ঢাকা, ৩ জুলাই ২০২৪, বুধবার, ১৯ আষাঢ় ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২৬ জিলহজ্জ ১৪৪৫ হিঃ

শেষের পাতা

সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে ধস

অর্থনৈতিক রিপোর্টার
১ জুলাই ২০২৪, সোমবারmzamin

চলতি অর্থবছরের দশ মাসে জাতীয় সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রি নেতিবাচক পর্যায়ে নেমে এসেছে। সাধারণত মধ্যম আয়ের লোকজন নিরাপদ বিনিয়োগের খাত হিসেবে সঞ্চয়পত্রে বেশি বিনিয়োগ করতো। কিন্তু গত দেড় বছর ধরে একটানা উচ্চ মূল্যস্ফীতি অব্যাহত থাকায় মানুষের সঞ্চয় করার ক্ষমতা তলানিতে ঠেকেছে। ফলে কেনার চেয়ে ভাঙানোর প্রবণতা বেশি লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, টানা আট মাস ধরে সঞ্চয়পত্রের নিট বিনিয়োগের (বিক্রি) পরিমাণ ঋণাত্মক ধারায় রয়েছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে  (জুলাই-এপ্রিল) সঞ্চয়পত্রে নিট বিনিয়োগ ঋণাত্মক হয়েছে ১৪ হাজার ৬৪৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ এই ১০ মাসে মোট বিক্রির চেয়ে এই পরিমাণ সঞ্চয়পত্র বেশি ভাঙানো হয়েছে। এর মানে আলোচ্য সময়ে সঞ্চয়পত্র থেকে কোনো ঋণই পায়নি সরকার। গত অর্থবছরে তার আগের অর্থবছরের চেয়ে কমেছিল ৩ হাজার ২৯৬ কোটি টাকা। এর ফলে শেষ সময়ে সরকারের ব্যাংক ঋণে নির্ভরতা বাড়ছে। 

এদিকে আগামীতেও সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ না পাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। আর এ কারণেই নতুন অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র থেকে নিট ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা অনেকটাই কমানো হয়েছে।

বিজ্ঞাপন
অন্যদিকে ব্যাংক ঋণের লক্ষ্যমাত্রা বাড়ানো হয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগে নানা রকম বিধিনিষেধের কারণে গ্রাহকরা সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ কমিয়ে দিয়েছে। এ ছাড়া মানুষের সঞ্চয় ক্ষমতা কমেছে। পাশাপাশি এক সময় বিত্তশালীরা নামে-বেনামে বড় অঙ্কের অর্থে সঞ্চয়পত্রে কিনতো। বিভিন্ন দুর্নীতির অর্থও এখানে বিনিয়োগ হতো। কিন্তু সঞ্চয়পত্র ব্যবস্থাপনা ডিজিটাল হওয়ায় সেই সুযোগ কমে গেছে। এ ছাড়া একক ব্যক্তির নামে কেনার ঊর্ধ্বসীমাও কমানো হয়েছে। ব্যাংক আমানতের সুদহার বেড়ে যাওয়ার কথাও বলেছেন বিশেষজ্ঞরা। 

গ্রাহকরা জানান, বর্তমানে মানুষের পণ্য ও সেবার দামে লাগামহীন ঊর্ধ্বগতিতে জীবনযাপনের খরচ বেড়ে গেছে। যার প্রভাব পড়ছে সঞ্চয়ের ওপর। বিশেষ করে নির্দিষ্ট আয়ে যাদের সংসার চলে, তাদের অনেকেই এখন সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছেন। ফলে নির্দিষ্ট মেয়াদপূর্তির আগেও অনেকে সঞ্চয়পত্র ভেঙে সংসার চালাচ্ছেন। কেউ কেউ মেয়াদপূর্তির পর পুনর্বিনিয়োগ না করে টাকা তুলে নিচ্ছেন। আবার যাদের কাছে টাকা আছে, তারাও এখন কড়াকড়ির কারণে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগে আগ্রহী হচ্ছেন না। কারণ এখন ব্যাংকে টাকা রাখলেও বেশি সুদ মিলছে। গত মাসে সুদহার বাজারের ওপর ছেড়ে দেয়ার পর অনেক ব্যাংকই সঞ্চয়পত্রের কাছাকাছি বা এর চেয়ে বেশি সুদে আমানত সংগ্রহ করছে। ফলে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের ধস অব্যাহত রয়েছে।
গত ১৫ মাস ধরে মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপরে রয়েছে। আর উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে পড়ে সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছেন একশ্রেণির বিনিয়োগকারীরা। 

