শরীর ও মন
জটিল রোগ লিভার ক্যান্সার
ডা. মোহাম্মদ মোন্তাফিজুর রহমান
১ মে ২০২২, রবিবার
লিভার ক্যান্সার একটি ভয়ঙ্কর রোগ এবং বিশ্বব্যাপী এই রোগের রোগীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। লিভার ক্যান্সার আমাদের শরীরের অন্য যেকোনো অঙ্গের ক্যান্সার থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। লিভার বাদে অন্য ক্যান্সার সাধারণত সুস্থ অঙ্গে উৎপত্তি হয় কিনু্ত লিভার ক্যান্সার সাধারণত অসুস্থ (সিরোসিস) লিভারে হয়। সুতরাং লিভার ক্যান্সারের ক্ষেত্রে একই সঙ্গে দু’টি বিষয়কে মাথায় রাখতে হয়। প্রথমত: অসুস্থ লিভারের চিকিৎসা, দ্বিতীয়ত: লিভার ক্যান্সারের চিকিৎসা। শরীরের বেশির ভাগ ক্যান্সারই অপ্রতিরোধ যোগ্য যেহেতু এগুলো সুস্থ অঙ্গে হয়, অপরদিকে লিভার ক্যান্সার প্রতিরোধযোগ্য কারণ লিভার ক্যান্সার অসুস্থ (সিরোসিস) লিভারে হয়। আর আমরা যেহেতু লিভার অসুস্থ হওয়ার কারণগুলো জানি, সুতরাং অসুস্থ হওয়ার কারণগুলো পরিহার করতে পারলেই লিভার ক্যান্সার থেকে দূরে থাকা সম্ভব।
লিভার অসুস্থ বা সিরোটিক হওয়ার মূল কারণগুলো হলো- (১) দীর্ঘদিন ধরে হেপাটাইটিস বি বা সি ভাইরাসে আক্রান্ত থাকা, (২) দীর্ঘমেয়াদি অ্যালকোহল আসক্তি বা ফ্যাটি লিভার। লিভারের আরও একটি একটি ক্যান্সার আছে যেটি লিভারে উৎপত্তি হয় না বরং শরীরের অন্য কোনো অঙ্গে (কোলন, পাকস্থলী, প্যানক্রিয়াস, পিত্তথলি, পিত্তনালী, ওভারি, জরায়ু, কিডনি, প্রেস্টেট, ব্রেস্ট) উৎপত্তি হয়ে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নিজ অঙ্গে বাড়ার পাশাপাশি রক্তের মাধ্যমে লিভারে ছড়িয়ে পড়ে। আর এ ধরনের লিভার ক্যান্সারকে সেকেন্ডারি লিভার ক্যান্সার বলে।
রোগ নির্ণয়
যাদের আগেই জানা আছে যে, ক্রোনিক হেপাটাইটিস বি বা সি ভাইরাসের রোগী, ফ্যাটি লিভারে আক্রান্ত বা দীর্ঘদিন ধরে অতিমাত্রায় অ্যালকোহল খান, তাদের ক্ষেত্রে টিউমার মার্কার-আলফা ফিটো প্রোটিন ও পেটের সিটি স্ক্যান করলেই টিউমারের উপস্থিতি শনাক্ত হয়। অন্যদের ক্ষেত্রে অবস্থাভেদে নিম্নোক্ত পরীক্ষাগুলো করতে হয়।
প্রতিরেধের উপায়
(১) যাদের শরীরের এখনও
হেপাটাইটিস ‘বি’ ভাইরাস সংক্রমিত হয়নি, তাদের হেপাটাইটিস ‘বি’ ভাইরাসের ভ্যাক্সিন নিয়ে নেওয়া।
(২) যারা হেপাটাইটিস বি ও সি ভাইরাসের রোগী, রোগের অবস্থার ভিত্তিতে তাদের চিকিৎসা নেওয়া।
(৩) ফ্যাটি লিভার থেকে মুক্ত থাকা (শরীরের ওজন কমানো, ডায়াবেটিক ও হাইপোথাইরয়েডের চিকিৎসা নেওয়া, কায়িক পরিশ্রম বাড়ানো, শর্করা জাতীয় খাবার কমিয়ে আনা)।
