ঢাকা, ৯ মে ২০২৫, শুক্রবার, ২৬ বৈশাখ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ১০ জিলক্বদ ১৪৪৬ হিঃ

প্রথম পাতা

মুডিস, ফিচ ও এসঅ্যান্ডপি’র রিপোর্ট

বিদেশি ঋণ পাওয়ার ঝুঁকি বাড়িয়েছে

অর্থনৈতিক রিপোর্টার
২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩, বৃহস্পতিবার
mzamin

বিশ্বে ঋণমান যাচাইকারী প্রতিষ্ঠান মুডিস, স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড পুওরস বা এসঅ্যান্ডপি’র পর আন্তর্জাতিক ঋণমান সংস্থা ফিচ রেটিংসও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পূর্বাভাসকে স্থিতিশীল থেকে নেতিবাচকের খবর দিয়েছে। রিজার্ভ কমে যাওয়া ও ডলার সংকটের কারণে এই হতাশাজনক তথ্য দিয়েছে ফিচ।

এর আগে চলতি বছরের মে মাসে মুডিস ইনভেস্টরস সার্ভিস নেতিবাচক তথ্য দেয়। এর দুই মাস পর দেয় এসঅ্যান্ডপি গ্লোবাল এবং আরও দুই মাস পরে, গত সোমবার ফিচ রেটিংস বাংলাদেশের পূর্বাভাস ও ঋণমান সম্পর্কে হতাশাজনক প্রতিবেদন প্রকাশ করলো। প্রকাশিত ওই রিপোর্টে ফিচ রেটিংস জানায়, নানা নীতিগত পদক্ষেপ এবং বিদেশি ঋণদাতাদের ক্রমাগত সহায়তা সত্ত্বেও রিজার্ভের পতন ও ডলার সংকট প্রশমন করতে পারেনি বাংলাদেশ।

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, একের পর এক ঋণমান যাচাইকারী সংস্থা বা রেটিং এজেন্সি যখন কোনো দেশের ব্যাপারে নেগেটিভ বা নেতিবাচক রেটিং দেয়, তখন সেই দেশটির অর্থনীতি সক্ষমতা হারাচ্ছে বাইরের বিশ্বের কাছে এমন বার্তা যায়। তবে বাংলাদেশের অর্থনীতি চাপের মধ্যে রয়েছে, তা মন্ত্রীরাও এখন স্বীকার করেন। সম্প্রতি পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম বলেন, দেশের অর্থনীতি চাপে আছে। তবে সংকট নেই। 

সম্প্রতি বৈদেশিক মুদ্রা-ঋণ মেটাতে বাংলাদেশ কতোটা সক্ষম তা পুনঃমূল্যায়ন করেছে ফিচ। তারা বাংলাদেশকে ‘স্থিতিশীল’ থেকে ‘নেগেটিভ’ রেটিং দিয়েছে। ফিচের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী বাংলাদেশের দীর্ঘমেয়াদি বৈদেশিক মুদ্রা ইস্যুয়ার ডিফল্ট রেটিং বিবি, এটি একটি বিনিয়োগ-গ্রেড রেটিং। দৃষ্টিভঙ্গির এই পরিবর্তন থেকে বোঝা যাচ্ছে দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে উদ্বেগ রয়েছে ফিচের, যা ভবিষ্যতে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা ঋণের বাধ্যবাধকতা পূরণ করার ক্ষমতাকে প্রভাবিত করতে পারে।