এদিকে প্রতি অর্থবছরের বাজেটে নিট বিক্রি হিসেবে সঞ্চয়পত্রের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়ে থাকে, যা সরকারের ঋণ হিসেবে গণ্য হয়। চলতি অর্থবছরের সঞ্চয়পত্র বিক্রি থেকে নিট ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় ১৮ হাজার কোটি টাকা। তবে বিক্রি ধারাবাহিক কমতে থাকায় সংশোধিত বাজেটে এই লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে ধরে ৭ হাজার ৩১০ কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়েছে। নতুন অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র থেকে মাত্র ১৫ হাজার ৫০০ কোটি টাকার নিট ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে সরকার। এই লক্ষ্যমাত্রা কমানোর পেছনে অন্যতম কারণ হলো- আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের শর্ত পূরণ। সংস্থাটির ঋণ প্রস্তাবে বিভিন্ন শর্তের মধ্যে সঞ্চয়পত্র বিক্রি থেকে সরকারের ঋণ কমানোর শর্তও রয়েছে।

জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের প্রতিবেদন অনুযায়ী, সর্বশেষ গত এপ্রিলে সঞ্চয়পত্র নিট বিক্রি ঋণাত্মক হয়েছে ২ হাজার ১০৩ কোটি টাকা। তার আগের মাস মার্চে নিট বিক্রি ঋণাত্মক হওয়ার পরিমাণ ছিল আরও বেশি, প্রায় ৩ হাজার ৬৫৩ কোটি টাকা। অথচ গত বছরের এপ্রিল মাসে নিট বিক্রি ইতিবাচক ছিল প্রায় ৫৮২ কোটি টাকা। সবমিলিয়ে চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) নিট বিক্রি ঋণাত্মকের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৪ হাজার ৬৪৮ কোটি টাকা। গত অর্থবছরের একই সময়ে নিট বিক্রি ঋণাত্মক ছিল ৩ হাজার ৫৮০ কোটি টাকা। এই হিসাবে এবার নিট বিক্রি ঋণাত্মক হওয়ার পরিমাণ ৪ গুণের বেশি বেড়েছে।
তথ্যে দেখা গেছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাস (জুলাই-আগস্ট) সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রি ৫ হাজার ৫৬২ কোটি টাকা ইতিবাচক ছিল। তবে এরপর থেকে নিট বিক্রি ঋণাত্মক হতে থাকে। সেপ্টেম্বরে ঋণাত্মক হয় ১৪৭ কোটি, অক্টোবরে এক হাজার ৪০ কোটি, নভেম্বরে এক হাজার ৫৫৪ কোটি, ডিসেম্বরে ২ হাজার ২০৪ কোটি, জানুয়ারিতে ১ হাজার ২৮৭ কোটি, ফেব্রুয়ারিতে ১ হাজার ৫৪১ কোটি এবং মার্চে ৩ হাজার ৬৫৩ কোটি টাকা এবং এপ্রিলে হয় ২ হাজার ১০৩ কোটি টাকা। অর্থাৎ শেষ আট মাসে সঞ্চয়পত্র কেনার চেয়ে ভাঙানোর প্রবণতা বেড়েছে।

