ঢাকা, ২৩ এপ্রিল ২০২৫, বুধবার, ১০ বৈশাখ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ২৩ শাওয়াল ১৪৪৬ হিঃ

প্রথম পাতা

অমর একুশে ও ‘তাহাদের কথা’

ড. মাহফুজ পারভেজ
২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, বুধবার

বাংলা ভাষার জয়ধ্বনিতে মুখর অমর একুশে ফেব্রুয়ারিতে আমরা ‘তাহাদের কথা’ বিস্মৃত হই! তারা হলেন- বাংলাদেশের ক্ষুদ্র জাতিসত্তাসমূহ। বাংলার সমান্তরালে তাদের রয়েছে নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি, আত্মপরিচিতি। বাংলাদেশের মূলস্রোতের জনগোষ্ঠী বাঙালি। কিন্তু দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীর অনেক মানুষের বসবাস। বিশেষত পাহাড়ে এবং সমতলের কয়েকটি এলাকায় তাদের বসতিগুলো সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের পরিচায়ক। বাংলাদেশে ৫০টি এরকম ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী রয়েছে, যারা প্রায় ৩৮টি ভাষায় কথা বলে।

নৃতাত্ত্বিক গবেষণার ভিত্তিতে জানা যায় যে, বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাসকারী সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীর ভাষা ও সংস্কৃতির ভিন্নতার পাশাপাশি রয়েছে নিজস্ব স্বকীয়তা। তবে, আশঙ্কাজনক তথ্য হলো এই যে, সংখ্যালঘু ও প্রান্তিক ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষা হুমকির মুখে। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আইন-২০১০ এর সংশোধনী তফসিল অনুসারে ২০১৮ সালে সম্পাদিত আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের নৃভাষা বৈজ্ঞানিক সমীক্ষা অনুসারে দেশে প্রায় ৪১টি ভাষা রয়েছে, যার মধ্য থেকে বাংলা, ইংরেজি ও উর্দু ভাষা বাদ দিলে ৩৮টিই দেশের বিভিন্ন ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর ভাষা। এই সমীক্ষা অনুসারে দেশের ১৪টি ভাষা বিপন্নতার শেষ সীমায় অবস্থান করছে।

ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষা যে কেবল বাংলাদেশ বা দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে সঙ্কুচিত হচ্ছে, তা নয়। পুরো বিশ্বের জন্যেই সমস্যাটি প্রকট। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, পৃথিবীর ৭টি মহাদেশের ৭০টি দেশে প্রায় ৩০০ মিলিয়ন ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর বসবাস রয়েছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ একাংশ, প্রায় ১৫০ মিলিয়ন, বসবাস করে এশিয়া মহাদেশের বিভিন্ন দেশে। যেমন: বাংলাদেশ, মিয়ানমার, চীন, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, জাপান, মালয়েশিয়া, পাকিস্তান, ফিলিপাইন, শ্রীলঙ্কা এবং থাইল্যান্ড। প্রায় ৩০ মিলিয়ন জাতিগত সংখ্যালঘুদের বসবাস ল্যাটিন আমেরিকায়। বলিভিয়া, গুয়াতেমালা ও পেরুর মোট জনসংখ্যার অর্ধেকেরও বেশি হচ্ছে বিভিন্ন সংখ্যালঘু নৃগোষ্ঠীর জনগণ।

বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে থাকা জাতিগত সংখ্যালঘুদের রয়েছে স্বতন্ত্র ভাষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, জীবন-জীবিকার নিজস্বতা, ধর্ম এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানের কাঠামো। ঐতিহ্যগত জীবন পদ্ধতি ধারণ করে মূলত নিজেদের মৌলিক পরিচিতিটাকে বজায় রাখতে চায়। কিন্তু নানা কারণে নিজেদের স্বতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্য রক্ষা করতে পারছে না তারা। ক্রমশ তারা সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক দিক দিয়ে পিছিয়ে যাচ্ছে। রাজনৈতিক অধিকার, অংশগ্রহণ ও ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রেও তারা পশ্চাৎপদ ও কোণঠাসা। অনেক ক্ষেত্রেই তারা বৈষম্য, দারিদ্র, শোষণ, বেকারত্ব প্রভৃতির শিকার। তাদের ভূমি ও সম্পদ, বনায়ন, খনি, বাঁধ, সড়ক নির্মাণ, রাসায়নিক বর্জ্য নিষ্কাশন, পারমাণবিক পরীক্ষা, সেচ প্রকল্প প্রভৃতি ক্ষতিকারক উন্নয়ন কাজের কারণে হুমকির সম্মুখীন।

