শেষের পাতা
মামলা পিছু ছাড়ছে না সিলেটে ‘ভূমির কুতুব’ মহিতোষের
ওয়েছ খছরু, সিলেট থেকে
১২ অক্টোবর ২০২৪, শনিবারসিলেটের ভূমির মালিকদের কাছে আলোচিত নাম মহিতোষ চন্দ্র দাস। ভূমি জরিপকালে ছিলেন আতঙ্কের নামও। ক’বছর আগে বিতর্ক এড়াতে এই ভূমি জরিপ কর্মকর্তা অবসরে গিয়েছেন। এরপরও তাকে ঘিরে আলোচনা শেষ হয়নি। বরং দিন দিন ডালাপালা মেলছে। এখনো তার ওপর সংক্ষুব্ধ মানুষ। ভূমিতে চাকরি করে হয়েছেন টাকার মালিক। গড়েছেন সম্পদের পাহাড়। এখন অনেকটা আত্মগোপনে রয়েছেন। সম্প্রতি তিনি হয়েছেন মামলার আসামি। সিলেটের আদালতে দায়ের করা মামলা তদন্ত করছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন- পিবিআই। সেটেলমেন্ট কর্মকর্তা থাকাকালে রেকর্ড সংশোধনের পর ছাপা খতিয়ান সৃজন করার নামে কুলাউড়া উপজেলার বাসিন্দা সামসুল হোসেনের কাছ থেকে ৩০ লাখ টাকা ঘুষ নিয়েছিলেন মহিতোষ। কিন্তু কাজ করেননি। সামসুল ইসলাম একাধিকবার যোগাযোগ করলেও তিনি টাকা পরিশোধ করেননি। এই অবস্থায় সামসুল ইসলামকে এড়িয়ে চলছেন। সামসুল ইসলাম জানিয়েছেন, সিলেট নগরের পনিটোলার বাসভবনে গিয়ে একাধিকবার সন্ধান করলেও তার স্ত্রী শিল্পী রানী ধর ও কাজের লোক দুর্ব্যবহার করেন। দেন নানা হুমকিও। এ অবস্থায় সম্প্রতি ৩০ লাখ টাকা আত্মসাতের দায়ে সিলেট মেট্রোপলিটন ২য় আদালতে মামলা করেছেন তিনি। এ মামলায় মহিতোষের স্ত্রী শিল্পী রানী ধর ও জগন্নাথপুর উপজেলার ভূমি দালাল হিসেবে খ্যাত সময় চন্দ্র দাসকেও আসামি করা হয়েছে। সামসুল জানান, আদালত ন্যায়বিচারের স্বার্থে তদন্তের জন্য পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) নির্দেশ প্রদান করায় সাব-ইন্সপেক্টর মোহন লাল দাস তদন্তের দায়িত্ব পেয়েছেন। তাকে বাদী হিসেবে আমরা সার্বিক সহযোগিতা করছি। সিলেটে বহুল আলোচিত সমালোচিত এ ভূমি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে এবারই প্রথম মামলা হয়নি। ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন, তার বিরুদ্ধে ঘুষ-দুর্নীতি, জালিয়াতির ঘটনায় অনেক মামলা হয়েছে। একাধিক মামলার ঘটনাটি দুদক তদন্তও করেছে। কিন্তু এসব মামলা থেকে মহিতোষ কৌশলে বেরিয়ে যান। সিলেটে এক সময় মহিতোষকে সবাই চিনতেন প্রয়াত রাজনীতিবিদ সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের স্বজন হিসেবে। কেউ কেউ বলতেন সুরঞ্জিতকে ‘ধর্মের পিতা’ হিসেবে মানতেন মহিতোষ। এ কারণে সিলেট সেটেলমেন্টসহ ভূমি সংশ্লিষ্ট সকল দপ্তরে একচেটিয়া প্রভাব খাটিয়েছেন মহিতোষ। তার বাড়ি সুনামগঞ্জের শাল্লায়। পিতা ছিলেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের ডানহাত। ভূমির কয়েকজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, সাবেক জোনাল সেটেলমেন্ট অফিসার সৈয়দ ফারুক আহম্মদ ও মুহাম্মদ ওবায়দুর রহমানের সময় মহিতোষের দাপটে সবাই তটস্থ থাকতেন।
