শরীর ও মন
চোখের নিচের ত্বকে কালো দাগ হলে
অধ্যাপক ডা. এসএম বখতিয়ার কামাল
৬ ডিসেম্বর ২০২৩, বুধবারচোখের চারপাশে পাতলা ত্বকে কালো দাগ একটি পরিচিত বিষয়। বিশেষ করে নারী-পুরুষ উভয়ের চোখেই এটি দেখা যায়। অনেকের এই সমস্যাটি চিন্তার কারণ হয়ে থাকে। এমনো দেখা গেছে কারও কারও এই দাগ দীর্ঘদিন ধরে আছে। সাধারণত বয়স্ক লোক, সাদা চামড়া নয় এমন জনগোষ্ঠী এবং যাদের জিনগত এই প্রবণতা রয়েছে তাদের মধ্যে এই সমস্যা বেশি দেখা যায়। নিম্নোক্ত কারণগুলোকে এই সমস্যার জন্য দায়ী করা হয়ে থাকে। ১. বংশগত, ২. এলার্জিজনিত, ৩. একজিমা, ৪. ঘন ঘন চোখ চুলকানো, ৫. চোখের পাওয়ারের সমস্যা, ৬. শারীরিক ও মানসিক চাপ, ৭. ধূমপান, ৮. মদ্যপান, ৯. বেশি বেশি সর্দি লাগা, ১০. সূর্যের আলোর প্রভাব, ১১. রক্তশূন্যতা, ১২. লিভারের সমস্যা ইত্যাদি, ১৩. অপর্যাপ্ত ঘুম ও দেরিতে ঘুমানো, ১৪. বয়সের প্রভাব, ১৫. চোখের ওপর অতিরিক্ত চাপ, ১৬. ডিহাইড্রেশন, ১৭. রোদ। বংশগত যেহেতু চোখের নিচের অংশে পাতলা বা সেনসেটিভ ত্বকে কালো দাগ দেখা যায় তাই এটি একটি চর্মজনিত সমস্যা। জিনগত কারণ বা বংশগত কারণেও অনেক সময় চোখের নিচে কালো দাগ পড়ে। অর্থাৎ, পারিবারিক ইতিহাসও চোখের নিচের কালো দাগের জন্য দায়ী হতে পারে। শৈশবে শুরুর দিকে এটি দেখা দিলে তা উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত বৈশিষ্ট্য হবার সম্ভাবনা বেশি। যা বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়ে যেতে পারে। অন্যান্য কারণ যেমন- থাইরয়েড রোগের পূর্বাভাস হিসেবেও চোখের কালো দাগ সৃষ্টি হয় এবং অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা করা।
এলার্জি বা অ্যাকজিমাজনিত: অনেকের শরীরের চর্মজনিত এই সমস্যার কারণে এটি দেখা যায়। এলার্জির ও চোখে শুষ্কতার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কারণে চোখের নিচে কালো দাগ পড়তে পারে। অ্যালার্জির প্রতিক্রিয়ায় ত্বককে ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়া থেকে রক্ষা করতে আপনার দেহ হিস্টামিন নিঃসরণ ঘটায়। তাই কালো দাগ দূরীকরণে শরীরে এলার্জিজনিত সমস্যা নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন।
ঘন ঘন চোখ চুলকানো: অনেকের চোখের অ্যালার্জির কারণে ঘন ঘন চোখ চুলকায়, তাই এই সমস্যাটি হয়ে থাকে।
অপর্যাপ্ত ঘুম ও দেরিতে ঘুমানো: অপর্যাপ্ত ঘুম, চরম অবসন্নতা বা স্বাভাবিক শোবার সময় থেকে কয়েক ঘণ্টা বেশি জেগে থাকার অভ্যাসের কারণে আপনার চোখের নিচে কালো দাগ পড়তে পারে। অপর্যাপ্ত ঘুম আপনার ত্বককে নিস্তেজ ও ফ্যাকাসে করে তোলে, এতে করে আপনার ত্বকের নিচের কালো টিস্যু ও রক্তনালীগুলো দৃশ্যমান হয়ে পড়ে। এ ছাড়াও ঘুমের অভাবে আপনার চোখের নিচে এক প্রকার তরল পদার্থ জমা হতে পারে, যাকে চোখের নিচের থলে বলা হয়।
বয়সের প্রভাব: চোখের নিচের কালো দাগের আরও একটি কারণ বয়স বেড়ে যাওয়া। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ত্বক আরও পাতলা হতে থাকে। বয়সের সঙ্গে ত্বকের স্থিতিস্থাপকতা বজায় রাখতে প্রয়োজনীয় চর্বি ও কোলাজেনের পরিমাণ হ্রাস পেতে থাকে। ফলস্বরূপ ত্বকের নিচের অন্ধকার রক্তনালীগুলো আরও দৃশ্যমান হয়ে উঠে এবং চোখের নিচের অঞ্চলটি কালো হয়ে যায়।
