প্রথম পাতা
বিশ্লেষকদের মত
বড় আকারে যুদ্ধের আশঙ্কা কতোখানি?
মিজানুর রহমান ও মুনির হোসেন
৮ মে ২০২৫, বৃহস্পতিবার
ভারত-পাকিস্তান বিদ্যমান সংঘাত কতোদূর যাবে? এটা কি থেমে থেমে দীর্ঘ মেয়াদে চলবে অর্থাৎ যুদ্ধে রূপ নেবে? তা এখনো স্পষ্ট নয়। পেশাদার কূটনীতিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা মনে করেন ‘জটিল’ এবং ‘চির বৈরী’ সম্পর্ক থাকা দুই ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী রাষ্ট্রের মধ্যে এমন উত্তেজনা অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু এটি স্থায়ী যুদ্ধে রূপ নেয়ার আশঙ্কা কতটুকু তা নিয়ে এখনই ‘আগাম অনুমান’ হয়তো সঠিক হবে না। বুধবার ভারতের অপরারেশন ‘সিঁদুর’ এবং পাকিস্তানের পাল্টা জবাবে যে হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তা শেষ পর্যন্ত উভয়পক্ষের মধ্যে এক ধরনের রিয়্যালাইজেশন বা উপলব্ধি নিয়ে আসবে বলে মনে করেন কোনো কোনো বিশ্লেষক। দু'দেশের জনগণকে তুষ্ট করতে এবং জাতীয়তাবাদী চেতনাকে উস্কে দিতে রাজনৈতিক নেতারা এমন যুদ্ধের আবহ তৈরি করেন বলেও মত কারও কারও। ভারত-পাকিস্তান সংঘাতের চূড়ান্ত পরিণতি কী হতে পারে, যুদ্ধে জড়ানোর আশঙ্কা কতটুকু? এমন প্রশ্নে পোড় খাওয়া কূটনীতিক সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবিবের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ছিল এমন- কতদূর যাবে এটা বলা মুশকিল। ভারত তো বলেছে তারা সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে হামলাটি পরিচালনা করেছে। তারা এখানে থেমে যেতে চায়, যদি পাকিস্তান এটা আর না বাড়ায়। দ্বিতীয়তঃ পাকিস্তান ভারতের হামলা প্রতিরোধ করেছে বলে দাবি করেছে। তারা এ-ও বলেছে সময়মতো জবাব দেবে। কিন্তু কোন প্রক্রিয়ায়, কখন জবাবটি দেবে- সেটা ইসলামাবাদ স্পষ্ট করেনি। ডিপ্লোমেসিটা এখানেই। এখানে উভয়পক্ষের কথার মধ্যে এক ধরনের গ্যাপ রেখেছে। আমার ধারণা বুধবারের পাল্টাপাল্টি এ অবস্থায় তারা উভয়ে লস অ্যান্ড ড্যামেজ ইভালুয়েট করবে। এর মধ্য দিয়ে দুই দেশই একটা কনক্লুশনে পৌঁছাবে।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ প্রফেসর ড. আমেনা মহসিন বলেন, ভারত এ হামলার নাম দিয়েছে অপারেশন সিঁদুর। তারা দাবি করেছে পাকিস্তানের অভ্যন্তরে সন্ত্রাসী স্থাপনায় তারা হামলাটি করেছে, কোনো সামরিক স্থাপনায় নয়। এর থেকে বোঝা যায় এটি বড় ধরনের কোনো যুদ্ধের কারণ হবে না। কিন্তু বিষয়টি হচ্ছে- পাকিস্তানও প্রতিক্রিয়া দিয়েছে। এটাই স্বাভাবিক ছিল। তিনি বলেন, পেহেলগামের সন্ত্রাসী হামলা নিয়ে পাকিস্তানের দাবি ছিল যেন আন্তর্জাতিকভাবে তদন্ত করা হয়। কিন্তু সেখানে ভারত সাড়া দেয়নি। এখন হয়তো ছোট ছোট হামলা-পাল্টা হামলা চলবে। তবে এটা কতদূর যাবে- তা এখনই বলে দেয়া অনেক দ্রুত হয়ে যাবে। আমার মনে হয়, এটা হয়তো ক্রমেই শেষ হয়ে যাবে। এখনই অলআউট ওয়ারে তারা যাবে- এটা বলা মুশকিল। কারণ ভারত বলছে তারা সন্ত্রাসী স্থাপনাগুলোতে আক্রমণ করেছে। কোনো সামরিক স্থাপনায় আক্রমণ করেনি।
