প্রথম পাতা
গ্রামীণ টেলিকম ও গ্রামীণ কল্যাণ যেভাবে দখলের চেষ্টা
নাইম হাসান ও জীবন আহমেদ
১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, বুধবারমিরপুরে গ্রামীণ কল্যাণের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কার্যালয়ে গ্রামীণ ব্যাংক কর্মকর্তাদের অবস্থান- ছবি: জীবন আহমেদ
রাজধানীর মিরপুরের চিড়িয়াখানা রোডে অবস্থিত গ্রামীণ টেলিকম ভবনে অবস্থিত দুটি প্রতিষ্ঠানের কার্যালয় দখল চেষ্টার অভিযোগ পাওয়া যায় গত সোমবার বিকালে। ওইদিন অন্তত ২০ জনের একটি দল এই দখল চেষ্টা চালায় বলে গ্রামীণ কল্যাণের কর্মীরা জানান। ‘গ্রামীণ কল্যাণ’ শান্তিতে নোবেল জয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রতিষ্ঠিত একটি সেবাধর্মী প্রতিষ্ঠান। এ ছাড়া একই ভবনে রয়েছে তার প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ টেলিকমসহ আরও সাতটি প্রতিষ্ঠানের কার্যালয়। গ্রামীণ কল্যাণ এবং গ্রামীণ টেলিকমের কার্যালয় দখল চেষ্টা হচ্ছে বলে ওই প্রতিষ্ঠান দু’টির কর্মীরা জানিয়েছেন। গতকাল সরজমিন গ্রামীণ কল্যাণ ও গ্রামীণ টেলিকমের অফিসে গিয়ে কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত সোমবার বিকাল ৪টায় গ্রামীণ ব্যাংক থেকে অন্তত ২০ জন এসে খুঁজছিলেন এই দু’টি প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে। ওই দুই কর্মকর্তা নিচে গেলে তাদের বলা হয়, গ্রামীণ ব্যাংকের বৈঠক চলছে। সেখান থেকে একটি চিঠি আসবে। সেই চিঠি আসার আগ পর্যন্ত সবাইকে অপেক্ষা করতে হবে। তবে রাত সাড়ে ৭টা পর্যন্ত অপেক্ষা করে কোনো চিঠি না আসায় তারা চলে যান। রাত ৯টায় গ্রামীণ ব্যাংকের চিঠি নিয়ে এসে কয়েকজন কর্মী ভবনের ফটকে তালা লাগিয়ে দেন।
এর ধারাবাহিকতায় গতকাল সকালে গ্রামীণ ব্যাংকের কয়েকজন কর্মকর্তা সকালে এসে তালা খুলে ভেতরে প্রবেশ করেন। তাদেরকে গ্রামীণ কল্যাণ ও গ্রামীণ টেলিকমের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কার্যালয়ে অবস্থান করতে দেখা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গ্রামীণ ব্যাংকের কর্মকর্তারা গ্রামীণ কল্যাণ ও গ্রামীণ টেলিকমের কর্মকর্তাদের জানিয়েছেন বোর্ড সভায় তাদের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। এখন থেকে তারা এখানে দায়িত্ব পালন করবেন। এরসঙ্গে বর্তমান কর্মকর্তারাও বহাল থাকবেন। মূলত গ্রামীণ কল্যাণ ও গ্রামীণ টেলিকমের কর্তৃত্ব গ্রামীণ ব্যাংকের হাতে নেয়ার প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবেই এমনটা করা হয়েছে। একই ভবনে অবস্থিত অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের কর্মীরাও এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়ার আশঙ্কা করছেন।
ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল গ্রামীণ কল্যাণের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ কে এম মইন চৌধুরী শাহ আলী থানায় একটি জিডি করেছেন। এতে তিনি গ্রামীণ টেলিকম ভবনে বহিরাগতদের প্রবেশ করায় কর্মীরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন।