যদিও ক্ষুদ্র জাতিসত্তার সদস্যরা স্মরণাতীতকাল থেকে বিশ্বের বিভিন্ন অংশে বসবাস করে আসছে এবং তারা যুগ যুগ ধরে নিজস্ব সমৃদ্ধ সমাজ, সংস্কৃতি, রীতিনীতি, ধর্ম-ভাষা ও নৃতাত্ত্বিক পরিচিতিতে সমৃদ্ধ, তথাপি সাংস্কৃতিক আগ্রাসন ও রাজনৈতিক চাপের কারণে তারা বিপন্ন। বিশেষ করে, তাদের ভাষা ও সংস্কৃতি ভীষণভাবে আক্রান্ত। যে কারণে জাতিসংঘের পক্ষে তাদের ভাষাসমূহের পুনরুজ্জীবন, সুরক্ষা, বিকাশ ও প্রসারে উদ্দেশ্যে ২০১৯ সালকে তাদের ভাষাবর্ষ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। পৃথিবীব্যাপী বিলুপ্তপ্রায় ক্ষুদ্র জাতিগুলোর ভাষা সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও জনসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে এবং সেই সঙ্গে ভাষাগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে সুসম্পর্ক সৃষ্টি, সমঝোতা ও শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পুরো ২০১৯ সালই জাতিসংঘ নানা কর্মসূচির ভিত্তিতে কাজ করে। 

জাতিসংঘ যখন ‘আন্তর্জাতিক বর্ষ’ হিসেবে কোনো বিশেষ বছরকে ঘোষণা করে, তখন সে বিষয়কে ঘিরে সেই বছরটিতে নানা উদ্‌যাপনের মধ্যদিয়ে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করা হয়। প্রতিপাদ্য সেই বিষয়কে বৈশ্বিক ভাবনা এবং বিশ্বের সংশ্লিষ্ট সবার সমন্বিত কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে বিবেচিত হয়। যেমন, ভাষাবর্ষের কার্যক্রম চলাকালেই ২০১৯ সালেই ২০২২ থেকে ২০৩২ সময়কালকে ‘আন্তর্জাতিক ভাষা দশক’ ঘোষণা করা হয়। এই দশককে ঘিরে বিশ্বের বিভিন্ন ক্ষুদ্র জাতিসত্তা আবারো স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে, নতুন উদ্যমে জেগে উঠবে তাদের ভাষা, সম্প্রসারিত হবে তাদের সাহিত্য ও সংস্কৃতি। 
বাংলাদেশেও কিছু ইতিবাচক প্রভাব লক্ষ্য করা গিয়েছে। তাদের ভাষায় পাঠদান ও পাঠ্যপুস্তক রচনার মতো যুগান্তকারী ঘটনা ঘটেছে। আর এবারের বইমেলায় প্রকাশিত এক কাব্যগ্রন্থে প্রথমবারের মতো বাঙালি কাব্য চেতনায় ক্ষুদ্র জনজাতি মারমাদের নৃ-প্রপঞ্চ উপস্থাপন করেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক, কবি ও কথাশিল্পী ড. মহীবুল আজিজ। তার ‘গঙখাঙ রেগেখ্যঙ’ কাব্যগ্রন্থে পাহাড়ের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষদের জীবন, সমাজ ও সংস্কৃতির যে স্বাতস্ত্র্য কিংবা তাদের জীবনের অভাব, দীনতা বা চাহিদা ইত্যাদি নিয়ে আমাদের অনাগ্রহের অবসান প্রত্যাশা করা হয়েছে। গ্রন্থটির নামের সহজ অর্থ হলো- আকাশ ও শঙ্খনদী। রেগে অর্থাৎ বৃহৎ/বড় খ্যঙ মানে নদী বড় নদী, মারমাদের নিকটে শঙ্খ হলো বড় নদী রেগেখ্যঙ। আর ছোট নদী মানে রিনিখ্যঙ।

