ঢাকা, ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, বৃহস্পতিবার, ২৮ ভাদ্র ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৮ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিঃ

প্রথম পাতা

নানা নিয়ন্ত্রণ, তবুও মাসে রিজার্ভ কমছে বিলিয়ন ডলার

অর্থনৈতিক রিপোর্টার
৩ ডিসেম্বর ২০২৩, রবিবারmzamin

দুই বছর ধরে বাংলাদেশে ডলার সংকট চলছে। সাম্প্রতিক সময়ে তো আরও তীব্র আকার ধারণ করেছে। বাজার সামাল দিতে ধারাবাহিকভাবে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করছে বাংলাদেশ ব্যাংক । এতে ব্যাপকভাবে কমছে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বা মজুত। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিভিন্ন নিয়ন্ত্রণমূলক পদক্ষেপও কাজে আসছে না। রিজার্ভ বাড়াতে আমদানিতে কড়াকড়ি আরোপ করেও ফল মিলেনি। এমনকি রিজার্ভ বাড়াতে বেসরকারি ব্যাংক থেকে ডলার কিনছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবুও রিজার্ভের পতন ঠেকানো যাচ্ছে না। আবার বাধ্য হয়ে সরকারি আমদানির দায় মেটাতে এর চেয়ে বেশি পরিমাণ ডলার বিক্রি করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ফলে রিজার্ভে টান পড়ছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) রিজার্ভ কমেছে ৬ বিলিয়ন ডলারের বেশি। অর্থাৎ প্রতি মাসে গড়ে রিজার্ভ থেকে কমছে ১.২ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে ডলার সংকট তৈরি হয়। সংকট সমাধান করতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এরপরেও কোনোভাবে সংকট সামাল দেয়া যাচ্ছে না। টাকার অবমূল্যায়ন ঠেকানোর পাশাপাশি জরুরি প্রয়োজন মেটাতে প্রতিনিয়তই দেশের বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করতে হচ্ছে। এ জন্য কমে যাচ্ছে রিজার্ভ।

তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসেবে চলতি অর্থবছরের শুরুতে দেশের বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৩১.২০ বিলিয়ন ডলার। এখন তা কমে দাঁড়িয়েছে ২৫.০২ বিলিয়ন ডলারে। অর্থাৎ পাঁচ মাসের ব্যবধানে রিজার্ভ কমেছে ৬.১৮ বিলিয়ন ডলার। আর আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত পরিপালন করে রিজার্ভ বিপিএম-৬ অনুযায়ী হিসাব করলে বর্তমানে গ্রস রিজার্ভ দাঁড়ায় ১ হাজার ৯৪০ কোটি ডলার বা ১৯.৪০ বিলিয়ন ডলারে।

বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছে ডলার সংকট থাকায় জ্বালানি ও নিত্যপণ্য আমদানি স্বাভাবিক রাখার লক্ষ্যে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে রিজার্ভের ওপর চাপ বাড়ছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে রিজার্ভ থেকে ১৩.৫৮ বিলিয়ন বা ১ হাজার ৩৫৮ কোটি ডলার বিক্রি করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। আর চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের ৫ মাসে রিজার্ভ থেকে প্রায় ৬ বিলিয়ন ডলারের বেশি ডলার বিক্রি করা হয়েছে। এতে ৬ মাসে রিজার্ভ কমেছে ৬ বিলিয়নের বেশি। অর্থাৎ প্রতি মাসে গড়ে রিজার্ভ থেকে কমছে ১.২ বিলিয়ন ডলার। 

