেতে বাধ্য করে। জানা গেছে, লোকমান হাকিমের বিএড সনদটি জাল হওয়ায় তার সনদটি উপজেলা নির্বাহী অফিসার, দিনাজপুর যাচাইয়ের জন্য নির্দেশনা দেয়। পরে লোকমান হাকিম দিনাজপুর শিক্ষক প্রশিক্ষণ কলেজ, দিনাজপুর ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর, ঢাকা কর্তৃপক্ষ ও উপজেলা নির্বাহী অফিসার কর্তৃক গঠিত তদন্ত কমিটিকে অর্থের বিনিময়ে ম্যানেজ করে প্রতিবেদন তৈরি করে। ফলে সেই অভিযোগের তদন্ত রিপোর্ট আজও আলোর মুখ দেখেনি। লোকমান হাকিম প্রধান শিক্ষক হওয়ার পর স্থানীয় যুবক মো. আসাদুজ্জামান নুরকে অফিস সহকারী পদে নিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়ে তার কাছ থেকে ৫ লাখ ৫০ হাজার টাকা গ্রহণ করে। তাকে সাড়ে ছয় বছর পারিশ্রমিক না দিয়ে অফিস সহকারী ও খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে ব্যবহার করেও শেষ পর্যন্ত নিয়োগের ব্যবস্থা করেননি। সেইসঙ্গে তার কাছ থেকে গ্রহণকৃত টাকাও ফেরত প্রদান করে না বরং অস্বীকার করেন। একইভাবে সহকারী প্রধান শিক্ষক নিয়োগের প্রতিশ্রুতিতে মো. ওয়াজেদুল ইসলামের কাছ থেকে ১১ লাখ ৪০ হাজার টাকা নিয়ে অন্যজনকে নিয়োগ দেন। এসব কারণে তার বিরুদ্ধে জেলা দিনাজপুরের সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত-৪ এ একটি মামলা হয়। এ মামলায় তিনি জামিন অবস্থায় আছেন। লোকমান হাকিমের বিরুদ্ধে আরও গুরুতর অভিযোগ হলো- তিনি ছাত্রীদের হিজাব পরতে বাধা দেন। তার নামে ছাত্রীরা শ্লীলতাহানির লিখিত অভিযোগও করে। একজন প্রধান শিক্ষক হয়েও সে ছাত্র-ছাত্রীদের বাজে ভাষায় গালিগালাজ করতেন। শিক্ষার উন্নয়নের জন্য এ ধরনের শিক্ষকের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়ার জন্য এলাকাবাসী, ছাত্র-ছাত্রী ও শিক্ষকবৃন্দ জোর দাবি জানায়।
এ ব্যাপারে কাশিপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের অব্যাহতিপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক লোকমান হাকিম মানবজমিনকে বলেন, আমার বিরুদ্ধে আনীত সব অভিযোগই মিথ্যা ও বানোয়াট। দুর্নীতি আমি করিনি। আমি নিয়ম অনুযায়ীই আয়-ব্যয় করে এসেছি। মূলত, একটি গোষ্ঠী আমার কাছে চাঁদা দাবি করেছিল। কিন্তু আমি অস্বীকৃতি জানানোয় এমন প্রোপাগান্ডা চালাচ্ছে।