প্রথম পাতা
বাজেট আইএমএফের প্রেসক্রিপশনে নয়
অর্থনৈতিক রিপোর্টার
৩ জুন ২০২৩, শনিবার
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) প্রেসক্রিপশন বা পরামর্শে বাজেট পেশ করা হয়নি বলে জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী
আ হ ম মুস্তফা কামাল। বলেন, আইএমএফ’র সঙ্গে যারা যুক্ত তারা সবার সার্বিক বিষয়ে খোঁজ-খবর রাখে। তারা শুধু লোন দিয়েই সাহায্য করে না, কিছু প্রজেক্টও সাজেস্ট করে। কোন কোন বিষয় বাস্তবায়ন করা যাবে সেগুলোও তারা পরামর্শ দেয়। তাই মনে করি তাদের পরামর্শ শুনলে সফল হবো। পাশাপাশি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট পুরোটাই গরিব মানুষের জন্য বলেও মন্তব্য করেছেন তিনি।
শুক্রবার রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে (বিআইসিসি) অর্থ মন্ত্রণালয় আয়োজিত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে এ কথা বলেন অর্থমন্ত্রী।
বিভিন্ন মহল থেকে অভিযোগ উঠেছে সরকার আইএমএফ’র দেয়া শর্তের ভিত্তিতে বাজেট প্রণয়ন করেছে- এ বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন, আমরা সবাই এখন অ্যালায়েন। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে আমরা কোনো পণ্য না পেলে খুঁজি বিকল্প কোনো দেশে, যা সেটি পাওয়া যাবে। সার্বিক বিষয়ে আইএমএফ’র ওভারঅল প্রেসক্রিপশন থাকে। আমরা তাদের প্রেসক্রিপশনে বাজেট করিনি। তবে তাদের পরামর্শের যেটুকু গ্রহণ করা যায় সেটুকু করবো। সেখানে আমাদের কোনো আপত্তি নেই। আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, আইএমএফ’র সঙ্গে যারা কাজ করে তারা ভালো। তারা শুধু অর্থ দিয়ে সাহায্য করে না, অর্থনৈতিক বিভিন্ন সংস্কারে সহায়তা করে। তাদের কাছ থেকে অনেক কিছু শেখারও থাকে। তিনি বলেন, আমরা এখন বিশ্বের সবার সঙ্গে সম্পৃক্ত। কারও আলাদাভাবে বসবাস করার কোনো সুযোগ নেই। আপনি যদি আমদানি করেন, তাহলেও কাউকে লাগবে, রপ্তানি করলেও কাউকে লাগবে। তবে আপনাদের নিশ্চিত করে বলতে পারি আইএমএফ’র শর্ত বা পরামর্শ মোতাবেক আমরা আমাদের বাজেট করি নাই।
আরেক প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, অনেকেই বলছেন আমরা লোন নিয়ে চলছি। আইএমএফ থেকে সর্বশেষ যে ঋণ নেয়া হয়েছে এই অর্থ আমাদের প্রবাসীরা দুই মাসেই দেশে প্রেরণ করে। অর্থাৎ দুই মাসের রেমিট্যান্সের অর্থ আমরা ঋণ নিয়েছি। এটা খুব একটা বেশি ঋণ নয়।
মূল্যস্ফীতি নিয়ে সরকারও শঙ্কিত
মূল্যস্ফীতি প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ে আমরা নিজেরাও শঙ্কিত। সারা বিশ্বই এখন মূল্যস্ফীতিতে আছে। আমরা খাবার তো বন্ধ করতে পারবো না। মানুষকে খাবার না দিয়ে রাখা যাবে না। আমরা একটা ফ্লেক্সিবল ওয়েতে এগোচ্ছি। যেসব কারণে মূল্যস্ফীতি হয়, সেটি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছি। প্রয়োজন অনুযায়ী আমরা ছাড় দিচ্ছি। তিনি বলেন, সামাজিক নিরাপত্তার মাধ্যমে প্রচুর খাদ্য সরবরাহ করছি। পাশাপাশি যেসব পণ্য নিত্যপ্রয়োজনীয়, সেখানে নিজেরা নিয়ন্ত্রণ করে সরকারকে সাহায্য করছি। এভাবে আমরা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করছি।
মুস্তফা কামাল বলেন, আমরা যখন ক্ষমতায় আসি, তখন মূল্যস্ফীতি ছিল ১২ শতাংশ। পরের ১০ বছরে সেটি ৬ শতাংশে নেমে আসে। সারা বিশ্বে মূল্যস্ফীতি অনেক বেড়েছে। এখন খুব খারাপ সময়। প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে আমরা ভালো আছি। এবারও যেসব প্রজেকশন আমাদের আছে, সবই আমরা বাস্তবায়ন করতে পারবো বলে আশা করি।
একজনও কালো টাকা সাদা করেননি
সুযোগ দেয়া সত্ত্বেও গত এক বছরে একজনও কালো টাকা সাদা করেননি বলে জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। বলেন, গত বছরের বাজেট বক্তৃতায় বলেছিলাম, কেউ যদি অপ্রত্যাশিত টাকা দেশে নিয়ে আসে, তাহলে সেই টাকার কোনো কর দিতে হবে না। গত বাজেটে এ সুযোগটি দেয়ার পরও এখন পর্যন্ত কোনো অপ্রত্যাশিত টাকা বাংলাদেশে আসেনি। তাই এবারের বাজেটে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ রাখা হয়নি।