সূত্র মতে রিজার্ভ থেকে গঠন করা রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল বা ইডিএফ, লং টার্ম ফান্ড (এলটিএফ) ও গ্রিন ট্রান্সফরমেশন ফান্ড (জিটিএফ), বাংলাদেশ বিমানকে উড়োজাহাজ কিনতে সোনালী ব্যাংককে রিজার্ভ থেকে দেয়া অর্থ এবং পায়রা বন্দরের রাবনাবাদ চ্যানেলের খনন কর্মসূচিতে রিজার্ভ থেকে দেয়া ডলার বাদ দিলে আইএমএফের হিসাব পদ্ধতি বিপিএম-৬ অনুযায়ী রিজার্ভ দাঁড়ায় ১৯.৪০ বিলিয়ন ডলার। তবে এর পুরোটাই দায়হীন নয়। এর মধ্যে সাড়ে ৩ বিলিয়ন ডলারের ওপর দায় রয়েছে, যার মধ্যে আইএমএফের সদস্য দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে দেয়া ২ বিলিয়নের কিছু বেশি ঋণ রয়েছে। আবার ব্যাংকগুলোর বৈদেশিক দায় পরিশোধের জন্য এক বিলিয়নের কিছু বেশি ডলার রয়েছে। পাশাপাশি এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) বিল পরিশোধের জন্য রয়েছে প্রায় ৫০ কোটি ডলার। তবে দায়হীন বা প্রকৃত রিজার্ভ এখন ১৬ বিলিয়নের কম।

গত অর্থবছরের শুরুর দিকে দেশে ডলারের সংকট দেখা দিলে আমদানিতে কড়াকড়ি শর্ত আরোপ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ সময় নিত্যপণ্য বাদে বিলাসী পণ্য আমদানিতে শতভাগ মার্জিন দেয়া হয়। এতে এলসি নিষ্পত্তি ও পরিশোধ কমে যায়। তবে সেপ্টেম্বরে বড় বিপর্যয়ের পর অক্টোবরে দেশের রেমিট্যান্স প্রবাহ ঘুরে দাঁড়িয়েছে। গত মাসে দেশে রেমিট্যান্স এসেছে ১৯৭ কোটি ৭৫ লাখ ডলার। গত বছরের অক্টোবরে ১৫২ কোটি ৫৫ লাখ ডলার রেমিট্যান্স দেশে এসেছিল। সে হিসাবে গত মাসে রেমিট্যান্সে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২৯.৬৩ শতাংশ। আর চলতি মাসের প্রথম ২৪ দিনে ১৪৯ কোটি ডলারের রেমিট্যান্স এসেছে। এর আগে চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে দেশে রেমিট্যান্স প্রবাহে বড় বিপর্যয় হয়েছিল। সেপ্টেম্বরে দেশে রেমিট্যান্স এসেছিল মাত্র ১৩৩ কোটি ডলার, যা ছিল ৪১ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। 
এদিকে ব্যাংকগুলো ডলারের আনুষ্ঠানিক দাম কমালেও বাস্তব চিত্র ভিন্ন। ডলার সংকট আরও তীব্র হয়েছে। দামও বেড়েছে। সপ্তাহের শেষ দিনে প্রবাসী আয়ে প্রতি ডলারের দাম ১২৩ টাকা ছাড়িয়েছে। যদিও ঘোষণায় প্রবাসী আয়ে ডলারের দাম ১০৯ টাকা ৭৫ পয়সা।

অক্টোবরের তুলনায় নভেম্বরে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেশি কমেছে। অক্টোবরে রিজার্ভ কমেছিল ৪৯ কোটি ডলার। আর নভেম্বরে কমেছে ১২৬ কোটি ডলার। নভেম্বরে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) দেনা বাবদ ১০০ কোটি ডলারের বেশি পরিশোধ করায় রিজার্ভ বেশি কমেছে। গত বৃহস্পতিবার দিনের শুরুতে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার নিট রিজার্ভ ছিল ১৯.৪০ বিলিয়ন ডলার। অক্টোবরের শেষে রিজার্ভ ছিল ২৬.৬ বিলিয়ন ডলার। একই সময়ে গ্রস রিজার্ভ কমেছে ১৪৬ কোটি ডলার। বৃহস্পতিবার গ্রস রিজার্ভ ছিল ২৫.০২ বিলিয়ন ডলার। অক্টোবরের শেষে গ্রস রিজার্ভ ছিল ২৬.৪৮ বিলিয়ন ডলার।