ব্যাংকাররা বলেছেন, যদি একটি দেশের দৃষ্টিভঙ্গি নেগেটিভে নেমে আসে, তবে আন্তর্জাতিক আর্থিক বাজারে তহবিল সংগ্রহের চেষ্টা করার সময় সেই দেশ উচ্চতর ঋণের ব্যয়ের মুখোমুখি হতে পারে। এটি সরকার এবং দেশের ব্যবসার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক পুঁজি সংগ্রহ করা আরও ব্যয়বহুল করে তুলতে পারে। এর আরেকটি প্রভাব বিদেশি বিনিয়োগের ওপর হতে পারে। কারণ একটি নেগেটিভ ক্রেডিট রেটিং- এর অর্থ হতে পারে বিদেশিদের জন্য ক্রেডিট প্রোফাইলে অবনতিশীল দেশে বিনিয়োগে আগ্রহ কম। এ ছাড়া এটি মুদ্রার ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে, যা আমদানিকৃত পণ্যের খরচ বাড়াতে পারে এবং মুদ্রাস্ফীতিতে অবদান রাখতে পারে। 
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, বিশ্বের ঋণমান যাচাইকারী কোনো প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ নিয়ে ইতিবাচক কথা বলে নাই। ফলে বিদেশি ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা বাড়বে। পাশাপাশি বিনিয়োগ আনাও কঠিন হবে। কারণ বিদেশিরা দেশে বিনিয়োগের আগে দেশের ঋণমান, ব্যাংকিং খাত ও রাজনৈতিক পরিবেশ কেমন তা দেখে। এরপর তারা বিনিয়োগের জন্য সিদ্ধান্ত নেন। সেই হিসেবে আগামী দিনগুলো দেশের অর্থনীতির জন্য আরও কঠিন হতে যাচ্ছে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি। 

গত ৩০শে মে মুডিস ইনভেস্টরস সার্ভিস বাংলাদেশের ঋণমান এক ধাপ কমিয়ে বিএ৩ থেকে বি১-এ নামানোর ঘোষণা দিয়েছিল। এই পদক্ষেপ নেয়ার পক্ষে যুক্তি হিসেবে সংস্থাটি বলেছিল, বৈদেশিক লেনদেনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে এখন উঁচু মাত্রার দুর্বলতা ও তারল্যের ঝুঁকি রয়েছে। ডলার-সংকট চলমান এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বা মজুত কমে যাচ্ছে, যা দেশের বৈদেশিক লেনদেন পরিস্থিতির ওপর চাপ অব্যাহত রেখেছে।

এরপর গত ২৬শে জুলাই এসঅ্যান্ডপি গ্লোবাল বাংলাদেশের ব্যাপারে তাদের আউটলুক বা দৃষ্টিভঙ্গি স্থিতিশীল থেকে নেগেটিভ বা নেতিবাচক করে দেয়। এক্ষেত্রে দুটি কারণ দেখায় এসঅ্যান্ডপি। প্রথমত, বিদেশি মুদ্রায় স্বল্প মেয়াদে বাংলাদেশ সরকারের অর্থ পরিশোধের যে বাধ্যবাধকতা আছে, তার অবস্থা আগামী বছর আরও খারাপ হতে পারে। দ্বিতীয়ত, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ চাপের মুখে আছে। ডলার-সংকটের বাইরে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়েও মন্তব্য করেছিল এসঅ্যান্ডপি। তাদের মতে, বাংলাদেশের বেশির ভাগ ক্ষমতা আওয়ামী লীগের হাতে। সংসদে বিরোধী দলের প্রতিনিধিত্ব খুবই কম, ফলে সরকারের ওপর নজরদারি সীমিত। ২০২৪ সালে নির্বাচন হবে; কিন্তু বিএনপি অংশ নেবে কিনা, তা পরিষ্কার নয়।

সর্বশেষ দুঃসংবাদ এসেছে ফিচ রেটিংসের পক্ষ থেকে। পূর্বাভাস নেতিবাচক বা ঋণাত্মক করেছে তারা। তবে রেটিংস কমায়নি, কারণ বিদেশি ঋণ পরিশোধে বাংলাদেশ এখনো সক্ষম। পূর্বাভাস নেতিবাচক করার কারণ হিসেবে ফিচ বলেছে, দেশটির বহিস্থ খাতের পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটেছে। বিদেশ থেকে ঋণ পেলেও রিজার্ভের ক্ষয় ঠেকাতে তা যথেষ্ট হচ্ছে না। দেশে যে ডলারের সংকট চলছে এবং তা থেকে উত্তরণের যে আশু কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না, তা-ও উল্লেখ করেছে ফিচ।

