ঢাকা, ৪ অক্টোবর ২০২৪, শুক্রবার, ১৯ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৩০ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিঃ

প্রথম পাতা

ভোটার টানার নয়া কৌশল

স্টাফ রিপোর্টার
৮ ডিসেম্বর ২০২৩, শুক্রবার

কয়েক বছর ধরে জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি আশঙ্কাজনক হারে কমছে। নানা কারণে ভোটারদের কেন্দ্রমুখী করা যাচ্ছে না। এবার ভোটকেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি নিশ্চিতে ভিন্ন কৌশল হাতে নেয়া হয়েছে। আগামী ৭ই জানুয়ারি অনুষ্ঠিতব্য দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি বাড়াতে সরকারের সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় উপকারভোগী ও তাদের পরিবারের সদস্যদের ভোটে যাওয়া নিশ্চিত করতে কোনো কোনো এলাকায় উপকারভোগীদের সংশ্লিষ্ট কার্ড জমা নেয়া হচ্ছে। যশোর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও হবিগঞ্জে সামাজিক সুরক্ষার উপকারভোগীদের কার্ড জমা নেয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। সরকারি দলের নেতাকর্মীরা এই কার্ড জমা নিচ্ছেন বলে উপকারভোগীরা জানিয়েছেন। 

কেউ ভোটকেন্দ্রে উপস্থিত না হলে তার কার্ড বাতিলেরও হুঁশিয়ারি দেয়া হচ্ছে। ইতিমধ্যে একাধিক জেলায় এমন কার্যক্রম শুরু করেছে ক্ষমতাসীনরা।  

সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় সরকার অনেকগুলো খাতে ভাতা ও খাদ্য সহায়তা দিয়ে থাকে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য বয়স্ক ভাতা, বিধবা বা স্বামী নিগৃহীতা ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা, মাতৃকালীন ভাতা, হিজড়া, বেদে ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নের জন্য ভাতা, বীর মুক্তিযোদ্ধা সম্মানী ভাতা, শহীদ পরিবার ও যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা ও সম্মানী ভাতা, ভিডব্লিউবি, ভিজিএফ, ভিজিডি, জিআর, টিআর, ওএমএস, টিসিবি ইত্যাদি। নির্বাচনকে সামনে রেখে এসব খাতের উপকারভোগীদেরই কার্ড জব্দ করছেন ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা। যদিও এসব খাতের বেশির ভাগ অর্থই অনলাইন মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে দিয়ে থাকে সরকার। তবুও এভাবে কার্ড জব্দ করায় অনেকে আতঙ্কে আছেন। 

সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রতিটি জেলায় অন্তত দুই থেকে আড়াই লাখ মানুষ রয়েছেন সরকারের সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় উপকারভোগী। এসব ব্যক্তি ও তাদের পরিবারকে কেন্দ্রমুখী করা গেলে নির্বাচনে ভোট পড়ার হার উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পাবে বলে মনে করা হচ্ছে।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, যশোর জেলায় বিভিন্ন খাতে ভাতাভোগী রয়েছেন- মোট ২ লাখ ৪২ হাজার ৪৮০ জন। এর মধ্যে বয়স্ক ভাতার কার্ডধারী ১ লাখ ২৫ হাজার ৩১ জন, অসচ্ছল প্রতিবন্ধী ভাতার কার্ডধারীর সংখ্যা ৫৪ হাজার ৮৭৩ জন, বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা ভাতার কার্ডধারীর সংখ্যা ৫৮ হাজার ৭০০ জন, প্রতিবন্ধী শিক্ষা বৃত্তিপ্রাপ্ত কার্ডধারী পরিবারের সংখ্যা ১ হাজার ৭৯৩টি, সরকারি শিক্ষা উপবৃত্তি প্রাপ্ত শিক্ষার্থী পরিবারের সংখ্যা ১ লাখ ৬৫ হাজার, টিসিবি পণ্য সরবরাহ কার্ডধারীর সংখ্যা ৫৬ হাজার ২২১ জন। এ ছাড়াও জেলার ৮টি উপজেলায় কাবিখা ও কাবিটা প্রকল্পের তালিকাভুক্ত দিনমজুর নারী পুরুষের সংখ্যা আরও প্রায় ৬৫ হাজার। সব মিলিয়ে যশোর জেলায় সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ের মধ্যে বসবাসকারী পরিবারের সংখ্যা প্রায় ৫ লাখের মতো। আসন্ন নির্বাচনকে সামনে রেখে সরকারি দলের প্রার্থী ও তাদের দলের বিদ্রোহী প্রার্থীরা এসব কার্ডধারীদের টার্গেট করেছেন। যে এলাকা যার নিয়ন্ত্রণে তারাই এসব কার্ডধারীদের জিম্মি করছেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে যশোর পৌর সভার ৭ নম্বর ওয়ার্ডের একজন বয়স্ক ভাতাভোগী (পুরুষ) মানবজমিনকে বলেন, পরশু একজন আওয়ামী লীগ নেতা লোক পাঠিয়ে আমাকে তার বাড়িতে ডাকেন। এ সময় তিনি বলেন- নেতার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যাওয়ার সময় যেন আমার বয়স্ক ভাতার কার্ডটি নিয়ে যাই। তার কথামতো ওই কার্ডটি নিয়ে পরদিন সকালে ওই নেতার বাড়ি যাই। তিনি আমার কাছ থেকে কার্ডটি নিয়ে সাফ জানিয়ে দেন ৭ই জানুয়ারি সকাল সকাল ভোটকেন্দ্রে গিয়ে নৌকায় ভোট দিলে তিনি কার্ডটি ফেরত দিবেন। না হলে এই কার্ড আর পাওয়া যাবে না। পৌরসভার ৪ নম্বর ওয়ার্ডের ঘোষপাড়া এলাকার আরেক বাসিন্দা (নারী) জানান, স্থানীয় একজন নেতার কথা বলে এলাকার ছেলেরা তিনিসহ তার আশপাশের ৫টি ভিজিএফ চালের কার্ড নিয়ে গেছে। 

