ঢাকা, ২০ এপ্রিল ২০২৪, শনিবার, ৭ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

প্রথম পাতা

বাজেটের লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়ন একেবারেই অসম্ভব

এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম
৩ জুন ২০২৩, শনিবার
mzamin

বাজেটে মোট দেশজ উৎপাদনের প্রবৃদ্ধি যেটা ধরা হয়েছে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ, এটা বাস্তবায়নের সম্ভাবনা দেখছি না। বর্তমানে প্রবৃদ্ধি আছে ৬ শতাংশের মতো। এখান থেকে সাড়ে ৭ শতাংশে ওঠার সম্ভাবনা খুব কম বলে আমি মনে করি, বিশেষ করে অন্যান্য যে সমস্যা আছে তার ওপর ভিত্তি করে। জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার, মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা, এডিপি, রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা- সবমিলিয়ে যেসব লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে, তা অর্জন হবে কিনা সেটা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। সবমিলিয়ে এই বাজেটকে আমার কাছে বাস্তবতাবিবর্জিত মনে হয়েছে।

দ্বিতীয় বিষয় হলো মূল্যস্ফীতি, এ সম্পর্কে বাজেটে খুব একটা সুস্পষ্ট কিছু নেই। লক্ষ্য ধরা হয়েছে সাড়ে ৬ শতাংশ। বর্তমানে ৯ শতাংশের মতো মূল্যস্ফীতি আছে। এটা কমিয়ে আনতে দিকনির্দেশনা না থাকলে কেমন করে হবে বোধগম্য নয়। অন্যদিকে সরকার ব্যাংক থেকে বেশি ঋণ নিচ্ছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে অনেক বেশি ঋণ নিচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়াকে অর্থনীতির ভাষায় বলা হয় হাই পাওয়ার্ড মানি।

এতে বাজারে মুদ্রা সরবরাহ বেড়ে যায়, সাধারণত মূল্যস্ফীতি বেড়ে যায়।

বিজ্ঞাপন
তৃতীয় বিষয় হলো এক্সপেন্ডিচার জিডিপি। আমাদের দেশে সরকারি ব্যয় বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তা আছে নিঃসন্দেহে, জাতীয় উৎপাদনের আনুপাতিক হিসাবে এটা পৃথিবীর অন্যতম সর্বনিম্নে। কিন্তু কথা হচ্ছে আমাদের বাজেট ঘাটতিও একটা সীমারেখার মধ্যে রাখতে হবে। সে পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের রাজস্ব আহরণ বাড়াতে হবে। কিন্তু রাজস্ব আহরণের ক্ষেত্রে নতুন কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে বলে মনে হয় না। রাজস্ব পরিসর বাড়াতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড কর্তাব্যক্তিদের দক্ষতা বৃদ্ধি করার দিকে নজর দিতে হবে। 

দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির লক্ষ্যমাত্রা ইতিবাচক নয়। নানা ধরনের চাপ আছে। এ অবস্থায় ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাজেটের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, এর কোনোটিই বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ মনে হয়নি। ফলে এই লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়ন একেবারে অসম্ভব। বিশেষ করে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ, মূল্যস্ফীতি, মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি, রাজস্ব আদায়ের কোনোটিই বাস্তবায়নযোগ্য মনে হয়নি।

গত বৃহস্পতিবার ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। প্রস্তাবিত এ বাজেটে মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৬ শতাংশ। মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ঠিক করা হয়েছে সাড়ে ৭ শতাংশ। তবে সামগ্রিকভাবে বাজেটের আকার মোটেই বড় নয়। জিডিপি’র আনুপাতিক হারে বাজেট ১৫ দশমিক ২ শতাংশ। এটি পৃথিবীর অন্যতম সর্বনিম্ন। কিন্তু আকার ছোট হলেও বাস্তবায়ন বড় সমস্যা। এ বছর বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাড়লেও ১০ মাসে বাস্তবায়ন ৫০ শতাংশের কিছুটা বেশি। এ অবস্থায় এডিপি’র আকার বাড়ানো হয়েছে। ফলে এটি কতটুকু বাস্তবায়ন হবে, তা সন্দেহ রয়েছে। রাজস্ব আহরণে রয়েছে অনেক চ্যালেঞ্জ। সামাজিক নিরাপত্তায় বরাদ্দ বাড়ানো জরুরি।
কয়েক বছরে জনসংখ্যার আনুপাতিক হারে দারিদ্র্য পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছিল। তবে সাম্প্রতিক হ্রাসের হার কিছু কমে আসছে।