চোখের উপর অতিরিক্ত চাপ: টেলিভিশন বা কম্পিউটারের স্ক্রিনে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকলে চোখের উপর অতিরিক্ত চাপ পড়ে। এই অতিরিক্ত ধকলের কারণে আপনার চোখের চারপাশের রক্তনালীগুলো বড় হয়ে যেতে পারে। ফলস্বরূপ আপনার চোখের চারপাশের ত্বক কালো হয়ে যায়। এরফলে চোখে চুলকানি, চোখ লাল হওয়া প্রভৃৃতি অস্বস্তিকর লক্ষণ দেখা দেয়। এ ছাড়াও হিস্টামিন আপনার রক্তকণিকাসমূহকে প্রশস্ত করে দেয় এবং তা আপনার ত্বকের নিচে আরও দৃশ্যমান হয়ে ওঠে।
প্রচণ্ড চুল ঘর্ষণ: অ্যালার্জির কারণে সৃষ্ট চুলকানির ফলে চোখের চারপাশে ত্বক ঘষা বা চুলকানোর ইচ্ছা জেগে ওঠে। যা করলে অবস্থার আরও অবনতি হতে পারে। জ্বলুনি, ফোলাভাব ও রক্তনালীগুলো ভেঙে যেতে পারে। ফলে চোখের নিচে কালো দাগ তৈরি হবে।
ডিহাইড্রেশন: ডিহাইড্রেশন বা পানিশূন্যতা চোখের নিচে কালো দাগ পড়ার একটি অন্যতম কারণ। শরীরে পর্যাপ্ত পরিমাণে পানির সরবরাহ না থাকলে চোখের নিচের ত্বক নিস্তেজ হতে শুরু করে এবং চোখ ভেতরের দিকে দেবে যায়।
রোদ: অতিরিক্ত সময় রোদে পুড়লে আপনার শরীরে অতিরিক্ত পরিমাণ মেলানিনের সৃষ্টি হয়। এটি রঞ্জক, যা আমাদের ত্বককে রঙিন করে তোলে। খুব বেশি রোদে পুড়লে তা থেকে চোখের পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের রঞ্জকতা বৃদ্ধি পায়। যা চোখের নিচের অংশে কালো দাগের মতো মনে হয়। চোখের নিচের কালো দাগ উপরে আলোচিত কারণগুলোর ওপর নির্ভর করে। তাই প্রথমে কেন এটি হচ্ছে, তা নির্দিষ্ট করে তার প্রতিকার করতে হবে। তবে এর কিছু সমাধান রয়েছে।
বরফের ব্যবহার: ঠাণ্ডা জাতীয় কিছু যেমন- বরফ দিয়ে আলতো করে ম্যাসাজ করলে ঠাণ্ডায় কোষগুলো সংকোচনের ফলে ফোলাভাব কমাতে পারে। এটি প্রসারিত রক্তনালীগুলোকে সংকুচিত করতে সহায়তা করবে। ফলে কালো দাগ এবং ফোলাভাব দূর হবে। একটি পরিষ্কার কাপড়ে কয়েকটি বরফ টুকরো মুড আপনার চোখে লাগান। কাপড় গরম হয়ে গেলে বা বরফ গলে গেলে এই প্রক্রিয়াটির পুনরাবৃত্তি করুন। এভাবে ২০ মিনিট করতে পারেন।
পর্যাপ্ত ঘুম: পর্যাপ্ত ঘুম চোখের নিচের কালো দাগ দূর করতে সহায়তা করে। কারণ, অনেক সময় ঘুমের অভাবে চোখের নিচে এই দাগ পড়ে থাকে। নিচের কালো দাগ দূর করতে প্রতিদিন ৭ থেকে ৮ ঘণ্টা ঘুমাতে হবে।
টি-ব্যাগ থেরাপি: টি-ব্যাগ ভিজিয়ে চোখের উপর দিয়ে রাখুন। আপনার চোখে ঠাণ্ডা টি-ব্যাগ প্রয়োগ করলে চোখের সৌন্দর্য বৃদ্ধি পাবে। চায়ের ক্যাফেইন ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট থাকে, যা রক্ত সঞ্চালনকে বাড়িয়ে দেয়। এটি রক্তনালী সংকুচিত করতে এবং ত্বকের নিচে জমে যাওয়া তরল পদার্থ হ্রাস করতে সহায়তা করে। দু’টি কালো বা সবুজ টি-ব্যাগ গরম পানিতে পাঁচ মিনিটের জন্য ভিজিয়ে রাখুন। তারপর ১৫ থেকে ২০ মিনিটের জন্য ফ্রিজে ঠাণ্ডা করে নিন। ঠাণ্ডা হয়ে গেলে চোখ বন্ধ করে চোখের উপর ১৫ থেকে ২০ মিনিটের জন্য টি-ব্যাগগুলো রেখে দিন। অপসারণের পরে ঠাণ্ডা পানিতে চোখ ধুয়ে ফেলুন, একটু উঁচু বালিশ ব্যবহার করতে পারেন, রোদে কালো চশমা বা সান গ্লাস ব্যবহার, চক্ষু বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেয়া। পরিশেষেও ভালো না হলে স্কিন বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেয়া উত্তম।
লেখক: (চর্ম, যৌন ও এলার্জি রোগ বিশেষজ্ঞ ও চিফ কনসালটেন্ট ড. কামাল হেয়ার অ্যান্ড স্কিন সেন্টার ফার্মগেট, গ্রিন রোড, ঢাকা। সেল- ০১৭১১৪৪০৫৫৮