পুরো বাজেটই গরিবের জন্য উপহার
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছেন, পুরো বাজেটই গরিব মানুষের জন্য উপহার। এ দেশে অনেক মধ্য আয়ের মানুষ আছে, সময় এসেছে তাদের ট্যাক্স পেমেন্ট করতে হবে। যারা আয় করেন ট্যাক্স দেয়ার সক্ষমতা আছে তাদের ট্যাক্স দিতে হবে। অর্থমন্ত্রী বলেন, আপনারাই আগে বলতেন এ দেশে মিডিল ইনকাম জনসংখ্যার হার বেশি, কিন্তু তারা ট্যাক্স দেয় না। এরা সবাই যদি ট্যাক্স দিতো তাহলে অন্যদের ভাগে কম ট্যাক্স দিতে হতো। আমি মনে করি, এখন সময় এসেছে সবাইকে ট্যাক্স দিতে হবে।
২ কোটি ৪৫ লাখ মানুষের চাকরির ব্যবস্থা করেছি
কর্মসংস্থান বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, এ পর্যন্ত যেসব কমিটমেন্ট আমি দিয়েছি, সবগুলো পূরণ করেছি। আমি বলেছি- দুই কোটি মানুষের চাকরির ব্যবস্থা করবো, কিন্তু আমরা ২ কোটি ৪৫ লাখ মানুষের চাকরির ব্যবস্থা করেছি। দেশের জনসংখ্যা বাড়ছে, চাকরিপ্রার্থীও বেড়েছে। তবে এখন কর্মসংস্থানও বেড়েছে। কামাল বলেন, ধীরে ধীরে কর্মসংস্থান বাড়ছে। কর্মসংস্থানের জন্য নানা ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছি। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট বাস্তবায়ন করা সম্ভব উল্লেখ করে অর্থমন্ত্রী বলেন, আমরা যখন দেশ পরিচালনা শুরু করি, তখন ৫৯ হাজার ৪০০ কোটি টাকা রাজস্ব আয় করতাম, সেটি দুই লাখ ৯৫ হাজার কোটি টাকায় উন্নীত করতে পেরেছি। সুতরাং এবারও আমরা বাজেট বাস্তবায়ন করতে পারবো।
রাজস্ব আদায় ৫৯ হাজার কোটি থেকে ৩ লাখে এসেছে
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, এ সরকার যখন ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসে তখন রাজস্ব আদায় ছিল ৫৯ হাজার কোটি টাকা। এখন রাজস্ব ২ লাখ ৯৫ হাজার কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে। ৫৯ হাজার কোটি টাকা থেকে যদি ৩ লাখ কোটি টাকায় পৌঁছানো যায়, তাহলে এখন যেটা বাড়তি বলছেন সেটা আমরা অর্জন করতে পারবো।
অর্থমন্ত্রী বলেন, আমরা যে বাজেটগুলো দিয়েছি। কোনোটিতেই ফেল করিনি, ইনশাআল্লাহ্ আগামীতেও আমরা ফেল করবো না। দৃঢ় বিশ্বাস আমরা পরাজিত হবো না, বিজয়ী হবোই হবো। তিনি বলেন, আমরা এখানে যারা উপস্থিত হয়েছি প্রত্যেক মানুষের দেশপ্রেম আছে। দেশপ্রেম আছে বলেই আমরা বার বার বিজয়ী হয়েছি। এদেশের সবকিছুর মূলে হচ্ছে মানুষ। তাদের কর্মদক্ষতা, দেশের প্রতি তাদের মায়া মমতা, দায়বদ্ধতা এটা অসাধারণ এক উদাহরণ সৃষ্টি করেছে।
১৪ বছরে একজন মানুষও না খেয়ে মারা যাননি: কৃষিমন্ত্রী
আওয়ামী লীগ সরকারের টানা ৩ মেয়াদকালের ১৪ বছরে দেশে একজন মানুষও না খেয়ে মারা যাননি বলে জানিয়ে কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ২০০৬-০৮ সালে দেশে দুর্ভিক্ষ হতো। উত্তরবঙ্গে অনেক মানুষ না খেয়ে মারা যেতেন। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর গত ১৪ বছরে একজন মানুষও না খেয়ে মারা যাননি। আপনাদের (সাংবাদিক) নিউজেও এমন তথ্য দেখিনি। অথচ একটা সময় প্রতি বছর নভেম্বরে ৮-১০ জন না খেয়ে মারা যেতেন। আব্দুর রাজ্জাক বলেন, আমরা খাদ্যবান্ধব নানা কর্মসূচি করছি। এক কোটি পরিবারকে ১৫ টাকা কেজি দরে চাল দিচ্ছি। টিসিবি’র মাধ্যমে তেল-চিনি দেয়া হচ্ছে। বাজেটের পরও চলমান কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে। একজন মানুষও যেন কষ্ট না পান, সেই পদক্ষেপ গ্রহণ করেছি।
অন্যদের তুলনায় আমরা ভালো আছি: বাণিজ্যমন্ত্রী
