ঢাকা, ২৯ মার্চ ২০২৪, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিঃ

প্রথম পাতা

একটি চক্র আগে থেকেই ক্ষুব্ধ ছিল স্বপন কুমারের ওপর

নড়াইল প্রতিনিধি
১ জুলাই ২০২২, শুক্রবার
mzamin

নড়াইলের মির্জাপুর ইউনাইটেড ডিগ্রি কলেজে শিক্ষকদের মধ্যে দু’টি গ্রুপ সক্রিয়। এছাড়া অধ্যক্ষ হওয়া নিয়ে নানা কূটচাল চলে আসছিল অনেক  আগে থেকে। ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসকে অপসারণের নানা চেষ্টা ছিল অব্যাহত। ছাত্র রাহুল দেব রায়’র ফেসবুক স্ট্যাটাস যেন তাদের সেই সুযোগ এনে দেয়। ভারতের নূপুর শর্মাকে নিয়ে স্ট্যাটাস দেয়ার পরই একটি গ্রুপ ফায়দা নিতে চায়। তারা কিছু শিক্ষার্থীদের উসকে দেয়। ক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের শারীরিক ও মানসিকভাবে লাঞ্ছিত করা, মোটরসাইকেল ভাঙচুর ও পুড়িয়ে দেয়। ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাস দ্রুত রাহুল দেবকে পুলিশের হাতে তুলে দেয়। কিন্তু প্রতিপক্ষ গুজব ছড়ায় অধ্যক্ষ রাহুল দেবকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। এ গুজবে কান দিয়ে ঘটে অমানবিক ঘটনা।

বিজ্ঞাপন
কিন্তু নেপথ্যে ওই চক্রটি ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের চেয়ার দখল করে মোটা অঙ্কের নিয়োগ বাণিজ্য করতে অনেক আগে থেকেই কাজ করে আসছিল। নানা ধরনের কূটকৌশল করে আসছিল তারা। যার শেষ পরিণতি ছিল এ ঘটনা।  শুধু তাই নয়, ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষকে সরাতে ইতিপূর্বে অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা ও তদন্ত কমিটি ২০০৪ সালের ১লা নভেম্বর থেকে ২০১৩ সালের ৩০শে অক্টোবর পর্যন্ত হিসাব নিরীক্ষিত ও জিবি’তে অনুমোদিত হওয়া সত্ত্বেও পুনরায় ওই সময়ের হিসাব উদ্দেশ্যমূলকভাবে সম্প্রতি নিরীক্ষা ও তদন্ত করা হয়েছে।  সাবেক ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ অরুণ কুমার মণ্ডল ও বর্তমান ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসকে এ নিরীক্ষা ও তদন্তে ফাঁসানোর চেষ্টা চলছে। 

এ দু’জন সিনিয়র শিক্ষককে আর্থিক অনিয়মে ফেলে তাদেরকে ভবিষ্যতে অধ্যক্ষ পদে আবেদনের অযোগ্য করাই লক্ষ্য। সেই সঙ্গে তাদের কেউ যাতে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ পদে থাকতে না পারেন, সেই ব্যবস্থা করা হচ্ছে। ইতিপূর্বে সহকারি অধ্যাপক (হিসাব বিজ্ঞান) অরুণ কুমার মণ্ডল এ কলেজে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ছিলেন। কলেজে জাতীয় দিবস একুশে ফেব্রুয়ারি পালন হয়নি- এমন মিথ্যা অভিযোগ তুলে চক্র তাকে ওই পদ থেকে অপসারণ করে জুনিয়র প্রভাষক আকতার হোসেনকে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ করেন। অথচ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধিতে প্রভাষক আকতার হোসেনের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। ২০২০ সালের শেষদিকে নড়াইল সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কলেজের সভাপতি হন। বিধি বহির্ভূতভাবে প্রভাষক আকতার হোসেন ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ পদে থাকায় ২০২১ সালের ২৭শে এপ্রিল তিনি তাকে ওই পদ হতে অপসারণ করে মোস্ট সিনিয়র স্বপন কুমার বিশ্বাসকে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ করেন। এরপর এডভোকেট অচিন কুমার চক্রবর্তী কলেজের সভাপতি হওয়ার পর গুঞ্জন ওঠে সহকারী অধ্যাপক (দর্শন) স্বপন কুমার বিশ্বাসকে অপসারণ করে আবারো ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ করা হবে প্রভাষক আকতার হোসেনকে। ২০২১ সালের ১৫ই আগস্ট জাতীয় শোক দিবস পালনের ব্যানার চুরি হয় কলেজ থেকে। 

