প্রথম পাতা
মাহেন্দ্রক্ষণের অপেক্ষা
লুৎফর রহমান
২৪ জুন ২০২২, শুক্রবার
বছর, মাস, দিন শেষে এখন মাত্র কয়েক ঘণ্টার অপেক্ষা। পুরো জাতির স্বপ্নের সেতুর দ্বার উন্মোচনের সেই মাহেন্দ্রক্ষণের অপেক্ষায় দেশ। জাতির সাহস আর সামর্থ্যের প্রতীক পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের অপেক্ষার প্রহর শেষ হবে রাত পোহালেই। খরস্রোতা প্রমত্তা পদ্মা জয়ের গল্পটির যবনিকাপাত হবে শনিবার সকালে। শুরু হবে সমৃদ্ধি আর বদলে যাওয়ার দ্বিতীয় এক আখ্যানের। সাড়ে ছয় বছরের নির্মাণ বুননে পদ্মার দুই পাড় এক করে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে স্বপ্নের এই সেতু। দেশের ইতিহাসে সম্পন্ন হওয়া সবচেয়ে বড় এই নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে পুরো নিজস্ব অর্থে। বিদেশি উন্নয়ন সহযোগীদের কোনো ধরনের ঋণ ছাড়াই বাস্তবায়ন করা এই প্রকল্প উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে শনিবার রচিত হবে নতুন এক ইসিহাস। পদ্মার বুকে সেতু গড়ে উন্নয়ন সহযোগীদের অর্থ ছাড়া বড় প্রকল্প বাস্তবায়নে বিশ্বের কাছে নিজের সক্ষমতা তুলে ধরেছে বাংলাদেশ। পদ্মার স্বপ্ন জয়ের সফল গল্প হাতছানি দিচ্ছে সামনে এমন আরও বড় প্রকল্পে নিজেদের সক্ষমতা জানান দেয়ার।
২০১৫ সনের ১২ই ডিসেম্বর পদ্মার বুকে স্বপ্নমালা গাঁথার কাজটি শুরু হয়েছিল।
১৮ দশমিক ১০ মিটার প্রস্থের এই সেতু শনিবার খুলে দেয়ার মধ্য দিয়ে দেশের নির্মাণ ও যোগাযোগের ইতিহাসে যুক্ত হবে নতুন এক মাত্রা। এটি যোগাযোগ অর্থনীতিতেও হবে নবতর এক সংযোজন। এই এক সেতু মোট দেশজ উৎপাদন এক শতাংশের বেশি বাড়িয়ে দেবে বলে মনে করছেন অর্থনীতির বোদ্ধারা। এই বহুমুখী সেতু মাওয়া-জাজিরা পয়েন্ট দিয়ে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অংশের সরাসরি সংযোগ করিডোর তৈরি করছে। বলা হচ্ছে, এই প্রকল্পটির ফলে প্রত্যক্ষভাবে প্রায় ৪৪,০০০ বর্গ কিলোমিটার (১৭,০০০ বর্গ মাইল) বা বাংলাদেশের মোট এলাকার ২৯ ভাগ অঞ্চলের মানুষ উপকৃত হবে। সরাসরি ২১টি জেলার মানুষ এই সেতুর সুফল পাবে। পরোক্ষভাবে এটি পুরো দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আনবে। ঘুচিয়ে আনবে দক্ষিণ-পশ্চিমের সঙ্গে পুরো দেশের দূরত্ব। রাজধানীর জনচাপ কমাতেও এই সেতু হতে পারে বড় এক সহায়ক। দক্ষিণ পশ্চিমের জেলায় অর্থনৈতিক জাগরণ, কৃষির বিপ্লব আর সম্ভাবনার মৎস্য পর্যটন খাতে নতুন দিনের সূচনা করবে এই পদ্মা বহুমুখী সেতু। স্টিল আর কংক্রিটে তৈরি দ্বিতল সেতুর নিচ তলা দিয়ে চলবে ট্রেন।
আর উপরের কংক্রিট স্লাবের ওপর দিয়ে যাবে যানবাহন। নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে ‘পদ্মা সেতু’ এখন একটি গৌরবের নাম। ২০০৬-২০০৭ অর্থবছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে যুক্ত হওয়া পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে মোকাবিলা করতে হয়েছে নানা ঘাত-প্রতিঘাত। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন নাটকে অনেকটা জটিল হয়ে পড়া এই প্রকল্প বাস্তবায়ন সামনে এগিয়েছে সাহসী এক নেতৃত্বের কারণে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দৃঢ়তার সঙ্গে নিজস্ব অর্থায়নে এই সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নের ঘোষণা দিয়েছিলেন। তখন পুরো প্রকল্পটি ছিল অনিশ্চয়তায় মোড়া। কোথা থেকে কীভাবে অর্থায়ন হবে এ নিয়ে ছিল ধোঁয়াশা। তখন প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল দেশের মানুষের অভূতপূর্ব সাড়া। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জানিয়েছেন, মানুষের এই অভাবনীয় সাড়ার কারণেই সেতু প্রকল্প বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়েছে। চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন কোম্পানির কর্মীদের হাতে গড়া এই সেতু বাংলাদেশের সঙ্গে বন্ধু রাষ্ট্র চীনের সঙ্গে সম্পর্কের এক নতুন সেতুবন্ধন রচনা করেছে। নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও চীনা প্রকৌশলী এবং কর্মীরা সেতু বাস্তবায়নে কাজ করে গেছেন নিরলসভাবে।