পণ্যের দাম বাড়লেও অন্যদের তুলনায় বাংলাদেশের অবস্থা ভালো আছে জানিয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, সারা পৃথিবীর দিকে তাকালে দেখবেন, আমরা কোন অবস্থায় আছি। নিম্নআয়ের মানুষের কিছু কষ্ট হচ্ছে, এটা অর্থমন্ত্রীও বলেছেন। আমরা কিন্তু এটি মাথায় রেখে এক কোটি পরিবারকে সাশ্রয়ী মূল্যে ডাল-চিনি দিয়েছি। পিয়াজের দাম যখন বেড়েছে আমরা কম দামে পিয়াজ বিক্রি করেছি। টিপু মুনশি বলেন, আমরা আশা করছি সামনে আরও ভালো কিছু হবে। তবে অন্যদের তুলনায় দেখলে আমরা ভালো আছি। বাজারে মধ্যস্বত্বভোগীরা সুযোগ নিয়ে সমস্যা তৈরি করে জানিয়ে তিনি বলেন, আমরা যেসব পণ্য ইম্পোর্ট করি তার দাম যদি বাড়ে বাজারেও এর প্রভাব পড়ে। কোথাও কোথাও সমস্যা আছে। মধ্যস্বত্বভোগীরা সুযোগ নিয়ে সমস্যা তৈরি করে।
বিদ্যুৎ-জ্বালানি ঠিকমতোই সরবরাহ করা হচ্ছে: তাজুল ইসলাম
স্থানীয় সরকারমন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম বলেছেন, দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন বেড়েছে। জ্বালানি-বিদ্যুৎ মর্যাদার জায়গায় এসেছে। আমরা ভালো ভালো শিল্প কারখানা গড়ে তুলছি। জ্বালানি-বিদ্যুৎ ঠিকমতোই সরবরাহ করা হচ্ছে।
সরকার ব্যাংক থেকে টাকা নিলে সমস্যা হবে না: গভর্নর
২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের ঘাটতি পূরণে সরকার ব্যাংক থেকে ১ লাখ ৩২ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকার ঋণ নেবে বলে লক্ষ্য ঠিক করেছে। সরকারের এই ব্যাংকঋণ নির্ভরতা নিয়ে অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকরা নানা সমালোচনা করলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বলেছেন, এ ঋণ নিলে বেসরকারি খাতে কোনো সমস্যা হবে না। এ ছাড়া মূল্যস্ফীতিও বাড়বে না। গভর্নর বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলার সংকট মোকাবিলায় প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলার বাজারে বিক্রি করেছে। তার মানে ২ লাখ কোটি টাকা বাজেট থেকে সেন্ট্রাল ব্যাংকে ঢুকে গেছে। এই টাকা যদি বাজারে থাকতো তাহলে সরকারের এক লাখ কোটি টাকা ঋণ নেয়া কোনো বিষয় হতো না। এখন যেহেতু বাজারে তারল্য সংকট রয়েছে, সেজন্য সরকার বন্ডের মাধ্যমে নিচ্ছে। তিনি বলেন, নতুন টাকা ছাপিয়ে বাজারে ছাড়লে যে মূল্যস্ফীতি বাড়বে তার কোনো সম্ভাবনা নেই। কারণ ২ লাখ কোটি টাকা তুলে এনে ৭০ হাজার কোটি টাকা ছাড়লে টাকার সরবরাহ (ক্যাসেল আউট) কম থাকছে। পুঁজিবাজারের বিষয়ে তিনি বলেন, প্রস্তাবিত বাজেটে পুঁজিবাজারের বিষয়ে সুস্পষ্ট করে কোনো পদক্ষেপের কথা উল্লেখ না থাকলেও বাজার গতিশীল রাখতে প্রয়োজনীয় নীতি সহায়তা দেয়া হচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও সরকার সেটি নিয়মিত করে যাচ্ছে।
প্রস্তাবিত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটের চূড়ান্ত আকার (ব্যয়) ধরা হয়েছে ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে আয় ৫ লাখ ৩ হাজার ৯০০ কোটি টাকা। ঘাটতি ২ লাখ ৫৭ হাজার ৮৮৫ কোটি টাকা। বাজেটে মোট ঘাটতির পরিমাণ ৫.২ শতাংশ। বাজেটে মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি’র লক্ষ্য ধরা হয়েছে ৫০ লাখ ৬ হাজার ৭৮২ কোটি টাকা।
সংবাদ সম্মেলনে অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক, পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান, স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম, শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি, বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি, শিল্পমন্ত্রী নুরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অর্থনীতি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. মশিউর রহমান, পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার, এনবিআর’র চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম, অর্থ সচিব ফাতেমা ইয়াসমিন প্রমুখ। তারা বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিয়ে অর্থমন্ত্রীকে সহায়তা করেন।