এই সংঘাতের আঞ্চলিক প্রভাব নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক এ প্রফেসর বলেন, এ অঞ্চলে এমনি নিজেদের মধ্যে আদান-প্রদান খুব কম। এমন না যে এখানকার দেশগুলোর মধ্যে অনেক ব্যবসা-বাণিজ্য রয়েছে। কিন্তু একটি অঞ্চলে যখন এমন পরিস্থিতি হয় তখন তো অস্থিতিশীল হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। সেইটা একটা ইস্যু থেকে যায়। আঞ্চলিক অশান্তি হলে অন্যদেরও চিন্তার বিষয়। এটা ছড়িয়ে যেতে পারে কি না এ ধরনের শঙ্কা থাকতেই পারে। আবার সার্ককে পুনরুজ্জীবিত করার যে চিন্তা-ভাবনা ছিল, সেটা আর দেখছি না। বা কোনো প্ল্যাটফর্ম সমস্যাগুলোর সমাধান করতে পারবে বলেও সম্ভাবনা দেখছি না। তার মতে বাংলাদেশের আলাদা ভূমিকা রাখার এখানে কোনো কিছু নেই। বাংলাদেশ কেবল পর্যবেক্ষণ করতে পারে এবং উভয় পক্ষকে শান্ত থাকতে বলতে পারে।
অন্যদিকে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ প্রফেসর ড. দেলোয়ার হোসেন মনে করেন, দুই দেশের জনগণকে তুষ্ট করতে এবং জাতীয়তাবাদী চেতনাকে উস্কে দিতে রাজনৈতিক নেতারা এ যুদ্ধের আবহ তৈরি করেন। তিনি বলেন, ভারত-পাকিস্তান রাজনৈতিক ও কৌশলগত সংস্কৃতিতে যুদ্ধের অভিজ্ঞতা আছে। একাধিকবার সীমান্ত সংঘাতের ঘটনা ঘটিয়েছে তারা। দীর্ঘ বিরতির পর এবার এমন একটা সময়ে হামলা-পাল্টা হামলা হয়েছে যখন বিশ্ব অর্থনীতি ও বিশ্বরাজনীতি অনেকটা অস্থিরতার মধ্যে রয়েছে। তবে এটা কাম্য না হলেও অনেকটাই অবধারিত ছিল। দু’টি দেশের শাসক গোষ্ঠী তাদের জনগণকে তুষ্ট করতে এমন একটা আয়োজন করেছে। আমার মনে হয় না এটা দীর্ঘস্থায়ী হবে। কারণ তাদের অর্থনৈতিক ও অন্যান্য দিক বিবেচনায় এটাকে সীমিত আকারের যুদ্ধ বা সংঘর্ষ হিসেবে দেখবো আমরা। তিনি বলেন, দুই দেশের মধ্যে এমনিতেই সম্পর্ক মিনিমাম পর্যায়ে। অর্থনৈতিক সম্পর্ক একেবারেই শূন্যের কোঠায়। পানি নিয়ে যে একটা সম্পর্ক ছিল সেটিও তলানিতে। এমন সময়ে যুদ্ধ বাঁধলে তা নিঃসন্দেহে দুই দেশের জন্য ক্ষতির কারণ হবে।
তিনি বলেন, দক্ষিণ এশিয়ার ভেতরে আঞ্চলিক সহযোগিতা ও অর্থনৈতিক যোগাযোগ এ দুই দেশের বৈরী সম্পর্কের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সুতরাং এটি আরও বেশি দীর্ঘায়িত হলে গোটা অঞ্চলই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।