প্রথম পাতা
ভুবনের মৃত্যুর দায় কার?
মরিয়ম চম্পা
২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩, মঙ্গলবার
দুপুর আড়াইটা। ভুবন চন্দ্র শীলের নিথর দেহ নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল পপুলার হাসপাতাল থেকে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে। এই মুহূর্তে স্ত্রী রত্না রানী শীল এবং সদ্য এসএসসি পাস করা একমাত্র মেয়ে ভূমিকা চন্দ্র শীলের বিলাপে কাঁদছিলেন আশপাশের মানুষজনও।
ধানমণ্ডিতে অবস্থিত পপুলার হাসপাতাল ভবনের নিচ তলায় মা-মেয়েকে ঘিরে আছে ভুবনের অফিসের সহকর্মী এবং পরিবারের সদস্যরা। মেয়ে ভূমিকা এবং স্ত্রী রত্নার চোখে অসহায় চাহনি। কী থেকে কী হয়ে গেল। অপারেশন টেবিলে নেয়ার আগে স্বামী ভুবনের মঙ্গল কামনা করে পূজা-অর্চনা। ঠাকুরকে ডাকা। জপমালা। কী করেননি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর ভুবনকে বাঁচানো গেল না। এখন একমাত্র মেয়ে ভূমিকার ভবিষ্যৎ কী হবে। এ যেন রত্না-ভূমিকার বেঁচে থাকার নতুন লড়াইয়ের শুরু। অথচ এক সপ্তাহ আগেও তাদের একটি নিশ্চিত এবং সুন্দর জীবন ছিল। ময়নাতদন্ত শেষে নোয়াখালীর মাইজদীতে নিজ এলাকায় ভুবনের শেষকৃত্য অনুষ্ঠিত হবে বলে জানায় তার পারিবারিক সূত্র। হাসপাতালে থাকা ভুবনের শ্যালক পলাশ চন্দ্র শীলের সঙ্গে কথা হয় মানবজমিনের।
তিনি বলেন, জামাইবাবুকে লাইফ সাপোর্টে রাখতে প্রতিদিন ৫০ হাজারের বেশি টাকা খরচ হয়েছে। আমাদের কারও প্রতি কোনো আক্ষেপ নেই। নেই কোনো অভিযোগ। কাকে অভিযোগ করবো। কী অভিযোগ করবো! আর কিছুই অবশিষ্ট রইলো না। বোনটাও শারীরিকভাবে অসুস্থ। কিডনিতে সমস্যা। একমাত্র ভাগ্নির পড়াশোনা। কী হবে কিছুই জানি না। কেউ আমাদের পাশে এসে দাঁড়ায়নি। প্রশাসন থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট কেউ আমাদের খোঁজ নেয়নি। ভুবনের চিকিৎসায় সহায়তার হাত বাড়িয়েছে সুহানা অ্যান্ড আনিস আহমেদ ফাউন্ডেশন। এই ফাউন্ডেশনের জ্যেষ্ঠ কর্মসূচি ব্যবস্থাপক আশা পাল জানান, সুহানা ফাউন্ডেশন হাসপাতালের সঙ্গে কথা বলে ভুবন শীলের চিকিৎসার খরচের বকেয়া পরিশোধ করেছে।
এর আগে ভুবনের স্ত্রী আক্ষেপ করে বলেন, প্রকাশ্য ঢাকার রাস্তায় এমন একটা ঘটনায় একজন নিরপরাধ মানুষের এমন পরিণতি। অথচ সরকারের পক্ষ থেকে কিংবা দায়িত্বশীল কেউ খোঁজ নেয়নি। সাহায্যের হাত বাড়ায়নি কেউ। ভুবনের অফিসের নারী সহকর্মী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ভুবনের মতো ভালো মানুষ হয় না। ওর মতো সহকর্মী পাওয়া সৌভাগ্যের বিষয়। কী থেকে কী হয়ে গেল। ওর দুর্ঘটনার পর থেকে আমরা নিয়মিত হাসপাতালে খোঁজখবর রেখেছি। যতটা সম্ভব পাশে থাকার চেষ্টা করেছি। ভুবনের অফিস থেকে কোনো প্রকার আর্থিক সাহায্য করা হয়েছে কিনা জানতে চাইলে ভুবনের এই সহকর্মী বিষয়টি এড়িয়ে যান। ভুবনের আরেক সহকর্মী বলেন- ভুবনকে দীর্ঘদিন ধরেই চিনি। এভাবে তাকে চলে যেতে হবে কখনো ভাবিনি। এদিকে গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর থেকেই দুই ভাইকে নিয়ে গত এক সপ্তাহ ধরে বেসরকারি এই হাসপাতালে স্বামীর সুস্থ হয়ে ফেরার অপেক্ষায় ছিলেন স্ত্রী রত্না।
