প্রথম পাতা
ঐকমত্য কমিশনে মৌলিক সংস্কারের রূপরেখা দিলো এনসিপি
স্টাফ রিপোর্টার
৭ মে ২০২৫, বুধবার
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কাছে মৌলিক সংস্কারের রূপরেখা জমা দিয়েছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। এ ছাড়া ফরিদপুর ও কুমিল্লাকে বিভাগ করা, পরপর দুইবারের বেশি কেউ প্রধানমন্ত্রী না হওয়া, নিম্নকক্ষ আসনভিত্তিক ও উচ্চকক্ষ আনুপাতিক হারে নির্ধারণ, একক ব্যক্তি দলীয় প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী না থাকার বিষয়ে বৈঠকে আলোচনা করেছে বলে জানিয়েছে দলটি। গতকাল সকালে জাতীয় সংসদ ভবনের এলডি হলে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বৈঠক শেষে এ তথ্য জানিয়েছে এনসিপি। বৈঠকে অংশ নিয়ে মৌলিক সংস্কারের রূপরেখা জমা দেন এনসিপি’র সদস্য সচিব আখতার হোসেন। বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ। এনসিপি’র উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সার্জিস আলমের নেতৃত্বে ৫ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল এ বৈঠকে অংশ নেয়।
আখতার হোসেন বলেন, মৌলিক সংস্কার বলতে কোনো নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কার নয় বা আসনভিত্তিক দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে সংবিধান সংস্কারের মতো বিষয়গুলোকে মনে করি না। বরং ক্ষমতার ভারসাম্য, জবাবদিহিতা ও বিকেন্দ্রীকরণ- এ তিনটি বিষয়ের অর্জন হচ্ছে মৌলিক সংস্কারের মূল ভিত্তি।
বৈঠক শেষে সারজিস আলম বলেন, সংসদে যেসব গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় আছে সেগুলোর স্থায়ী কমিটির প্রধান বিরোধী দলের সংসদ সদস্য থেকে নিয়োগ দিতে এনসিপি’র পক্ষ থেকে প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। যেমন- জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটি, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়গুলোতে স্থায়ী কমিটির প্রধানের নিয়োগ যেন বিরোধী দল থেকে হয়। সংবিধানের মূলনীতি সংশোধনে গণভোট আয়োজনের পক্ষে মত দিয়েছে এনসিপি, তবে অন্যান্য সংস্কারে দুই-তৃতীয়াংশ সংসদ সদস্যের সম্মতি প্রয়োজন হবে। ইলেক্টোরাল কলেজ পদ্ধতিতে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের বিষয়ে একমত পোষণ করা হয়েছে। এ ছাড়া সরকারি কর্মকর্তাদের প্রতিবছর আয়-ব্যয়ের হিসাব দেয়ার প্রস্তাব দিয়েছি।
তিনি আরও বলেন, আমরা প্রস্তাব দিয়েছি যে, সংসদ সদস্যরা যেন আস্থা ভোট এবং অর্থ বিলে নিজ দলের বিপক্ষে ভোট দিতে না পারেন। অন্য সব বিষয়ে দলের বিপক্ষে ভোট দেয়ার সুযোগ রাখার কথা আলোচনায় বলেছি। সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রেও সংসদ সদস্যরা দলের বিপক্ষে ভোট দিতে পারবেন। এ ছাড়া ভোটার হওয়ার ন্যূনতম বয়স ১৬ এবং সংসদ সদস্য হওয়ার বয়সসীমা ২৩ বছর করার প্রস্তাব দিয়েছি।
সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের প্রস্তাব প্রসঙ্গে সারজিস আলম বলেন, নির্বাচন কমিশনকে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে এই কাউন্সিল কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। সংসদের নিম্নকক্ষে ১০০ জন নারী সদস্যকে সরাসরি ভোটে নির্বাচিত করার সুপারিশ করেছে এনসিপি। পাশাপাশি উচ্চকক্ষে নারী সদস্যের সংখ্যা ২৫ শতাংশ রাখার বিষয়েও ঐকমত্য হয়েছে।
