বাংলারজমিন
ইসলামী আন্দোলনের ৩ প্রস্তাব সরকারবিরোধীদের ঐকমত্য
স্টাফ রিপোর্টার
২৯ নভেম্বর ২০২৩, বুধবারবিদ্যমান সংকটময় পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক দল, শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক ও বিভিন্ন পেশাজীবী প্রতিনিধিদের সঙ্গে জাতীয় সংলাপ করেছে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। সংলাপে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের লক্ষ্যে ৩টি প্রস্তাব দিয়েছে দলটি। তাদের এই ৩ প্রস্তাবে ঐকমত্য পোষণ করছে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো। পাশাপাশি রাষ্ট্রব্যবস্থার অবনতি, রাজনৈতিক সংস্কৃতি এবং অর্থব্যবস্থাসহ ১১টি পয়েন্ট তুলে ধরা হয়েছে। এ ছাড়া সংলাপে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন বর্জন, সরকারের পতন এবং রাষ্ট্র মেরামতে জাতীয় ঐক্য গঠনের বিষয়ে একমত পোষণ করেন সরকারবিরোধীরা। এতে বক্তারা বলেন, আজ ডান, বাম, ইসলামপন্থি আমরা সবাই এক হয়ে গেছি। সবাই মিলে রাজপথে নেমেছি। এখন এক সঙ্গে ধাক্কা দিলেই সরকারের পতন হয়ে যাবে। মঙ্গলবার দুপুরে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে জাতীয় সংলাপে উদ্বোধনী বক্তব্যে প্রস্তাব ও পয়েন্ট তুলে ধরেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমীর ও চরমোনাই পীর মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীম। সংলাপে আলোচনা শেষে সভাপতির বক্তব্যের আগে জাতীয় ঐক্যসহ তিন বিষয়ে ঐকমত্য পোষণ করে বিরোধী দলগুলোর নেতারা।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের উদ্যোগে সকাল সোয়া ১০টায় এই সংলাপ শুরু হয়। শেষ হয় দুপুর আড়াইটার দিকে। এতে প্রায় ৫০টি রাজনৈতিক দলের ১০০ জন প্রতিনিধি ও বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ অংশগ্রহণ করেন। উদ্বোধনী বক্তব্যে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের লক্ষ্যে ৩টি প্রস্তাব তুলে ধরেন সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীম। প্রস্তাবগুলো হলো: বিতর্কিত নির্বাচন কমিশন কর্তৃক ঘোষিত একতরফা তফসিল বাতিল করে গ্রেপ্তারকৃত বিরোধী দলীয় রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের মুক্তি দিয়ে নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরি করতে হবে। বর্তমান বিতর্কিত পার্লামেন্ট ভেঙে দিয়ে জাতীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন দিতে হবে (জাতীয় সরকারের গুরুত্ব, বাস্তবতা ও রূপরেখা জাতীয়ভাবে প্রকাশ করা হয়েছে)। কার্যকরী সংসদ, রাজনৈতিক সংহতি এবং শতভাগ জনমতের প্রতিফলনের জন্য পিআর বা সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতির নির্বাচনই অধিকতর উত্তম পদ্ধতি, যা বিশ্বে স্বীকৃতি লাভ করেছে তা প্রবর্তন করতে হবে। তিনি বলেন, আমরা বাংলাদেশের সকল রাজনৈতিক দল ও জনসাধারণকে আহ্বান জানাবো, আসুন আমরা জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলে সকল দুর্নীতিবাজ, টাকা পাচারকারী, ব্যাংক লুণ্ঠনকারী ও অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটকে প্রতিহত করে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধ করি। দুর্নীতিকে মূলোৎপাটন করতে পারলে, অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটকে প্রতিহত করতে পারলে চালের দাম কেজি প্রতি সর্বোচ্চ ৪০ টাকা করা যায়। একই ধারাবাহিকতায় ডাল, তেল ও অন্যান্য দ্রব্যসামগ্রী মূল্য ৩০% কমিয়ে আনা যায়।