 কয়েক বছর আগে ১ দশমিক ৮ শতাংশ হারে দারিদ্র্য কমে আসছিল। বর্তমানে তা আরও কম হারে কমছে। অন্যদিকে করোনার কারণে দারিদ্র্যসীমার নিচে সংখ্যা আরও বেড়েছে। এ কারণে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতা বাড়ানো জরুরি। কিন্তু ওইভাবে বাড়েনি। বাজেট ঘাটতি জিডিপি’র ৫ দশমিক ২ শতাংশ। এটি আরও বাড়লেও কোনো সমস্যা ছিল না। কিন্তু ঘাটতি অর্থায়নের ক্ষেত্রে ব্যাংক ঋণের ওপর নির্ভরশীলতা বাড়ানো হয়েছে। এটি ভালো পদক্ষেপ নয়। কিন্তু বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি মুদ্রানীতির লক্ষ্যমাত্রার নিচে রয়েছে। ফলে সরকার ব্যাংক থেকে এত ঋণ নিলে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ কমে যাবে।

বাজেটে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বাড়ানোর যে লক্ষ্যমাত্রার কথা বলা হয়েছে, তা পূরণ হবে না। বলা হয়েছে, জিডিপি’র ২৭ দশমিক ৭৫ শতাংশ বিনিয়োগ হবে। এটিকে অবাস্তব বললেও উদার বিশ্লেষণ হবে। এটি একেবারে অসম্ভব। কারণ, কয়েক বছর পর্যন্ত জিডিপি’র ২২-২৩ শতাংশের বেশি বিনিয়োগ হয়নি। এর মধ্যে এবার হঠাৎ কীভাবে ২৭ শতাংশ হবে, তা বুঝে আসে না। এখানে দুটি বিষয়। প্রথমত, লক্ষ্য সামঞ্জস্যপূর্ণ না। দ্বিতীয়ত, বাস্তবায়নের সক্ষমতাও কম। জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। এটি উচ্চাভিলাষী। কারণ, বিশ্বব্যাংকসহ অন্য সংস্থাগুলো লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে দিয়েছে। এ ছাড়া মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৬ দশমিক ৫ শতাংশ। এটিও অবাস্তব। কারণ, এপ্রিলে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ২৫ শতাংশ। ফলে মূল্যস্ফীতি কমার খুব একটা লক্ষণ দেখছি না।

বাজেট বাস্তবায়নে আয় বাড়ানোর বিকল্প নেই। এক্ষেত্রে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) দক্ষতা বাড়াতে হবে। রাজস্ব আহরণের ক্ষেত্রেও আমাদের চরম ব্যর্থতা রয়েছে। তারপরও প্রতি বছরই রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা বাড়ানো হচ্ছে। এবারো রাজস্ব আহরণের ক্ষেত্রে বাজেটে যেসব পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে তা বাস্তবসম্মত নয়। এক্ষেত্রে বড় রকমের কাঠামোগত সংস্কার ছাড়া রাজস্ব আয় বাড়ানো সম্ভব নয়। এসব সমস্যা দূরীকরণে এবারের বাজেটে তেমন কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি।

