ঢাকা, ১৯ এপ্রিল ২০২৫, শনিবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ১৯ শাওয়াল ১৪৪৬ হিঃ

প্রথম পাতা

ডেঙ্গু ভয়ঙ্কর, চিকিৎসায় হ-য-ব-র-ল, একদিনে ১৯ জনের মৃত্যু

ফরিদ উদ্দিন আহমেদ
২০ জুলাই ২০২৩, বৃহস্পতিবার

ভয়ঙ্কর রূপ নিয়েছে ডেঙ্গু পরিস্থিতি। মিনিটে মিনিটে রোগী আসছেন হাসপাতালে। চিকিৎসা দিতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে হাসপাতালগুলো। গত ২৪ ঘণ্টায় এবছর রেকর্ড সংখ্যক ১৯ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। জুলাই মাসের ১৯ দিনে ৯৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। চলতি বছরে এ পর্যন্ত ডেঙ্গু জ্বরে মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৪৬ জনে। এরমধ্যে নারী ৮৩ জন এবং পুরুষ ৬৩ জন। একদিনে সর্বোচ্চ ১ হাজার ৭৯২ রোগী ভর্তি হন হাসপাতালে। 

এদিকে, শয্যা না পেয়ে অধিকাংশ ডেঙ্গু রোগীর ঠাঁই হয়েছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নতুন ভবনের মেঝেতেই। ফ্লোর, বারান্দা, সিঁড়ি, করিডোরসহ বিভিন্ন জায়গায় নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় বেড পেতে স্থান নিয়েছে ডেঙ্গু রোগী। গতকাল সরজমিন ওই ভবনের ৫ থেকে ৭ তলায় মেডিসিন ওয়ার্ডের সামনে ডেঙ্গু রোগীদের এমনই চিত্র চোখে পড়েছে। বিশেষ ব্যবস্থা না থাকায় ডেঙ্গু রোগীদেরও টিকিট কাটা থেকে শুরু করে পরীক্ষা-নিরীক্ষার সব কাজে সিরিয়াল ধরতে হচ্ছে। চিকিৎসা পেতে অনেক বেশি সময় লেগে যাচ্ছে তাদের। এতে শারীরিক অবস্থার অবনতি হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন স্বজনরা। অনেকে জ্বর নিয়ে দীর্ঘ সময় লাইনে দাঁড়াতে পারছেন না। 

চলতি বছরে ঢামেক হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীর চাপ অনেক বেশি। প্রতিদিনই  ঢাকাসহ সারা দেশ থেকে ডেঙ্গু আক্রান্তরা এখানে চিকিৎসা নিতে আসছেন। ডেঙ্গু পরিস্থিতি অবনতির দিকে থাকায় গত সপ্তাহে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে জানানো হয় সব হাসপাতালে আলাদা ডেঙ্গু কর্নার বা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ওয়ার্ড স্থাপন করতে হবে। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেই এখনো আলাদা ডেঙ্গু ওয়ার্ড স্থাপন করা হয়নি। চালু করার কোনো উদ্যোগও নেই। সেখানে মেডিসিন ওয়ার্ডের অন্য রোগীদের সঙ্গেই ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। এতে নানা রকম ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন ডেঙ্গু রোগীসহ সব ধরনের রোগীরা। চিকিৎসকরাও সেবা দিতে গিয়ে প্রচণ্ড হিমশিম খাচ্ছেন।