উৎপাদনমুখী শ্রমিকদের সর্বনিম্ন মজুরি ২০,০০০ হাজার) টাকা নির্ধারণ করা যায়। সকল পরিবহনের যাত্রীভাড়া ৩০% কমানো যায়। বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানির বিলও ৩০% কমানো যায়। রেজাউল করীম বলেন, আসুন আমরা বিদ্যমান জাতীয় সংকট নিরসনে ভেদাভেদ ভুলে ঐক্যবদ্ধভাবে স্বৈরাচারী রাজনৈতিক ব্যবস্থার পতন ঘটিয়ে মানুষের ভোটাধিকার, রাজনৈতিক অধিকার, নাগরিক অধিকার ও ধর্মীয় অধিকার নিশ্চিত করে দেশকে একটি দুর্নীতি, দুঃশাসন ও সন্ত্রাসমুক্ত সুখী-সমৃদ্ধ কল্যাণ রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলি। আলোচনা ও পর্যালোচনার মাধ্যমে বহুমুখী জাতীয় সংকট নিরসনে আমরা কোনো একটা পথ খুঁজে পাবো ইনশাআল্লাহ। পরে সভাপতির বক্তব্যে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমীর বলেন, আপনাদের বক্তব্যগুলো গভীরভাবে শুনেছি। অচিরেই বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী, পেশাজীবীদের সঙ্গে পরামর্শ করে সামনে আমাদের করণীয় জাতি ও জনগণের সামনে উপস্থাপন করবো। তিনি বলেন, এই সরকারের যে অন্যায় ও জুলুম, সেটা বাস্তবে যদি ৭ই জানুয়ারি জাতীয় নির্বাচনের প্রহসন তারা করতে চায়, আমি আজকে জাতীয় সংলাপে যারা উপস্থিত হয়েছেন তাদের সবার ঐকমত্যে দেশের সকল জনগণ ও ভোটারদেরকে আহ্বান করবো- আমরা কেউ যেন ৭ই জানুয়ারি এই পাতানো নির্বাচনের ভোটকেন্দ্রে উপস্থিত না হই।
বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, এই সংলাপ বহু বছর আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে থাকবে। এখানে আমরা যারা সরকার পতনে একদফা দাবিতে যুগপৎ আন্দোলন করছি, তারা সবাই এখানে এসেছে। বাম-ডান সবাই এসেছে। এজন্য এই সরকারকে ধন্যবাদ দিতে পারেন যে, তাদের অত্যাচার, নিপীড়ন, অন্যায় ও জুলুমের কারণে আজকে আমাদের সবাইকে এক কাতারে নিয়ে এসেছে। আজকে আমরা সবাই মজলুম। দেশে বিভিন্ন সময়ে নির্বাচনকালীন সরকারের বিভিন্ন উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর অধীনে কোন বিশ্বাসে আমরা নির্বাচনে যাবো। উনার বিবেচনায়ই তো যাওয়া উচিত নয়। আর এখন যুক্তির বিষয় নয়। এখন জবরদস্তির ব্যাপার। সেই জবরদস্তিতে যারা সহযোগিতা করছেন এবং যারা জবরদস্তি করছেন তারা সবাই দেশের জনগণের বিপক্ষে অবস্থান নিচ্ছেন। সংলাপে জাতীয় পার্টির (কাজী জাফর) চেয়ারম্যান মোস্তফা জামাল হায়দার বলেন, জাতীয় ঐকমত্য ইতিমধ্যে সৃষ্টি হয়ে গেছে। ইসলামী আন্দোলন যে উদ্যোগ গ্রহণ করেছে, এজন্য তাদেরকে ধন্যবাদ জানাই।