নড়াইল সদর থানায় জিডি করেন ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাস। অদৃশ্য কারণে সেই জিডির কোনো অগ্রগতি হয়নি। এরপর নাটকীয়ভাবে ২০০৪ সালের ১লা নভেম্বর হতে ২০১৫ সালের ১৬ই এপ্রিল পর্যন্ত অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা ও তদন্ত দেয়া হয়। সভাপতি এডভোকেট অচিন কুমার চক্রবর্তী নিজেই এ কমিটির আহ্বায়ক হন। তদন্তে আর্থিক অনিয়মে দায়ী করেন সহকারী অধ্যাপক অরুণ কুমার মণ্ডল (অতীতে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেছেন) ও ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসকে। এমনকি কারণ দর্শানোর নোটিশ দেন। তারা নোটিশের জবাব দেয়ার পর অডিট পর্যালোচনা চলছে প্রায় ৬ মাস যাবত। কিন্তু কোনো সুরাহা করা হচ্ছে না। ইতিপূর্বে এ সময়কার অডিট হয়ে জিবিতে অনুমোদিত হয়েছে সর্বসম্মতিক্রমে। তারপরও তাদেরকে হেনস্থা করার জন্য এ অডিট দেয়া হয়েছে। এরই মধ্যে কলেজের প্রথমবর্ষের ছাত্র রাহুলের গত ১৭ই জুন আপত্তিকর ফেসবুক পোস্ট নিয়ে ১৮ই জুন উত্তাল হয়ে উঠে কলেজ। অতি উসাহী কিছু মানুষ ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক মিথ্যা গুজব ছড়িয়ে দেয়। কলেজে এসে উত্তেজিত জনগণ বিক্ষোভ করতে থাকে। 

তারা রাহুলের বিচারের দাবি অপেক্ষা ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের বিচারের দাবিতে সোচ্চার হয়ে ওঠে। কলেজের বাংলা বিভাগের শিক্ষক শ্যামল কুমার ঘোষকে বেদম মারধর করে রক্তাক্ত করে। সহকারী অধ্যাপক (পরিসংখ্যান) প্রশান্ত রায়, সহকারী অধ্যাপক (সাবেক ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ) অরুণ কুমার মণ্ডল ও ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসের মোটরসাইকেল ভাঙচুর করে পুড়িয়ে দেয়। ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষকে চরম অসম্মান ও অমর্যাদাকর অবস্থায় জুতার মালা পরিয়ে দেয় দুষ্ট চক্র। এরপর ছাত্র রাহুলের সঙ্গে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষকে উদ্ধার করে নিয়ে যান প্রশাসন। সূত্র জানিয়েছে, ইতিপূর্বে কলেজ কর্তৃপক্ষ অধ্যক্ষ পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিলে সাবেক ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ অরুণ কুমার মণ্ডল, সহকারী অধ্যাপক শ্যামল কুমার ঘোষ (বাংলা), প্রভাষক আকিদুল ইসলাম ও আকতার হোসেনসহ আরও কয়েকজন আবেদন করেন। অধ্যক্ষ পদে আবেদন করায় সহকারী অধ্যাপক অরুণ মণ্ডলের ওপর ক্ষিপ্ত হয় ওই স্বার্থান্বেষী চক্র। তাকে নানাভাবে হয়রানি ও নাজেহাল করার চেষ্টা চলছে সেই সময় থেকে।  এদিকে গত ১৯শে জুন সকালে নড়াইল-১ আসনের সংসদ সদস্য কবিরুল হক মুক্তি কলেজে শান্তি সভা করেন। সভায় কলেজের সভাপতি অচিন কুমার চক্রবর্তী অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন।