(৪) অ্যালকোহল ও মদ্যপান থেকে সম্পূর্ণ বিরত থাকা।
হেপাটাইটিস বি এবং সি-এর থেকে পরিত্রাণে করণীয়
১. হেপাটাইটিস ‘বি’ অথবা সি’তে আক্রান্ত রোগী বা ব্যক্তির রক্ত গ্রহণ করা যাবে না।
২। ডিসপোজেবল সিরিঞ্জ ছাড়া ইঞ্জেকশন গ্রহণ করা যাবে না।
৩। মাদক গ্রহন ব্যাক্তিদের কাছ থেকে দূরে থাকতে হবে।
৪। যৌনমিলনে কনডম ব্যবহার করতে হবে।
৫. সবারই হেপাটাইটিস বি-এই ভ্যাকসিন নেওয়া উচিত।
৬. চিকিৎসক, নার্স, প্যারামেডিকস সবার ভ্যাকসিন নেওয়া উচিত।
৭. হিমোফিলিয়া, থ্যালাসেমিয়া এবং যাদের ডায়ালাইসিস চলছে তাদের অবশ্যই ভ্যাকসিন নিতে হবে। এলকোহল বা মদ পান বন্ধ করতে হবে। এলকোহল গ্রহণ করলে লিভার সিরোসিস এবং পরবর্তী পর্যায়ে লিভার ক্যান্সার হয়।
লিভার ক্যান্সারের স্টেজ ও চিকিৎসা
লিভার ক্যান্সার স্টেজ এর ক্ষেত্রে প্রায় ৩টি স্টেজিং সিস্টেম বিদ্যমান। তবে সবচেয়ে স্বীকৃত স্টেজিং হলো-ইঈঈখ. ইঈঈখ অনুযায়ী লিভার ক্য্যান্সারকে ৪টি ধাপে ভাগ করা হয়েছে।
(১) প্রথম বা শুরুর ধাপ ঃ লিভার ১টি টিউমার যার সাইজ ৫ সে.মি. বা তার কম। অথবা ২ বা ৩টি টিউমার যাদের যোগফল ৫ সে.মি. বা তার কম।
(২) মধ্যম ধাপঃ একটি লিভার কিন্ত আকার ৫ সে.মি. এর বেশী অথবা একাধিক টিউমার যাদের যোগফল ৫ সে. মি. এর বেশী।
(৩) শেষ ধাপ ঃ টিউমার লিভারের আশেপাশের রক্তনালীতে ছড়িয়ে পড়েছে অথবা অন্য কোন অঙ্গে পড়েছে।
(৪) ক্রিটিক্যাল বা অন্তিম ধাপ ঃ টিউমার যে আকারেরই হোক না কেন, লিভারের অবস্থা এতই খারাপ যে পেটে পানি চলে এসেছে, রক্ত বমি হচ্ছে, জন্ডিস বেড়ে গেছে, রোগী নিজের ব্যাক্তিগত কাজগুলো (বাথরুমে যাওয়া, দাত ব্রাশ করা, জামা কাপড় পরিধান করা) নিজে করতে অক্ষম।
চিকিৎসা
প্রথম ধাপে টিউমারের সার্জারী, লিভার প্রতিস্থাপন বা অ্যাবলোশন থেরাপি যেমন-জঋঅ, মাইক্রোওয়েভ অ্যাবলোশন প্রয়োগ করা যায়। মধ্যম ধাপে TACE বা লিভার টিউমারের মধ্যে ক্যাথেটারের মাধ্যমে ক্যামোথেরাপি। শেষ ধাপে সোরাফেনিব/লেনভাটিনিব দেওয়া হয়। ক্রিটিক্যাল বা অন্তিম ধাপে লিভার ক্যান্সারের নির্দিষ্ট কোন সার্জারী বা থেরাপি দেওয়া যাবে না। শুধুমাত্র উপসর্গভিত্তিক চিকিৎসা দিতে হবে। যেমন- পেটে ব্যথা, কষা পায়খানা, বমি, পেটে পানির চিকিৎসা করতে হবে।
লেখক: এফসিপিএস (সার্জারী) এমএস (হেপাটোবিলিয়ারী, প্যানক্রিয়াটিক এবং লিভার ট্রান্সপ্লান্ট সার্জন)।
কনসালট্যান্ট: শেখ রাসেল জাতীয় গ্যাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, ঢাকা।