আর দেশে তিনটি প্রধান রাজনৈতিক দল, বিএনপি, জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলন আজকে ’৭১ সালের মতো গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য আন্দোলন করছে। আজকে তাই কোনো কারচুপি এবং কোনো প্রতারণায় কাজ হবে না। বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, দেশে কোন নির্বাচন হচ্ছে? কোনো নির্বাচন হচ্ছে না। ইতিমধ্যে আওয়ামী লীগ এটা প্রমাণ দিয়েছে। তারা নিজেরা প্রার্থী দিচ্ছে। আবার প্রতিটি আসনে একজন করে ডামি প্রার্থী দিচ্ছে! যাতে ২০১৪ সালের মতো বলা না যায় যে, আপনারা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। একটা দল কতো নিচে নামলে এবং মানুষের অধিকারকে ছোট করলে- এতে তারা লজ্জা পাচ্ছে কিনা তা জানি না। কিন্তু নাগরিক হিসেবে তো আমরা লজ্জা পাচ্ছি। সাবেক এমপি গোলাম মাওলা রনি বলেন, এই রকম একটি সময়ে ইসলামী আন্দোলন যে সাহস দেখিয়েছেন-তার সঙ্গে মূলত সংহতি জানানোর জন্য এসেছি। আর যেকোনো কারণেই হোক না কেন, আওয়ামী লীগের লোকজন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বড় করতে করতে হিমালয়ের সর্বোচ্চ চূড়ায় মাউন্ট এভারেস্টের উপরে বসিয়ে দিয়েছেন। এই রকম একজন মানুষ, যখন তার বিরুদ্ধে কথা বলার জন্য কোনো মানুষ রাজপথে দাঁড়ায়, আমি মনে করি এটি একটি বিরাট সংগ্রাম। সেই সাহস আজকে যারা দেখালেন শুধুমাত্র তাদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করতেই আমি এসেছি। গণঅধিকার পরিষদের একাংশের সভাপতি নুরুল হক নুর বলেন, আজকে জাতির যে সংকট। সেই সংকটে ইসলামী আন্দোলনের আমীর ৩টি প্রস্তাব রেখেছেন। এর আগেও জানিয়েছিলেন। কিন্তু সরকার কারও কথা শুনছে না। শুনবেও না। আর তাদের সঙ্গে সংলাপ করে সরকার পতন ঘটাবেন। এটা সম্ভব নয়। যদি আমরা বাধ্য করতে না পারি তাহলে কাজ হবে না। এখানে ইসলামী আন্দোলনকে ভূমিকা রাখতে হবে। দলমতনির্বিশেষে রাজপথে নামতে হবে। তাহলেই সরকারের পতন সম্ভব। অন্যথায় নয়।
সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীমের সভাপতিত্বে সংলাপে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সিনিয়র প্রেসিডিয়াম সদস্য প্রিন্সিপাল মাওলানা সৈয়দ মুহাম্মদ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানী, সিনিয়র নায়েবে আমীর মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করীম শায়খ চরমোনাই, মহাসচিব অধ্যক্ষ হাফেজ মাওলানা ইউনুছ আহমাদ, প্রেসিডিয়াম সদস্য অধ্যাপক আশরাফ আলী আকন, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) সভাপতি এম আবদুল্লাহ, গণফোরাম সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট সুব্রত চৌধুরী, এবি পার্টির সদস্য সচিব মজিবুর রহমান মন্জু, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক হাসনাত কাইয়ুম, ভাসানী অনুসারী পরিষদের সদস্য সচিব হাবিবুর রহমান রিজু, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের সাধারণ সম্পাদক শহীদ উদ্দিন মাহমুদ স্বপন, নাগরিক ঐক্যের সাধারণ সম্পাদক শহীদুল্লাহ কায়সার, এলডিপি’র একাংশের মহাসচিব শাহাদাত হোসেন সেলিম, গণসংহতি আন্দোলনের বাচ্চু ভূঁইয়া, ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টি-এনডিপি চেয়ারম্যান কে এম আবু তাহের, খেলাফত মজলিসের ড. মোস্তাফিজুর রহমান ফয়সাল, সম্মিলিত ওলামা মাশায়েখ পরিষদ সভাপতি খলিলুর রহমান মাদানী, সাংবাদিক মোস্তফা কামাল মজুমদার, বিএনপি’র আইন বিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি আব্দুল লতিফ মাসুম, জাগপা’র সহ-সভাপতি রাশেদ প্রধান, গণঅধিকার পরিষদের আরেক অংশের যুগ্ম আহ্বায়ক কর্নেল (অব.) মিয়া মশিউজ্জামান প্রমুখ বক্তব্য রাখেন।