সংকটের মধ্যে ডলারের দাম দুই দফায় ৭৫ পয়সা কমিয়েছে ব্যাংকগুলো। ফলে প্রবাসী ও রপ্তানি আয় কেনায় ডলারের দাম হয়েছে ১০৯ টাকা ৭৫ পয়সা। আর আমদানির ক্ষেত্রে দাম ১১০ টাকা ২৫ পয়সা। তবে নির্ধারিত দামে ডলার কেনাবেচা হচ্ছে কম। বৃহস্পতিবারও ব্যাংকগুলো ১২৩ টাকার বেশি দামে প্রবাসী আয় কিনেছে। বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস এসোসিয়েশন (বাফেদা) ও এসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) গত মঙ্গলবার সন্ধ্যায় এক সভায় এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ডলারের নতুন এ দাম কার্যকর হবে আগামী রোববার থেকে। আগে আনুষ্ঠানিক দাম ২৫ পয়সা বেশি ছিল। 

ডলারের দাম কমছে, সংকট কি কেটে গেছে- এমন প্রশ্নের জবাবে বেসরকারি একটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, ১২২-১২৩ টাকার নিচে রেমিট্যান্স পাওয়া যাচ্ছে না। এর ফলে আমরা ডলার কিনতে পারছি না। চাহিদামতো ঋণপত্র (এলসি) খুলতে পারছি না। 
সূত্র জানায়, আমদানি ব্যয় ও বৈদেশিক ঋণ পরিশোধে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করতে হচ্ছে। এর বিপরীতে রিজার্ভে অর্থ জমা হচ্ছে কম। যে কারণে রিজার্ভ কমে যাচ্ছে। এদিকে বৈশ্বিক মন্দায় রপ্তানি আয় কমছে। রেমিট্যান্স গত মাসে বাড়লেও এ মাসে আবার কমে যেতে পারে। কারণ ডলারের দাম কমানোর ফলে রেমিট্যান্স আসার প্রবাহ কমে গেছে।
এদিকে ডিসেম্বরে আইএমএফের ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি বাবদ ৬৮ কোটি ডলার ছাড় হতে পারে। এ ছাড়া বিশ্বব্যাংক ও এডিবি থেকে আরও কিছু অর্থ ছাড় হবে। এসব মিলে ডিসেম্বরে রিজার্ভ কিছুটা বাড়তে পারে। তবে জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে আবার আকু’র দেনা শোধ করতে হবে। তখন আবার রিজার্ভে চাপ বাড়বে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ডলারের দর নিয়ে যে বিভ্রান্তি আছে, তা সমাধান করতে হবে। এ ছাড়া অর্থ পাচার ও হুন্ডি প্রতিরোধে কঠোর হতে হবে। একই সঙ্গে বিদেশি বিনিয়োগ এবং সহজ শর্তের বিদেশি ঋণ বাড়ানোর ওপর জোর দিতে হবে। পাশাপাশি যেসব প্রকল্পে ডলার খরচ হয়, আপাতত সেগুলো বন্ধ রাখতে হবে। এভাবে বাজারের অবস্থা ভালো করা গেলে দর এমনিতেই পড়ে যাবে।

পাঠকের মতামত

বাংলাদেশে কিভাবে ডলার ধরে রাখবে !? যখন স্ট্যাপলার পিন থেকে আলপিন, কাগজ থেকে কলম, ডিম, কাঁচা মরিচ, ডাল, পেঁয়াজ, রসুন, আদা সবকিছুই যখন আমদানি করতে হয় তখন বাংলাদেশের মতো দেশ কীভাবে ডলার ধরে রাখবে !! অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বৃদ্ধি না হওয়া পর্যন্ত বৈদেশিক রিজার্ভে ভারসাম্য বজায় রাখা অসম্ভব। এত টানটান পরিস্থিতি নিয়ে দীর্ঘমেয়াদে অর্থনীতি পরিচালনা করা কঠিন।

Zia
২ ডিসেম্বর ২০২৩, শনিবার, ১০:৫০ অপরাহ্ন

যারা ক্ষমতায় যাবে সমস্যা তাদেরই হবে । wait and see how do they handle it.

Kazi
২ ডিসেম্বর ২০২৩, শনিবার, ১:১২ অপরাহ্ন

প্রথম পাতা থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

প্রথম পাতা সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status