প্রথম পাতা
জটিল ভূ-রাজনীতির মধ্যে অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জে দেশ
অর্থনৈতিক রিপোর্টার
১০ ডিসেম্বর ২০২৩, রবিবার
ভূ-রাজনৈতিক জটিলতার কারণে বাংলাদেশসহ স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে অন্যান্য দেশের সঙ্গে বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখতে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে বলে মন্তব্য করেছেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও অর্থনীতিবিদ ড. ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ।
গতকাল রাজধানীর লেকশোর হোটেলে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) ৩ দিনব্যাপী গবেষণা সম্মেলনের পাবলিক লেকচারে তিনি এ মন্তব্য করেন। এতে সভাপতিত্ব করেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) চেয়ারম্যান ড. জাইদী সাত্তার।
‘বিকাশমান বৈশ্বিক ব্যবস্থা ও ভূ-রাজনীতি: স্বল্পোন্নত দেশগুলোর কী বাস্তবতা’ শিরোনামে ভূ-রাজনীতি ও ভূ-অর্থনীতি একই মুদ্রার দুই দিক উল্লেখ করে ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ বলেন, বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর জন্য এ দুটোই মোকাবিলা করা চ্যালেঞ্জিং। তার মতে, স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জন্য সুবিধা ও ক্ষতি দুটোই রয়েছে। এটি নির্ভর করছে জনগণের সঙ্গে সরকারের কতোটা সমর্থন ও সম্পৃক্ততা আছে এর ওপর।
তিনি বলেন, পরিবতর্নশীল ভূ-রাজনীতির সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বব্যাপী আন্তঃদেশীয় সম্পর্কের হিসাব-নিকাশ ক্রমশ জটিল হচ্ছে। পাশাপাশি জনসমর্থনপুষ্ট শাসনব্যবস্থা না থাকার কারণে বিদেশি শক্তি বা বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর অন্যায় ও অন্যায্য চাপ সামাল দিতে হচ্ছে। এটি বাংলাদেশের মতো স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে চ্যালেঞ্জে ফেলেছে। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা নিশ্চিত করা গেলে, দেশের বৈদেশিক অর্থনীতির সঙ্গে সরকারের রাজনীতির স্বার্থের সমন্বয় করা সম্ভব। তার মতে, বিশ্বের ভূ-রাজনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন আসছে এবং এর প্রভাবে আন্তঃদেশীয় সম্পর্কের সমীকরণ বদলে যাচ্ছে। এর ফলে স্বল্পোন্নত দেশগুলোকেও এই টানাপোড়েনের মধ্যে পড়তে হচ্ছে। এর মধ্যে যেমন ঝুঁকি আছে, তেমনি লাভবান হওয়ার সুযোগও আছে।
ড. মাহমুদ বলেন, রাজনৈতিক কারণে অর্থনৈতিক হাতিয়ার ব্যবহারের প্রভাব চলমান ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে রাশিয়ার বিরুদ্ধে পশ্চিমাদের অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার ফল খুব দৃশ্যমান হয়েছে। এটি প্রমাণ করেছে যে বৃহৎ আকারের সংঘাতে অর্থনৈতিক সরঞ্জামগুলোর এ ধরনের ব্যবহারের প্রভাব সারা বিশ্ব অর্থনীতির জন্য কতোটা হতে পারে।
তিনি বলেন, বিশ্ববাজারে বাংলাদেশকে বাণিজ্য বাড়াতে হলে উচ্চ কর প্রবণতা কমাতে হবে। বিনিয়োগ পরিবেশ নিশ্চিত করার পাশপাশি রপ্তানিতে এতদিন যেসব প্রণোদনা দিয়ে আসছে সরকার, তা আমদানির ক্ষেত্রেও বাড়াতে হবে। তিনি বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের তাৎক্ষণিক প্রভাবের তুলনায় চীনের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য যুদ্ধ কম দৃশ্যমান হতে পারে। তবে বিশ্ব অর্থনীতির জন্য এর প্রভাব সুদূরপ্রসারী এবং দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ক্রমবর্ধমান সংঘর্ষ, বিনিয়োগের বিধিনিষেধ, রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ এবং শুল্কের ফর্ম বিশ্বের এই দুটি বৃহত্তম অর্থনীতির রপ্তানি এবং জিডিপিতে সরাসরি স্বল্পমেয়াদি বিরূপ প্রভাব ফেলেছে।
জাইদী সাত্তার বলেন, বিশ্বায়নের বিপরীতে জাতীয়তাবাদ প্রবল হচ্ছে, যা একধরনের অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদের জন্ম দিয়েছে। এমনকি বিশ্বায়নের প্রবক্তারাও এখন সুরক্ষাবাদী নীতি গ্রহণ করছে। এই বাস্তবতায় উন্নয়নশীল দেশগুলো কী করতে পারে, তা নিয়ে গভীর চিন্তা-ভাবনার অবকাশ আছে।
ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদের বক্তৃতার শেষাংশের পরিপ্রেক্ষিতে বিআইডিএসের মহাপরিচালক বিনায়ক সেনের প্রশ্ন ছিল এ রকম, সরকারের বৈধতার বিষয়টি কি কেবল প্রতিনিধিত্বশীল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা থেকেই পাওয়া সম্ভব, নাকি জনগণের সঙ্গে গভীরতর সম্পর্ক থেকেও এই বৈধতা পাওয়া সম্ভব। সুশাসন, সীমিত দুর্নীতি, উন্নততর সরকারি সেবা-এসব থেকে কি বৈধতা পাওয়া সম্ভব নয়?
বিনায়ক সেনের প্রশ্নের জবাবে ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ বলেন, বৈধতার সংজ্ঞা দেয়া যায় না, এটা অনুভব করার বিষয়। (সিঙ্গাপুরের সাবেক প্রধানমন্ত্রী) লি কুয়ান ইউর বৈধতা ছিল। কমিউনিস্ট দেশগুলোতে এক রকম ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এখনকার উন্নয়নশীল দেশগুলো কমিউনিস্ট দেশগুলোকে আর অনুসরণ করতে চায় না। মালয়েশিয়ার (সাবেক প্রধানমন্ত্রী) মাহাথির মোহাম্মদের প্রতি জনসমর্থন ছিল, এমনকি নির্বাচন না হলেও তা থাকতো বলে মনে হয়। এসব মডেল থেকে শিক্ষণীয় অনেক কিছু আছে বলে মত দেন ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ।
সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, গত ৫০ বছরের পথপরিক্রমায় বাংলাদেশ ভূ-রাজনীতিতে তেমনভাবে জড়িয়ে পড়েনি, ছোটখাটো দু-একটি ঘটনা ছাড়া। কিন্তু বাংলাদেশ এখন বিবদমান বড় শক্তিগুলোর যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণতি হতে যাচ্ছে বলে দেখা যাচ্ছে। তার প্রশ্ন, এটা কি বাংলাদেশের উন্নয়নে প্রভাব ফেলবে না।