 সেই সঙ্গে কলেজের শিক্ষকদের মোটরসাইকেল ভাঙচুর করা ও পোড়ানো, শিক্ষকদের লাঞ্ছিত করা ও মারপিটের ঘটনায় কোনো মামলা করবেন না বলে ঘোষণা দেন। শান্তি সভা শুরুর পূর্ব মুহূর্তে কলেজের জিবি’র সভাপতি অচিন চক্রবর্তীকে উদ্দেশ্য করে ‘অচিনের দুই গালে জুতো মারো তালে তালে’ স্লোগান হয়। শান্তি সভায় বক্তব্যে এলাকার ফয়সাল হোসেন সভাপতি এডভোকেট অচিন চক্রবর্তীর অপসারণ দাবি করেন। সংসদ সদস্য কবিরুল হক মুক্তি সকল শ্রেণি-পেশার মানুষকে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখার অনুরোধ করেন। উপস্থিত সকলে শান্তিপূর্ণ সহবস্থানে থাকার প্রতিশ্রুতি দেন।  গত ২১শে জুন ৭ জন শিক্ষক কলেজের সভাপতি অচিন চক্রবর্তীর সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে তাদের জীবনের নিরাপত্তাহীনতার কথা বলেন। এ সময় তিনি তাদের বলেন মারাত্মক আহত শ্যামল কুমার বিশ্বাস (বাংলা) ও অধ্যক্ষ (ভারপ্রাপ্ত) স্বপন কুমার বিশ্বাসের নিকট থেকে এক মাসের ছুটির আবেদন এনে দাও, তারা ছুটিতে থাকুক। সেই সঙ্গে অধ্যক্ষ (ভারপ্রাপ্ত) স্বপন কুমার বিশ্বাসের নিকট হতে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ পদের পদত্যাগ পত্র এনে দিতে বলেন। এদিকে ১৮ই জুন দীর্ঘ সময় ধরে কলেজে তাণ্ডব চালানোর খণ্ড চিত্র ও বেশ কিছু ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে সর্বমহলে সমালোচনার ঝড় উঠে। 

অধ্যক্ষ (ভারপ্রাপ্ত)কে লাঞ্ছিতের সঙ্গে জড়িতদের গ্রেপ্তারের দাবি ওঠে। অধ্যক্ষ (ভারপ্রাপ্ত)কে লাঞ্ছিতের সঙ্গে জড়িতদের কেউ কেউ রাজনৈতিক ছত্র ছায়ায় থেকে গ্রেপ্তার এড়ানোর চেষ্টায় আছেন। ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাস বলেন, তিনি ষড়যন্ত্রের শিকার। অহেতুক তার বিরূদ্ধে মিথ্যা অপপ্রচার করে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করা হচ্ছে। তিনি এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত দাবি করেন। এলাকার সচেতন মহল রাহুলের বিচার দাবি করেছেন। সেই সাথে উস্কানি দিয়ে কলেজ এলাকায় নৈরাজ্য সৃষ্টি, ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষকে জুতার মালা দেয়া ও নাশকতার সঙ্গে জড়িত সকল অপরাধীর গ্রেপ্তার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করেছেন। পুলিশ সুপার প্রবীর কুমার রায় বলেন,তদন্ত চলছে। প্রকৃত অপরাধীদের সনাক্ত করে আইনের আওতায় আনা হবে। আসামি ৪ জন গ্রেপ্তার হয়েছে। অন্যদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।

প্রথম পাতা থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

   

প্রথম পাতা সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status