এ ছাড়াও প্রাদেশিক সরকার গঠন বিষয়ে দ্বিমত থাকলেও ফরিদপুর ও কুমিল্লাকে নতুন বিভাগ হিসেবে প্রতিষ্ঠার প্রস্তাবে একমত হয়েছে দলটি। উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান এবং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানকে সরাসরি ভোটে নির্বাচনের পক্ষে মত দিয়েছে এনসিপি। এ ছাড়া স্থানীয় নির্বাচনে দলীয় প্রতীক ব্যবহার না করার আহ্বান জানানো হয়েছে। বৈঠকে এনসিপি আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব উত্থাপন করেছে। এর মধ্যে রয়েছে- কেউ পরপর দুইবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না, সংসদের নিম্নকক্ষ আসনভিত্তিক ও উচ্চকক্ষ আনুপাতিক হারে নির্ধারণ, একজন ব্যক্তি একসঙ্গে দলীয় প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না, ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইন ও দুদকের ৩২ এর ক ধারা বাতিল এবং সংবিধানের ৩৩ এর ৩ অনুচ্ছেদ ধারা সংস্কার, ছায়া মন্ত্রিসভা ও সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন, নাগরিক সেবা নিশ্চিতে আইন প্রণয়ন, নাগরিক সেবা ও অভিযোগ কমিশন গঠন করা।
সংবাদ সম্মেলনে আখতার হোসেন বলেন, একটি গণপরিষদ নির্বাচনের মধ্যদিয়ে নতুন সংবিধান প্রণয়ন জরুরি হয়ে উঠেছে। সংবিধান পুনর্লিখন এবং বিচার বিভাগের কাঠামোগত সংস্কার ছাড়া একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্ভব নয় বলেও তারা মন্তব্য করেন। তিনি আরও বলেন, মৌলিক সংস্কারের রূপরেখা বাস্তবায়ন এবং আওয়ামী লীগের দৃশ্যমান বিচার প্রক্রিয়া হলে ডিসেম্বর থেকে জুনের আগেই একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজন করা সম্ভব।
তিনি আরও বলেন, শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের রূপরেখা নিয়েও শিগগিরই বিস্তারিত প্রস্তাবনা দেবে এনসিপি। সেই সঙ্গে মন্ত্রণালয়গুলোর কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ ও নীতিনির্ধারকদের গঠনমূলক সমালোচনা ও বিকল্প প্রস্তাব দেয়ার উদ্দেশ্যে একটি ছায়া মন্ত্রিসভার প্রস্তাবনা দিয়েছে সংগঠনটি। এই ছায়া মন্ত্রিসভার সদস্যরা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রম নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করবেন এবং তথ্যভিত্তিক জনমত গঠনে সহায়ক ভূমিকা পালন করবেন।
এর আগে বৈঠকের শুরুতে সূচনা বক্তব্য রাখেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ। তিনি বলেন, এর আগে আমরা জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)’র সঙ্গে আলোচনা করেছিলাম। সেখানে কিছু কিছু বিষয় অমীমাংসিত ছিল এবং কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা করা হয়নি। তবে কমিশন আশা করছে, আজকের বৈঠকের মাধ্যমে এ বিষয়ে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সম্ভব হবে। তিনি আরও জানান, প্রাথমিক পর্যায়ে কমিশনের লক্ষ্য হলো আগামী ১৫ই মে’র মধ্যে সকল রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনার প্রথম পর্ব শেষ করা এবং এরপর দ্বিতীয় ধাপে আলোচনা শুরু করা। এই ধারাবাহিক আলোচনা থেকে আমরা চেষ্টা করছি জাতীয় সনদ তৈরি করতে।
অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, জাতীয় সনদের মূল লক্ষ্য হবে ভবিষ্যতের বাংলাদেশের জন্য একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার পথনির্দেশনা নির্ধারণ করা। আমরা আশা করছি, আজকের আলোচনার মধ্যদিয়েই আমরা অনেক দূর এগিয়ে যেতে পারবো।
বৈঠকে কমিশনের সদস্য হিসেবে উপস্থিত ছিলেন- ড. ইফতেখারুজ্জামান, ড. বদিউল আলম মজুমদার, সফর রাজ হোসেন, বিচারপতি মো. এমদাদুল হক। এ ছাড়া প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (ঐকমত্য) মনির হায়দার। এনসিপি’র পক্ষ থেকে উপস্থিত ছিলেন- সদস্য সচিব আখতার হোসেন, উত্তরাঞ্চলীয় মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম, যুগ্ম আহ্বায়ক সারোয়ার তুষার, জাবেদ রাসিন ও আরমান হোসেন।