মইন চৌধুরী মানবজমিনকে বলেন, গত সোমবার বিকালের দিকে কিছু বহিরাগত লোক আসেন। সব নিয়মনীতি উপেক্ষা করে তারা অফিসে প্রবেশ করেন। আমি নিচে এসে দেখি তারা ২০ জন বসে আছেন। এসে তারা বলেন- গ্রামীণ ব্যাংক থেকে এসেছেন। কেন এসেছেন জিজ্ঞেস করতে তারা বলেন- আপনাদের কোম্পানির চেয়ারম্যানকে অপসারণ করা হয়েছে। আর আপনাদের কিছু দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। আমাদের চাকরিজীবীদের তারা কোথাও যেতে দিচ্ছে না। সবাই ভীত সন্তস্ত্র হয়ে পড়েছিলাম। তারা কি কারণে এসেছে আমরা তখনও তা বুঝতে পারছিলাম না। তারা জানালো একটি চিঠি আসবে, এজন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। আমরা বললাম আইনের সহায়তা নিয়ে তো আপনারা আসতে পারতেন।
ঘটনার বর্ণনা দিয়ে গ্রামীণ টেলিকমের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাজমুল ইসলাম বলেন, আমি খবর পেলাম গ্রামীণ ব্যাংক থেকে লোকজন এসে আমাকে খুঁজছে। আমি নিচে গেলাম, গিয়ে কথা বললাম। তার মধ্যে আমি দুইজনকে চিনি। তারা বললেন, আজকে আমাদের একটি বোর্ডসভা হয়েছে। ওই বোর্ডসভায় সিদ্ধান্ত হয়েছে যে, চেয়ারম্যান ও দুইজন ডিরেক্টর আসছেন। আমরা একটু আগে চলে আসছি। আপনারা কেউ কোথাও যাবেন না। তারা আমাদের অফিসে থাকার জন্য অনুরোধ করলেন। আমরাও কোথাও যাইনি। এরপর আর চিঠিও আসেনি। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা বাজলে আমরা বের হয়ে যাই। ওই সময়ে আমি তাদেরকে বলি- আমাদের চুক্তিভিত্তিক একজন কর্মচারী আছে, তার কাছে চিঠি রেখে যান।
গতকাল গ্রামীণ ব্যাংকের উত্তরাঞ্চলের বিভাগীয় প্রধান ফয়জুল হকসহ আরও দু’জন স্টাফ আসেন গ্রামীণ টেলিকম ভবনে। তারা গ্রামীণ কল্যাণ ও গ্রামীণ টেলিকমের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের সঙ্গে কথা বলেন। একসঙ্গে কাজ করার কথা উল্লেখ করে তারা জানান, ম্যানেজমেন্ট পরিবর্তন করা হয়েছে। এ বিষয়ে গ্রামীণ টেলিকমের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাজমুল ইসলাম বলেন, তারা বলেছে- আমাদেরকে পাঠানো হয়েছে। আমরা মিলেমিশে কাজ করবো। এখানে আমরা থাকবো-আসবো। আপনারা সবাই থাকবেন।
গ্রামীণ ব্যাংক প্রেরিত একটি চিঠি মানবজমিনের হাতে এসেছে। চিঠিতে গ্রামীণ ব্যাংকের সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার মো. গোলাম জাকারিয়া রহমানকে গ্রামীণ টেলিকমের পরিচালকের দায়িত্ব দেয়া হয়। সেখানে বলা হয়, ‘গ্রামীণ টেলিকমের আর্টিকেল অব এসোসিয়েশনের ৩৫ (৩) ধারা মোতাবেক গ্রামীণ ব্যাংক পরিচালনামণ্ডলীর ১৫৫তম সভার প্রদত্ত ক্ষমতাবলে আপনাকে ফেব্রুয়ারি ১২, ২০২৪ তারিখ হতে গ্রামীণ টেলিকমের পরিচালক হিসেবে মনোনীত করা হলো।
কি কারণে গ্রামীণ ব্যাংক থেকে পরিচালক নিয়োগ দেয়া হলো- এমন প্রশ্নের জবাবে গ্রামীণ টেলিকমের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাজমুল ইসলাম বলেন, বোর্ড অব ডিরেক্টর পরিবর্তনের চিঠি দিয়েছে তারা। আমরা আর্টিকেলের যে পরিবর্তন করেছিলাম, উনারা বলছে সেটি ঠিক হয়নি। উনারা নমিনেশন পাঠিয়েছেন, ‘গ্রামীণ ব্যাংকের চেয়ারম্যান হবে গ্রামীণ টেলিকমের চেয়ারম্যান।’ এই বিধানটা আগে ছিল। কোম্পানি বড় হওয়ার সঙ্গে এগুলো পরিবর্তন হয়েছে। পরিবর্তনটা তারা গ্রহণ করছে না। তারা বলছে, এটা কোনো লিগ্যাল ওয়ে না। শুরুতে গ্রামীণ টেলিকমের আর্টিকেল অব এসোসিয়েশনের ধারা এমনটা ছিল উল্লেখ করে তিনি বলেন, ওই ধারাতে ওদের নোমিনেটেড তিনজন ডিরেক্টর থাকবে। গ্রামীণ ব্যাংকের চেয়ারম্যান হবে গ্রামীণ টেলিকমের চেয়ারম্যান। ২০০৯ সালে এটি পরিবর্তন হয়েছে। এরপর তারা কোনো কথা বলেনি। ডিরেক্টর আমাদের কোনো চিঠি বা কোনো মাধ্যমে জানায়নি। আমরাও এভাবে প্রতিষ্ঠান চালিয়ে আসছিলাম।