এমনকি সেটেলমেন্ট অফিসাররাও তাকে সমীহ করতেন। আওয়ামী লীগের সাবেক মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের সঙ্গে সম্পর্কের কারণে ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তরে উপ-সহকারী সেটেলমেন্ট অফিসার বা কানুনগো পদে নিয়োগ লাভের পর সিলেটে যোগদান করেন। এরপর তাকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। মহিতোষ সিলেট সেটেলমেন্টে একক সাম্রাজ্য কায়েম করে অর্ধশত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। নিজ এলাকা শাল্লা ও মামার বাড়ি হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচং উপজেলায় বিঘার পর বিঘা জমির মালিকানাসহ ফিসারিজ ব্যবসাও রয়েছে তার। সিলেট শহরের পনিটোলা, ভাতালিয়া, বিমান বন্দর এলাকা, সালুটিকর, সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়কের পার্শ্বে, সুনামগঞ্জ শহর, ঢাকার সিদ্ধেশ্বরী, বসুন্ধরা, বনশ্রী ও আফতাবনগর এলাকায় রয়েছে তার বিশাল প্লট ও ফ্ল্যাট। এই সম্পত্তির মূল্য অর্ধশত কোটি টাকারও বেশি। চাকরি জীবনে টাকা দিলে ভূমি রেকর্ড বিভাগে এমন কোনো কাজ নেই যা তিনি করেননি। টাকা দিলে অসম্ভবকে সম্ভব করাই ছিল তার একমাত্র নেশা। সরকারি সম্পত্তি, খেলার মাঠ, সাবেক অতিরিক্ত সচিবের ভূমিসহ সিলেট বিভাগের হাজার হাজার নিরীহ ভূমির মালিকদের নির্ভেজাল ভূমির রেকর্ড অবৈধ পন্থায় পরিবর্তন করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে এ দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা। দামি গাড়িতে চড়ে অফিসে যাতায়াত করতেন। তার স্ত্রী ও দুই সন্তানের জন্য রয়েছে আলাদা গাড়ি। কানাডায়ও রয়েছে তার বাড়ি-গাড়ি। সেখানে তার দুই সন্তান বসবাসও করেন। ৫ই আগস্টের প্রেক্ষাপট পরিবর্তনের আগে কখনো কখনো প্রকাশ্য দেখা গেলেও এখন পুরোপুরি আত্মগোপনে।
সিলেট নগরের পনিটুলা এলাকার বাসিন্দারা জানিয়েছেন, মহিতোষের বাসভবন এলাকার মানুষের জন্য যন্ত্রণার আরেক নাম। পাওনাদাররা সব সময় তার বাসায় আসেন। কিন্তু স্ত্রী ফটকই খুলেন না। এ কারণে প্রতিদিনই মানুষ এসে গালিগালাজ করে যায়। এ গালিগালাজের দৃশ্য এখন এলাকার মানুষের কাছে নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারা জানান, পনিটোলার নিজ বাসভবনে গভীর রাতে সবার অগোচরে এলেও ভোর রাতে পুনরায় বাসভবন থেকে চলে যান। সিলেট বিভাগের নিরীহ ভূমির মালিকদের টাকা আত্মসাৎ করে সিলেট, হবিগঞ্জ ও ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় আত্মগোপনে থেকে কানাডায় যাওয়ার চিন্তা-ভাবনা করছেন বলে জানান প্রতিবেশীরা। ভুক্তভোগী কয়েকজন জানিয়েছেন, শত শত আবেদন সাবেক প্রধানমন্ত্রী, মুখ্য সচিব, মন্ত্রিপরিষদ সচিব, জনপ্রশাসন সচিব, ভূমি সচিব, মহাপরিচালক, জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা শাখা ও দুদক প্রধান কার্যালয়ে অভিযোগ করেও কোনো প্রতিকার পাওয়া যায়নি। ২০২০ সালে সরকারি চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন তিনি। দুর্নীতির দায়ে ভূমি মন্ত্রণালয়ের জরিপ শাখা থেকে অবসরোত্তর ছুটি ও থোক বরাদ্দ মঞ্জুর করা হলেও এখনো স্থায়ী পেনশন মঞ্জুর হয়নি। এই টাকা পেতে তিনি দৌড়ঝাঁপ করছেন।
তারা জানান, মহিতোষের বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের কারণে বিভিন্ন সময় ভূমি অফিসের কর্মকর্তা মামলাসহ নানা ধরনের হেনস্থার শিকার হয়েছেন। এখন অনেকেই ফেরারি জীবন কাটাচ্ছেন বলে জানান তারা।
সিলেটের মানুষেরা কি বোকা? এরকম একটা অপরাধীকে ধরতে পারছে না ।