বিশ্বব্যাংক ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন মনে করেন, অর্থনীতির রেটিং বা মান স্থিতিশীল থেকে ঋণাত্মক হলে সবার আগে আস্থার ওপর আঘাত আসে। বিদেশি কেউ যদি বাংলাদেশে বিনিয়োগ বা ব্যবসা করতে চায়, তাহলে তিনি সবার আগে দেখবেন আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য রেটিং এজেন্সিগুলো এই দেশ সম্পর্কে কী বলছে। সেই হিসেবে বাইর থেকে বাংলাদেশকে আর খুব ভালো দেখাচ্ছে না।

বর্ধিত বৈদেশিক-বিনিময় চাপ: ক্রমবর্ধমান আমদানি এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা হস্তক্ষেপের ফলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ চাপের মুখে। অনুমান করা হচ্ছে যে, মোট রিজার্ভ ১৯% কমে ২৭.৩ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়াবে, আইএমএফ-এর বিপিএম৬ মান অনুসারে রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল এবং বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন তহবিলে বরাদ্দকৃত অংশ বাদ দিয়ে সংখ্যাটি দাঁড়ায় ২১.৫ বিলিয়ন ডলার। বিপিএম৬-এর অধীনে রিপোর্ট করা রিজার্ভের ওপর ভিত্তি করে ৪.৪ মাসের মাঝারি ‘বিবি’-এর বিপরীতে ২০২৩ এর শেষের দিকে বর্তমান বাহ্যিক অর্থপ্রদানের রিজার্ভ কভারেজ ৩.০ মাস অনুমান করা হচ্ছে।

রিজার্ভ চ্যালেঞ্জ: বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড়িয়ে। পরিচালিত বিনিময় হার, উচ্চ তেলের দাম এবং আমদানি বিধিনিষেধের শিথিলতা চলতি হিসাবের ঘাটতিকে ২০২৫ পর্যন্ত প্রসারিত করবে। এটি এখনো অনিশ্চিত যে, একাধিক হার থেকে একক বিনিময় হার ব্যবস্থায় স্থানান্তর রিজার্ভের পতনকে রোধ করবে কিনা, যখন উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি বৃহত্তর বিনিময় হারের ক্ষমতা রোধ করতে পারে। ২০২৪-২৫ এর মধ্যে প্রায় ২.৬ মাসে বর্তমান বাহ্যিক অর্থপ্রদানের রিজার্ভ কভারেজ আশা করছেন অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা। যদিও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের-এর জুনের শেষে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়নি।

কম আয়: সরকারের সাধারণ রাজস্ব/জিডিপি ‘বিবি’ এর থেকে অনেক নিচে। আইএমএফ চায় বাংলাদেশের রাজস্ব/জিডিপি অনুপাতের উন্নতি করতে। তাই জুন ২০২৩ অর্থবছরের শেষ হওয়া আর্থিক বছরে ৮.৮% এবং ২০২৬ সালে ১০.৩ % অনুপাতের প্রজেক্ট করেছে তারা। বড় কর ফাঁকি এবং কর আদায়ের ক্ষেত্রে প্রশাসনিক দুর্বলতার কারণে এটি আজ চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। ইতিমধ্যেই আইএমএফের জুনের শেষের রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়নি। চলতি বছরের বাজেট জিডিপি’র ৫.২% ঘাটতি লক্ষ্য করা গেছে। 

দুর্বল ব্যাংকিং সেক্টর- বিশেষজ্ঞরা দেশের ব্যাংকিং খাতের স্বাস্থ্য এবং এর পরিচালনার মানকে দুর্বল বলে মনে করছেন, বিশেষ করে সরকারি- ব্যাংকগুলোর মধ্যে রয়েছে। অফিসিয়াল ডেটা অনুযায়ী ২০২৩ সালের মার্চের শেষের দিকে নন-পারফর্মিং লোন (এনপিএল) অনুপাত ছিল ৮.৮%। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর এনপিএল অনুপাত, প্রায় ২০%, বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর ৬.০% থেকে অনেক বেশি।

প্রথম পাতা থেকে আরও পড়ুন

প্রথম পাতা সর্বাধিক পঠিত

   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2025
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status