গ্রামীণ টেলিকম ভবনে শান্তিতে নোবেলজয়ী প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস প্রতিষ্ঠিত সেবাধর্মী ৯টি প্রতিষ্ঠান আছে। প্রতিষ্ঠনগুলো হলো- গ্রামীণ টেলিকম, গ্রামীণ কল্যাণ, গ্রামীণ মৎস্য ও পশু সম্পদ ফাউন্ডেশন, গ্রামীণ কৃষি ফাউন্ডেশন, গ্রামীণ সামগ্রী, গ্রামীণ ফান্ড, গ্রামীণ শক্তি, গ্রামীণ কমিউনিকেশন। বাকিগুলো লিমিটেড কোম্পানি। গ্রামীণ ব্যাংকের সম্পৃক্ততা রয়েছে এমন ২টি প্রতিষ্ঠানে চিঠি দেয়া হয়েছে। বাকিগুলো এখনো তাদের মতো কাজ করছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এই দু’টি প্রতিষ্ঠানে দায়িত্বরত কর্মীরা বলছেন, গ্রামীণ টেলিকম ও গ্রামীণ কল্যাণের মাধ্যমে তারা কর্তৃত্ব নেয়া শুরু করেছে। বাকি ৭টা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। বাকিগুলো পর্যায়ক্রমে নিয়ন্ত্রণে নেবে তারা।
সার্বিক বিষয়ে গ্রামীণ কল্যাণের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মইন চৌধুরী বলেন, আমার এমপ্লয়িকে রক্ষা করা একজন এমডি হিসেবে আমার দায়িত্ব। আমরা চাই পূর্বে যে অবস্থায় কাজ করছিলাম সেভাবে আমাদের ফেরত দেয়া হোক। ৭০ লাখ গরিব মানুষের চিকিৎসা সেবা আমরা দেই। আমরা চাই দেশের হতদরিদ্র মানুষ যেন আর কষ্টে না থাকে। ড. ইউনুস সবসময় তাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন।
ওদিকে গ্রামীণ টেলিকম ভবনে অবস্থিত প্রতিষ্ঠান দখলের অভিযোগের বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে গ্রামীণ ব্যাংক কর্তৃপক্ষ সরাসরি কোনো বক্তব্য দেয়নি। রাতে মানবজমিন-এ পাঠানো একটি প্রতিবাদপত্রে তারা আগের দিন প্রকাশিত সংবাদের প্রতিবাদ জানান। ব্যাংকের ভারপ্রাপ্ত সচিব মো. মামুনুর রশিদের পাঠানো পত্রে বলা হয়, প্রকৃত সত্য হচ্ছে, গ্রামীণ ব্যাংকের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ অর্থায়নে বা সহযোগিতায় প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানসমূহ যেমন- গ্রামীণ কল্যাণ, গ্রামীণ টেলিকম, গ্রামীণ ফান্ড, গ্রামীণ মৎস্য ফাউন্ডেশন, গ্রামীণ উদ্যোগ, গ্রামীণ সামগ্রী ও গ্রামীণ শক্তি নামক প্রতিষ্ঠানসমূহে গ্রামীণ ব্যাংকের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠায় চেয়ারম্যান ও পরিচালক পদে মনোনয়ন দেয়ার লক্ষ্যে গ্রামীণ ব্যাংকের ১৫৫তম বোর্ড সভায় গৃহীত সিদ্ধান্ত মোতাবেক যথাযথ আইনি বিধি অনুসরণ করে গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিচালকগণকে চিঠি হস্তান্তর করতে গ্রামীণ ব্যাংকের পক্ষ থেকে কয়েকজনের একটি প্রতিনিধিদল গ্রামীণ টেলিকম ট্রাস্ট ভবনে গিয়েছিলেন। দখল চেষ্টার অভিযোগ সত্য নয় বলেও প্রতিবাদপত্রে উল্লেখ করা হয়।
চমৎকার খেলা চলছে।অভিজ্ঞতা অর্জনের ভালো সুযোগ রয়েছে।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর গড়া প্রতিষ্ঠানগুলো যেভাবে একে একে কুক্ষিগত করা হয়েছে তেমনিভাবে ডক্টর ইউনুসের প্রতিষ্ঠানগুলোও কুক্ষিগত করা হবে ইনশাআল্লাহ। ভবিষ্যতেও এই প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখবে বলে আশা করা যায়। যারাই এদেশের জন্য কর্মসংস্থান থেকে শুরু করে দেশের অবকাঠামো গড়ে তুলবে তাদের জন্য সতর্কবাণী। মূলত আওয়ামী লীগ বিরোধীরা এই দেশে কোনো কিছুই করতে পারবে না। করলেও তা এভাবে কুক্ষিগত করা হবে ইনশাআল্লাহ।