১ নম্বর পৌর ওয়ার্ডের স্বামী পরিত্যক্তা একজন দুস্থ নারী জানান, বহু চেষ্টা তদবির করে ৩ বছর আগে তিনি এই কার্ডটি করেছিলেন। কার্ডের বিনিময়ে তিনি প্রতি মাসে একটা নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা পাচ্ছিলেন। কিন্তু ২ দিন আগে এসে ওই নেতার লোকজন তার কার্ডটি নিয়ে গেছেন। যশোর পৌর এলাকার মতো বিভিন্ন উপজেলার সব ইউনিয়নের গ্রামে গ্রামে সরকারি দলের নেতাকর্মীরা কার্ডধারীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে কার্ড সংগ্রহ করছেন। আর বলছেন, ভোট না দিলে এসব কার্ড আর ফেরত দেয়া হবে না। বিশেষ করে যারা ভোটকেন্দ্রে যাবে না তাদের খবর আছে বলেও হুমকি-ধামকি দিচ্ছেন ওই সব নেতাকর্মীরা। 
একই চিত্র দেখা যায় চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায়ও। জেলার বিভিন্ন এলাকায় সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় উপকারভোগীদের কাছ থেকে জব্দ করা হয়েছে কার্ডগুলো। ৭ই জানুয়ারি ভোটকেন্দ্রে গিয়ে ভোট প্রদান শেষেই কেবল এসব কার্ড ফেরত পাবেন বলে জানানো হয়েছে। অন্যথায় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির নামে নিবন্ধিত এসব কার্ড বাতিল করা হবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। বিষয়টি স্বীকারও করেছেন একজন উপজেলা চেয়ারম্যান। মানবজমিনকে তিনি বলেন, ভোটকেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি নিশ্চিত করতে এমনটা করা হচ্ছে। বেশকিছু দিন ধরে এসব কার্ড জব্দ করা হচ্ছে। আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের মাধ্যমে এটি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এদিকে ভুক্তভোগীরা জানান, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের পাশাপাশি সমাজসেবা অধিদপ্তরের লোকজনও এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত। 

হবিগঞ্জেও সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় উপকারভোগীদের টার্গেট করেছেন ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীরা। তারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে জব্দ করেছেন উপকারভোগীদের কার্ড। এ কাজের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের। অতি গোপনীয়তায় পরিচালিত হচ্ছে বিশেষ এই কাজ। তবে এ বিষয়ে মুখ খুলতে নারাজ স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান ও সদস্যরা। ভোটের দিন এসব উপকারভোগীদের ভোটকেন্দ্রে উপস্থিতি নিশ্চিতকরণের পরিকল্পনা করেছেন তারা। 
জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার মানবজমিনকে বলেন, তারা (ক্ষমতাসীন) কোনোভাবেই আশ্বস্ত হতে পারছেন না ভোটকেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি নিয়ে, যদিও এটা হচ্ছে সাজানো একটা নির্বাচন। নির্বাচনটা হওয়ার কথা ছিল প্রভাব ও মতলবমুক্ত। যার মাধ্যমে মানুষ তার পছন্দের প্রার্থীকে বেছে নেবে। বর্তমানে যেটা হচ্ছে তা হচ্ছে নির্বাচন নির্বাচন খেলা। সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় উপকারভোগীদের কাছ থেকে যদি কার্ড জব্দ করা হয় তাহলে তা হবে মানুষকে জিম্মি করার শামিল। এটা অবিশ্বাস্য, কল্পনাতীত এবং অরাজকতা ছাড়া কিছুই না। এ ধরনের কর্মকাণ্ড কোনোভাবেই কাম্য না। 