আমানত সংগ্রহেও আকর্ষণীয় সুদ দিচ্ছে অনেক ব্যাংক। বিশেষ করে তারল্য সংকটে থাকা ব্যাংকগুলো আমানতে প্রায় ১২ শতাংশ পর্যন্ত সুদ অফার করছে, যা সঞ্চয়পত্রের চেয়েও বেশি। বর্তমানে পেনশনার সঞ্চয়পত্রে সুদের হার ১১.৭৬ শতাংশ। এ ছাড়া পরিবার সঞ্চয়পত্রে সুদের হার ১১.৫২ শতাংশ, পাঁচ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্রে সুদ ১১.২৮ শতাংশ ও তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্রে সুদের হার ১১.০৪ শতাংশ। তবে মেয়াদপূর্তির আগে ভাঙলে এই সুদও মিলছে না। ফলে গুরুত্ব হারাচ্ছে সঞ্চয়পত্র।
সূত্র জানায়, সঞ্চয়পত্র বিনিয়োগে ২০১৯ সালের ১লা জুলাই থেকে এনআইডি ও টিআইএন জমা দেয়ার বাধ্যবাধকতা শুরু হয়। ফলে যারা আগে সঞ্চয়পত্র কিনেছিলেন, তাদের অনেকেই মেয়াদ শেষ হওয়ার পরে নতুন করে আর এতে বিনিয়োগ করেননি। আবার বর্তমানে ৫ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগের ওপর অর্জিত সুদের বিপরীতে ১০ শতাংশ কর দিতে হয়। এ ছাড়া বিনিয়োগের পরিমাণের ওপর ভিত্তি করে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর থেকে সঞ্চয়পত্রের সুদের হারের নানা স্তর চালু করা হয়েছে।
সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে ধস অব্যাহত থাকায় সরকারের ব্যাংক ঋণ নির্ভরতা বাড়ছে। চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকারের ব্যাংক ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় ১ লাখ ৩২ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা। তবে সংশোধিত বাজেটে এই লক্ষ্যমাত্রা বাড়িয়ে ১ লাখ ৫৫ হাজার ৯৩৫ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়। 

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে (জুলাই-মে) বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে সরকার নিট ঋণ নিয়েছে প্রায় ৭৮ হাজার ২০০ কোটি টাকা। তবে একই সময়ে আগের নেয়া ঋণের ১৬ হাজার ৮০০ কোটি টাকা পরিশোধ করেছে সরকার। এতে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকারের নেয়া নিট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬১ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। এই ঋণের জোগান দিতে গিয়ে তারল্য সংকটে থাকা ব্যাংক খাত আরও চাপে রয়েছে। তারপরও আগামী অর্থবছরের বাজেটে ব্যাংক খাত থেকে ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১ লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা।
সঞ্চয়পত্র অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা বলেন, সঞ্চয়পত্রে আগের মতো গ্রাহকরা পেনশনের পুরোটা বিনিয়োগ করতে পারছে না। এ ছাড়া আগে নামে-বেনামে গ্রাহকদের বিনিয়োগ ছিল। এখন সকল বিনিয়োগ করতে টিআইএন সার্টিফিকেট (ট্যাক্স আইডেন্টিফিকেশন নম্বর) দিতে হচ্ছে যার কারণে বিনিয়োগ অনেকটা কমে গেছে।

পাঠকের মতামত

সঞ্চয় পত্রের উপর শরিয়াভিত্তিক মুনাফা ব্যবস্থা চালু হলে এর বিক্রি বাড়বে।

মাহিন
১ জুলাই ২০২৪, সোমবার, ১:৫০ অপরাহ্ন

সন্চয় পত্রের সুদহার নির্ধারণ অযৌক্তিক ভাবে কম হওয়ায় ( সিলিং লিমিট নির্ধারণ করায়) এই দুরবস্থার মূল কারন।

A R Sarker
১ জুলাই ২০২৪, সোমবার, ৮:৪৪ পূর্বাহ্ন

এ ছাড়া বিভিন্ন সরকারী প্রতিষ্ঠানে সঞ্চয় পত্রের পরিবর্তে ব্যাংক গ্যারান্টি নেওয়াও একটি কারণ।

মোঃ আজিজুল হক
১ জুলাই ২০২৪, সোমবার, ৮:৩৬ পূর্বাহ্ন

শেষের পাতা থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

   

শেষের পাতা সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status