স্বপ্নের এই সেতু বাস্তবায়নে এখন দক্ষিণের জনপদে সাজ সাজ রব। আর কয়েক ঘণ্টা পরই এই সেতুর দ্বার খোলার শুভ ঘোষণা করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কোটি কোটি মানুষের স্বপ্নের এই সেতুর উদ্বোধন ঘিরে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা বিরাজ করছে সারা দেশে। যদিও ভয়াবহ বন্যা উদ্বোধনের এই আনন্দক্ষণে কিছুটা রাশ টেনেছে। সেতু উদ্বোধনের ক্ষণকে স্মরণীয় করে রাখতে সারা দেশেই আয়োজন করা হয়েছে ব্যাপক কর্মসূচির। রাজধানীর হাতিরঝিলসহ বিভিন্ন স্থাপনায় করা হয়েছে আলোকসসজ্জা। শনিবার সকালে সেতুর মাওয়া প্রান্তে মুন্সীগঞ্জের শিমুলিয়ায় মূল সেতুর উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। উদ্বোধনী স্থানে আয়োজন করা হয়েছে সুধী সমাবেশের। এতে সরকারি ও বিরোধী দলগুলোর নেতাদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে বিশিষ্ট ব্যক্তি, বিদেশি কূটনীতিক, উন্নয়নসহযোগী প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তাদের। পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের পর মাদারীপুরের বাংলাবাজার ঘাটে হবে স্থানীয় আওয়ামী লীগের উদ্যোগে জনসভা। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখবেন- প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেতুর উদ্বোধনী কর্মসূচি ঘিরে পদ্মা পাড়ে নেয়া হয়েছে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা। মোতায়েন করা হয়েছে কয়েক হাজার নিরাপত্তাকর্মী।
ইতিমধ্যে পদ্মার দুই পাড়ে নতুন দুই থানার উদ্বোধন করা হয়েছে। শিবচরের জনসভা সফল করতে নেয়া হয়েছে ব্যাপক প্রস্তুতি। স্থানীয় আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে অন্তত ১০ লাখ মানুষের সমাগম হবে সমাবেশে। দক্ষিণের বিভিন্ন জেলা থেকে নদী ও সড়ক পথে দলীয় নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষ এই সমাবেশে অংশ নেবেন। সমাবেশ সফল করতে দিন রাত কাজ করে যাচ্ছেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারাও। ইতিমধ্যে সভামঞ্চ তৈরিসহ সব প্রস্তুতি শেষ হয়েছে। ১১টি পিলারের ওপর ১০টি স্প্যান বসিয়ে তৈরি করা হচ্ছে মঞ্চ। জনসভা ঘিরে তিন বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে আলোকসজ্জা করা হচ্ছে। সভাস্থলে ৫০০ অস্থায়ী শৌচাগার, ভিআইপিদের জন্য আরও ২২টি শৌচাগার, সুপেয় পানির লাইন, ৩টি ভ্রাম্যমাণ হাসপাতাল, নারীদের আলাদা বসার ব্যবস্থা, প্রায় ২ বর্গকিলোমিটার আয়তনের সভাস্থলে দূরের দর্শনার্থীদের জন্য ২৬টি এলইডি মনিটর, ৫০০ মাইকের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এ ছাড়া নদীপথে আসা মানুষের জন্য ২০টি পন্টুন তৈরি করা হচ্ছে। এছাড়াও মোবাইল অপারেটরগুলো তাদের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় ভ্রাম্যমাণ মোবাইল টাওয়ার নির্মাণ করেছে সভাস্থলের আশপাশে। ওদিকে সেতু উদ্বোধন উপলক্ষে শুক্রবার সন্ধ্যায় রাজধানীর হাতিরঝিলে করা হবে বর্ণাঢ্য আলোকসজ্জা।
সেতু বিভাগের এই আয়োজনে থাকবে বর্ণিল নানা আয়োজন। পদ্মা সেতুর আদলে আলোকসজ্জা, ব্যানার ফেস্টুন ও প্ল্যাকার্ড দিয়ে সাজানো হয়েছে পুরো হাতির ঝিল। স্থাপন করা হয়েছে এলইডি ডিসপ্লে। সরকারি ভবন, ফুটওভার ব্রিজ এবং ফ্লাইওভারেও করা হয়েছে আলোকসজ্জা। সেতু উদ্বোধন ঘিরে পদ্মা পাড়ের মানুষের মাঝেও ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা বিরাজ করছে। স্বপ্নের সেতু দিয়ে পদ্মা পাড়ি দেয়ার মাহেন্দ্রক্ষণের অপেক্ষায় সময় পার করছেন তারা। ফেরি পারাপারের নানা দুঃসহ স্মৃতি পিছনে ফেলে পদ্মা জয়ের ইতিহাসের সাক্ষী হতে অপেক্ষায় দক্ষিণ- পশ্চিমের কোটি কোটি মানুষ।