পাঠকের মতামত

যাদের কে এভাবে জিম্মি করে ভোট কেন্দ্রে নেবে তাদের উচিৎ সবগুলো মার্কায় সিল দেয়া যাতে একটা ও বৈধ ভোট না হয়৷

rahim
১২ ডিসেম্বর ২০২৩, মঙ্গলবার, ৭:১৪ অপরাহ্ন

আহা আওয়ামী লীগ! দল হিসেবে এতটাই দেউলিয়া হয়ে গেছে যে, এখন বিধবা আর প্রতিবন্ধীদের জিম্মি করে ভোট নিতে হচ্ছে!

MD SABBIR HOSSAIN
৮ ডিসেম্বর ২০২৩, শুক্রবার, ১১:২৭ অপরাহ্ন

আমি আগেই আশংকা করেছিলাম এসব লোকজনদেরই টার্গেট করা হবে ভোট প্রদানের জন্য।।

তাজুল
৮ ডিসেম্বর ২০২৩, শুক্রবার, ৭:১৬ অপরাহ্ন

এটাতো সাংবিধানিক অধিকার এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন। পছন্দের প্রাথীকে ভোট দেওয়ার অধিকার হরন করা হচ্ছে। মূলত তাদেরকে নৌকাতে ভোট দিতে বাধ্য করা হচ্ছে। উরা নিজেরাই ভোট দিয়ে দিবে।

আবু উমায়রা
৮ ডিসেম্বর ২০২৩, শুক্রবার, ৫:২৮ পূর্বাহ্ন

আওয়ামী ষড়যন্ত্রের কথা মানব জমিন ফাস করে দিচ্ছে।আমেরিকা, ইউর গোয়েন্দা সংস্থার এগুলো সব ফাইল করে রাখছে।তারা এত আওয়ামী লীগের মত বেকুব না তারা ভালো করেই জানে সামনের নির্বাচন হবে তামাশার।

সালাম
৮ ডিসেম্বর ২০২৩, শুক্রবার, ৩:৫৮ পূর্বাহ্ন

ভোটারদের ভোট দানের এই ব্লাকমেইল পদ্ধতি আন্তর্জাতিক ফোরামে জানানো অতিব জরুরী।

Aminul
৮ ডিসেম্বর ২০২৩, শুক্রবার, ৩:০১ পূর্বাহ্ন

সবচেয়ে ভালো হবে যদি মোবাইল ফোনের ডেটা কেনা কোনোভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়।

Mohammad Alam Khan
৮ ডিসেম্বর ২০২৩, শুক্রবার, ১:৩৮ পূর্বাহ্ন

ভোটারদের ভোট দানের এই ব্লাকমেইল পদ্ধতি আন্তর্জাতিক ফোরামে জানানো অতিব জরুরী।

Ruhul Amin
৮ ডিসেম্বর ২০২৩, শুক্রবার, ১:৩৩ পূর্বাহ্ন

সুরক্ষা কার্ডের সাথে জাতীয় পরিচয়পত্র ব্যাংক হিসাব পাসপোর্ট জব্দ করলে ভোটার টানা মজবুত হবে। সশস্ত্র দলীয় বাহিনী বাড়ি বাড়ি পাঠালে ভোটার টানা আরো সুদৃঢ় হবে।

শেখ নিজাম উদ্দিন আহম
৮ ডিসেম্বর ২০২৩, শুক্রবার, ১২:১৫ পূর্বাহ্ন

কার্ড দিয়ে সরকার ভোট কিনে পেলেছে?

Faiz Ahmed
৭ ডিসেম্বর ২০২৩, বৃহস্পতিবার, ৭:৪২ অপরাহ্ন

কতটা দেউলিয়াত্বের কারনে এরকম করে

Emon
৭ ডিসেম্বর ২০২৩, বৃহস্পতিবার, ৭:৩৪ অপরাহ্ন

এটা হবে মোটামুটি সবাই আচ করতে পেরেছে

মোহাম্মদ আরিফ
৭ ডিসেম্বর ২০২৩, বৃহস্পতিবার, ৪:৪৭ অপরাহ্ন

প্রথম পাতা থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

প্রথম পাতা সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status