৬০১ নম্বর (পুরুষ) ওয়ার্ডের সামনে বারান্দায় অবস্থান নেয়া ডেঙ্গু রোগী বাপ্পী বলেন, বেড নেই। তাই কোনো রকম বারান্দায় থেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন তিনি। গত ১৮ই জুলাই হাসপাতালে এসেছেন। তার বাসা শনির আখড়ার রায়েরবাগ এলাকায়। জ্বর ও মাথা ব্যথা নিয়ে হাসপাতালে এসেছেন। একই ফ্লোরে কথা হয় সিঁডির কাছে অবস্থান নেয়া আরেক ডেঙ্গু রোগী জয়ের সঙ্গে। তার বয়স ২২ বছর। তিনি জানান, বড় আশা করে মাদারীপুর থেকে এই হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে এসেছেন। কিন্তু আশানুরূপ চিকিৎসা পাচ্ছি না। ডেঙ্গু শনাক্ত হওয়ার আগে তিনি ঢাকার চকবাজার এসেছিলেন। তার ধারণা চকবাজার থেকেই ডেঙ্গু রোগের মশা তাকে কামড় দিয়েছে। তিনি জানান, তার প্রচণ্ড মাথা ব্যথা ও চোখ জ্বালাপোড়া রয়েছে। সূত্র জানায়, গতকাল ঢামেক হাসপাতালের ৫০০ শয্যার মেডিসিন বিভাগে শুধু ডেঙ্গু রোগীই ভর্তি আছেন ২৩৯ জন। তবে ভর্তির বাইরেও এই বিভাগের বিভিন্ন ওয়ার্ডের ভেতরে-বাইরে অনেক রোগী অবস্থান করছেন। মেডিসিন ওয়ার্ডে কর্তব্যরত এক চিকিৎসক এই প্রতিবেদককে বলেন, অফিসিয়াল স্টেটমেন্ট যা তার চেয়ে চার থেকে পাঁচগুণ বেশি রোগী আমাদের দেখতে হচ্ছে। এখানে ভর্তির চেয়ে অ-ভর্তি রোগী বেশি। তাদের সবাইকেই আমাদের চিকিৎসা দিতে হয়। সবমিলিয়ে বেসামাল অবস্থা। তিনি বলেন, ডেঙ্গুর জন্য আলাদা ওয়ার্ড থাকলে তাদের কাজ করতে সুবিধা হতো। চিকিৎসক ও নার্সরাও কাকে কীভাবে চিকিৎসা দেবেন তা নিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন এই ওয়ার্ডে।

ঢামেকে হাসপাতালে সবসময় রোগীদের ভিড় লেগে থাকে। বিশেষ করে সারা দেশের বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে এখানে রোগীদের রেফার করার ফলে এই চাপ অব্যাহতভাবে চলছেই। ডেঙ্গুর মৌসুমেও অন্যসব রোগীদের সামলাতে ব্যস্ত থাকতে হয় এই হাসপাতালটিকে। এখানকার প্যাথলজি মানে আরেক ভোগান্তির অপেক্ষা। টাকা জমা দেয়া, রিসিট নেয়া, স্যাম্পল দেয়া, রিপোর্ট নেয়া সব কাজেই সবাইকে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়াতে হয়। একেকটা কাজে এক ঘণ্টা বা দুই ঘণ্টাও লেগে যায়। রোগীর অবস্থা যত খারাপই হোক ডেঙ্গু টেস্ট করতে, রক্ত পরীক্ষা করতে এসব ঝামেলা পোহাতেই হয় তাদের।

বেলা ২টা ৪৩ মিনিট। গতকাল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, ডেঙ্গু রোগীদের দীর্ঘ লাইন। ডেঙ্গু রোগী সন্দেহকারী ব্যক্তির স্বজন রাসেল। বললেন, তার স্ত্রীর জ্বর। ডাক্তার ডেঙ্গুর টেস্ট দিয়েছেন। প্যাথলজি পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য টাকা জমা দিতে হাসপাতালের ব্যাংক কাউন্টারের সামনে ২ ঘণ্টা ধরে লাইনে অপেক্ষা করছিলেন। তখনও তার সামনে আরও ১০ থেকে ১২ জন রয়েছেন। বেশ ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে তিনি বলেন, শুনেছি ডেঙ্গু রোগীদের জন্য সরকারি হাসপাতালে আলাদা কর্নার করেছে। কিন্তু এখানে এ ধরনের কিছুই দেখছি না। সরকার বলার পরও ডেঙ্গু রোগীদের জন্য আলাদা কর্নার কেন করছে না? পরীক্ষা-নিরীক্ষাগুলোও আলাদাভাবে করলে ভালো হতো। 