এ প্রসঙ্গে দীর্ঘ আলাপচারিতায় মহীবুল আজিজ আমাকে যা জানিয়েছেন, তা বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন, আমরা পাহাড়কে ততটাই ভালোবাসি, যতটা পাহাড় আমাদের ক্ষণকালীন আনন্দের জন্য আরামের জন্য প্রয়োজন। পাহাড় কেবল প্রকৃতিই নয়, অরণ্যঘেরা সৌন্দর্যকেন্দ্রই নয়, সেখানেও জীবন আছে যে-জীবন শত-শত বছরের অবিরাম চক্রায়ণের মধ্যদিয়ে আজও প্রবহমান। সে-জীবন আমরা চাই বা না-চাই, বদলেছেও যথেষ্ট। কিন্তু সেই প্রবহমানতা সেই বিবর্তনের ব্যাকরণ কি আমরা পাঠে আগ্রহী, এইসব প্রশ্নই আমার মধ্যে ঘুরপাক খায় কিন্তু আমি একজন অতি সাধারণ মানুষ, যার সেরকম কোনো ক্ষমতা নেই কিন্তু হ্যাঁ, আমার শব্দের সাম্রাজ্যের সৃষ্টিকর্তা তো আমিই। তাই ভাবলাম আমার একজনের প্রচেষ্টার মধ্যে, হোক সে সংখ্যায় ন্যূনতমই, তবু সেই একক প্রচেষ্টার আয়তনে দুই মেরুর দূরত্বকে কিছুটা সময়ের জন্য ঘুচিয়ে দিয়ে পাশাপাশি আনা যাকই না কেন। পাশাপাশিই তো আমরা। দীর্ঘকালের ইতিহাস আমাদের এই প্রতিবেশিত্বের। প্রতিবেশীরাই তো পরস্পর পরস্পরের নিকটজন। কাজেই নৈকট্যকে আত্মস্থ করবার একটা দায়ও তো থেকে যায়।

ড. মহীবুল আজিজ বলেন, বান্দরবানে যাওয়া-আসার মাধ্যমে সেখানকার মানুষদের কথাবার্তার ধরনধারণ দেখে-বুঝে এবং খানিকটা বিচার বিশ্লেষণ করে যে অভিজ্ঞতা হয়েছে, তার ভিত্তিতে বলা যায়, বান্দরবানে মারমা ছাড়াও আরও নৃ-গোষ্ঠীর মানুষের বসবাস এবং প্রত্যেকেরই রয়েছে স্বতন্ত্র প্রণালী ও প্রকাশ। যেমন, অবয়বগত বিচারে মারমা বর্ণ মিয়ানমারি ভাষার বর্ণের আদলের সঙ্গে মেলে। আবার কখনো কখনো মনে হয়, দেখতে মারমা বর্ণ তামিল, তেলেগু, কন্নড়ি এইসব বর্ণের মতোই। তবে মারমা ভাষার বর্ণ সেগুলোর চাইতে খানিকটা পরে এসে সুনির্দিষ্ট লিখিত রূপ পেতে শুরু করে। একাদশ-দ্বাদশ শতকের দিকে মারমা বর্ণমালার প্রাচীন রূপটি গড়ে উঠেছিল। মারমা ভাষায় রয়েছে, ৩৩টি ব্যঞ্জনবর্ণ, ৪টি মৌলিক যুক্ত ব্যঞ্জনধ্বনি, ১২টি স্বরবর্ণ এবং ১০টি স্বরধ্বনি বিলুপ্তকারী ব্যঞ্জনবর্ণ।