প্রতিবছর দেখা যায়, আয়-ব্যয়ের যে লক্ষ্য থাকে, সংশোধিত বাজেটে এর চেয়ে কমানো হয়। বাস্তবায়ন হয় এর চেয়ে আরও কম। বর্তমানে যে পরিমাণ টিআইএন (করদাতা শনাক্তকরণ নম্বর) রয়েছে, কর দেয় এর চেয়ে অনেক কম। এক্ষেত্রে টিআইএনধারীদের কর নিশ্চিত করতে হবে। অন্যদিকে ভ্যাটের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। দোকানদাররা ভ্যাট দিতে চান না। অনেক প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন নেই। ক্রেতারাও রসিদ নিতে আগ্রহী নন। এ ছাড়াও উপজেলা পর্যায়ে অনেক ব্যবসায়ী রয়েছেন। ইতিমধ্যে তারা করের আওতায় এসেছেন। তাদের কর নিশ্চিত করতে হবে। অর্থাৎ, করের হার না বাড়িয়ে আওতা বাড়াতে হবে।

এডিপিতে অনেক প্রকল্প নেয়া হয়। যার ফলে প্রকল্পগুলোয় যে বরাদ্দ দেয়া হয়, তা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। প্রকল্প বরাদ্দের ক্ষেত্রে যে সময়সীমা দেয়া হয়, পরে সময় বাড়ে। এতে ব্যয়ও বেড়ে যায়। এ বছর সরকার প্রকল্প কমানোর কথা বলছে। কিন্তু এরপর কিছু অনুমোদিত প্রকল্প এডিপিতে ঢুকে যায়। সবকিছু মিলে এডিপি’র জন্য আমাদের আরও বাস্তবধর্মী হওয়া উচিত। সামাজিক খাতগুলোর মধ্যে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। দুই খাতে জিডিপি’র অনুপাতে যে বরাদ্দ দেয়া হয়, তা আশপাশে যেকোনো দেশের চেয়ে কম। তবে খরচের দিক থেকেও সমস্যা রয়েছে। কারণ, প্রতিবছরই এ খাতে যে বরাদ্দ দেয়া হয়, তা অব্যবহৃত থাকে। ফলে এ বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে প্রয়োজনীয় সংস্কার আনতে হবে।

দেখা যায়, প্রতি বছরই বাজেটের আকারের ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশ বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। বিশেষ করে, এডিপি বা বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে যেসব প্রকল্প নির্ধারণ করা হয়, প্রথম ৭ থেকে ৮ মাসে এর ৪০ থেকে ৪৫ শতাংশ বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। আর শেষের দিকে তাড়াহুড়া করে ৮০ বা ৮০ শতাংশে নিয়ে যাওয়া হয়। এক্ষেত্রে কাজের মান ঠিক থাকে না, অনেক সময় কাজ না করেও ঠিকাদারদের বিল পরিশোধ করা হয়ে থাকে। তাই জনগণের কল্যাণে বাজেটে বরাদ্দকৃত অর্থ সুষ্ঠুভাবে ব্যবহার করা উচিত। 

আসলে বাজেটের মূল সমস্যা হচ্ছে, বাজেট যাই দেয়া হোক তা বাস্তবায়ন হয় না। প্রত্যেক বছরেই দেখা যায়, মূল যে বাজেট থাকে সংশোধিত বাজেটে তার চেয়ে অনেক কম করা হয়। আসল যে ব্যয় হয় তা সংশোধিত বাজেটের চেয়েও আরও কম। সার্বিকভাবে বাজেটের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, বিশেষভাবে বার্ষিক উন্নয়ন প্রকল্পের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। এতে করে বাজেটের কাক্সিক্ষত সুফল পাওয়া যায় না। 

এবারের বাজেটে মূল চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, মূল্যস্ফীতি, দারিদ্র্য বিমোচনের গতি বাড়ানো, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর নিরাপত্তা বাড়ানো ও এর সুষ্ঠু বিতরণ নিশ্চিত করা। এসব বিষয়ে গঠনমূলক এবং কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
 

লেখক: অর্থ উপদেষ্টা, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকার

প্রথম পাতা থেকে আরও পড়ুন

   

প্রথম পাতা সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status