ঢামেক হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীদের এক জায়গায় না রেখে বিভিন্ন ফ্লোরে চিকিৎসা দেয়া প্রসঙ্গে-ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. নাজমুল হক গতকাল মানবজমিনকে বলেন, আমাদের এখানে ডেঙ্গুর জন্য বিশেষ কোনো ইউনিট বা কর্নার করিনি। প্রতিটি ফ্লোরেই চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। তাদেরকে ট্রেডিশনাল ভাবেই বিভিন্ন ফ্লোরে রেখে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। এই মুহূর্তে আলাদা করার কোনো পরিকল্পনাও নেই। মেডিসিন রোগীদের সঙ্গেই ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসা চলবে। পরিস্থিতি দেখে ব্যবস্থা নেয়ার কথা বললেন তিনি।

ডেঙ্গুতে একদিনে রেকর্ড ১৯ জনের মৃত্যু: গত ২৪ ঘণ্টায় এবছর রেকর্ড সংখ্যক ১৯ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। জুলাই মাসের ১৯ দিনে ৯৯ জনের মৃত্যু এবং হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা পৌঁছেছে ১৭ হাজার ৮১৪ জনে। চলতি বছরে এ পর্যন্ত ডেঙ্গু জ্বরে মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৪৬ জনে। এরমধ্যে নারী ৮৩ জন এবং পুরুষ ৬৩ জন মারা গেছেন। মোট মৃত্যুর মধ্যে ঢাকার বাইরে মারা গেছেন ৩৩ জন। গত ২৪ ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ১ হাজার ৭৯২ রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। 

সারা দেশের পরিস্থিতি নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের নিয়মিত ডেঙ্গু বিষয়ক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ১ হাজার ৭৯২ জনের মধ্যে ঢাকার বাসিন্দা ৯২২ জন এবং ঢাকার বাইরে ৮৭০ জন। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, নতুন ১ হাজার ৭৯২ জনসহ বর্তমানে দেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে সর্বমোট ভর্তি থাকা ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ৫৫২ জনে। ঢাকার ৫৩টি বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি আছেন ৩ হাজার ৩৭০ জন এবং ঢাকার বাইরে ২ হাজার ১৮২ জন। চলতি বছরের এ পর্যন্ত ২৫ হাজার ৭৯২ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। ভর্তি রোগীর মধ্যে পুরুষ আক্রান্ত ১৬ হাজার ২৭২ জন এবং নারী ৯ হাজার ৫২০ জন। সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ২০ হাজার ৯৪ জন। অধিদপ্তরের তথ্য মতে, চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৫৬৬ জন এবং মারা গেছেন ৬ জন, ফেব্রুয়ারিতে আক্রান্ত ১৬৬ জন এবং মারা গেছেন ৩ জন, মার্চে ভর্তি রোগীর সংখ্যা ১১১ জন এবং এপ্রিলে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১৪৩ জন এবং মারা গেছেন ২ জন। মে মাসে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১ হাজার ৩৬ জন এবং মারা গেছেন ২ জন। জুন মাসে ৫ হাজার ৯৫৬ জন এবং মারা গেছেন ৩৪ জন। জুলাই মাসে শনাক্ত ১৭ হাজার ৮১৪ জন এবং মারা গেছেন ৯৯ জন। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা আরও বেশি হবে। কারণ অনেক ডেঙ্গু রোগী বাসায় থেকে চিকিৎসা নেন, তাদের হিসাব স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কাছে নেই।

প্রথম পাতা থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

প্রথম পাতা সর্বাধিক পঠিত

   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2025
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status