তার মতে, মারমা ভাষার উৎস কিন্তু বাংলার মতোই ব্রাহ্মী লিপি। বাংলার মতোই স্পৃষ্ট ও নাসিক্য ধ্বনির স্বাতন্ত্র্য মারমা ভাষায় সুস্পষ্ট। বর্গীয় বর্ণবিচারে বাংলা ও মারমার মধ্যে সাদৃশ্য যথেষ্ট। ‘ক’ ব্যঞ্জববর্ণ বাংলার মতোই মগ, মারমা, রাখাইন এবং বার্মিজ বর্ণমালার প্রথম বর্ণ। অনুস্বার এবং বিসর্গ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বর্ণ মারমা ভাষায়। মাং মানে এবং যা অব্যয়, কিন্তু মাং মানে আবার রাজাও। মাংগ্রী মানে জ্যাঠা বা বড় মামা। মাংক্যোয়েঁ মানে গৃহকর্তা। মাংক্যোয়েমাঁ-র অর্থ গৃহকর্তার স্ত্রী বা গৃহকর্ত্রী।

এ ছাড়া ঞ, ফ, চ, ছ, হ্ল, থ, চ্ব, ত্ব এসব বর্ণ মারমা ভাষায় প্রভাবক ভূমিকা রাখে। স্বরের ক্ষেত্রে বলা যায়, চিনা ভাষায় যেমন বর্ণে প্রযুক্ত উচ্চ ও দীর্ঘ স্বর শব্দের অর্থের তারতম্য ঘটায়। মারমা ভাষাতেও সেরকম ব্যাপার লক্ষ্য করা যায়। চিনা ‘চা’ (হ্রস্ব স্বর) মানে হলো, একটি পানীয় যা আমরা পান করি। আবার ‘চাআআ’ (স্বরবর্ণের প্রলম্বনযুক্ত) মানে হলো গাড়ি, অর্থাৎ মূল ব্যঞ্জন অবিকৃত রেখে কেবল স্বরের হ্রস্ব ও দীর্ঘত্বের দ্বারা শব্দার্থের পরিবর্তন করা হয়। মারমা ভাষাতেও হ্রস্ব ও দীর্ঘস্বরের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। ব্যাকরণগত দিক থেকে বলা যায়, লিখিত বাংলা এবং মারমা ভাষার গাঠনিক কাঠামো এক নয়। ভারতবর্ষের প্রায় সব প্রধান ভাষা পাণিনি’র ব্যাকরণানুসারী। কিন্তু মারমা ভাষা তা নয়। এতে বরং প্রাচীনতাবাহিত কথকতার ভঙ্গিটি আভাসিত।
কারক, বিভক্তি, বাক্যে পদের সংস্থাপন এসবের ক্ষেত্রে মারমা ভাষার স্বাতন্ত্র্য রয়েছে অবশ্যই। বিজ্ঞানসম্মতভাবে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষা বিষয়ক গবেষণা করা গেলে মারমা ও অন্যান্য ভাষার স্বরূপ উদ্ঘাটন সম্ভব। এটা হতে পারে যোগ্যতাসম্পন্ন ও বিষয় পারদর্শী মারমাভাষীদের দ্বারা কিংবা মারমা ও বাঙালির যৌথ গবেষণার মাধ্যমে। তখন হয়তো আরও অনেক নতুনদিক বা অজানা দিক জানা সম্ভব হবে আমাদের পক্ষে। শব্দের সংখ্যার বিচারে কিন্তু মারমা ভাষার সমৃদ্ধি অনস্বীকার্য। কাজেই এ বিষয়ে ভাষাতাত্ত্বিক গবেষণার সম্ভাবনা উজ্জ্বল।

লেখক: প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়; নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম সেন্টার ফর রিজিওনাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)।
 

প্রথম পাতা থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

প্রথম পাতা সর্বাধিক পঠিত

   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2025
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status