পলাশ বলেন, সকালে জামাইবাবু মারা গেছেন। তার প্রশ্ন এ মৃত্যুর দায় কার? লাশ ময়নাতদন্ত শেষে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হবে। এর আগে হাসপাতালে ভুবন চন্দ্র শীলের শারীরিক অবস্থা ক্রমেই অবনতি হচ্ছিল। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তাকে হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়েছিল।
শনিবার রাত পৌনে ৯টা থেকে পৌনে ১২টা পর্যন্ত ৩ ঘণ্টা ভুবনের মস্তিষ্কে অস্ত্রোপচার চলে। অস্ত্রোপচার সফল হয়েছে কিনা, তা ৭২ ঘণ্টা পর্যবেক্ষণ করার পর জানানো হবে বলে চিকিৎসকেরা জানিয়েছিলেন। তবে রোববার বেলা ১১টা থেকে ভুবনের শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে থাকে। এদিন রাতে তার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া যায়।
ভুবনের বিষয়ে তার শ্যালক পলাশ চন্দ্র বলেন, ভুবন চন্দ্র শীল গুলশানে অবস্থিত টেক্সটাইল প্রতিষ্ঠানের আইনি পরামর্শক হিসেবে কাজ করতেন। তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল এলাকায় সোমবার রাত ১০টার দিকে প্রাইভেটকার আরোহী এক শীর্ষ সন্ত্রাসীকে লক্ষ্য করে এলোপাতাড়ি গুলি চালায় একদল সন্ত্রাসী। রাতে কাজ শেষে সেখান থেকে মতিঝিলের আরামবাগের বাসায় ফেরার পথে তিনি গুলিবিদ্ধ হন। আরামবাগের বাসায় তিনি একাই থাকতেন। তার স্ত্রী রত্না রানী শীল একমাত্র সন্তানকে নিয়ে থাকেন নোয়াখালীর মাইজদীতে। রত্না মাইজদীর একটি উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষক। ভুবনের বাবা কৃষ্ণ কুমার শীল মারা গেছেন। মা গিরিবালা শীল বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছেন। ভুবনের মা স্ত্রী রত্না রানী শীলের সঙ্গে থাকেন। ভুবন মা-বাবার একমাত্র সন্তান। তাদের আর্থিক অবস্থা তেমন ভালো নয়। এ ঘটনায় অজ্ঞাতনামা সাত-আটজনকে আসামি করে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায় মামলা করেন ভুবন চন্দ্র শীলের স্ত্রী রত্না রানী শীল। সন্ত্রাসীদের করা গুলি গিয়ে লাগে ভুবন চন্দ্র শীলের মাথায়। এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের শিল্পাঞ্চলের সহকারী কমিশনার (এসি) আরিফ রাইয়ান বলেন, ভুবনের মৃত্যুর খবর শুনেছি। বিষয়টি দুঃখজনক। ভুবনের স্ত্রী এ ঘটনায় বাদী হয়ে তখনই একটি মামলা করেছেন। সংশ্লিষ্ট প্রত্যেককেই আইনের আওতায় এনে শাস্তি নিশ্চিত করা হবে।
উল্লেখ্য, হামলায় আহত সন্ত্রাসী মামুন চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরী হত্যা মামলা এবং সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদের ভাই সাঈদ আহমেদ টিপু হত্যা মামলার আসামি। ২৪ বছর কারাবাসের পর সমপ্রতি তিনি জামিনে মুক্ত হন। পুলিশের ধারণা, কারাগারে থাকা আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসী সানজিদুল ইসলাম ওরফে ইমনের নির্দেশে এ হামলার ঘটনা ঘটেছে। শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমন ও মামুন একসময় ধানমণ্ডি, মোহাম্মদপুর ও তেজগাঁও এলাকার আতঙ্ক ছিল। এ ঘটনায় মামলা হলেও এখন পর্যন্ত কাউকে গ্রেপ্তার দেখাতে পারেনি পুলিশ।