প্রথম পাতা
জাতীয় বাজেট ২০২৩-২০২৪
সুখবর নেই
স্টাফ রিপোর্টার
২ জুন ২০২৩, শুক্রবার
নানা চ্যালেঞ্জ সামনে রেখে নতুন অর্থবছরের জন্য বাজেট উপস্থাপন করেছে সরকার। গতকাল জাতীয় সংসদে ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার বাজেট জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। সাধারণত জাতীয় নির্বাচনের সময়ই ক্ষমতাসীন সরকার ভোটারবান্ধব বাজেট পেশ করে। কিন্তু নির্বাচনী বছরের জন্য প্রস্তাবিত এই বাজেটে খুব একটা সুখবর নেই সাধারণ মানুষের জন্য। প্রতিটি নির্বাচনী বছরে ভোটারদের খুশি করতে থাকে নানা খাতে কর ছাড়, প্রাপ্তির মাত্রাও থাকে বেশি। কিন্তু ভোটারদের তুষ্ট করার মতো নির্বাচনী বছরে এবার ভোটারবান্ধব বাজেট করতে পারেনি বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এর প্রধান কারণ হচ্ছে, আইএমএফ’র সঙ্গে সরকারের ঋণ চুক্তি। ওই চুক্তির কারণে কর আহরণ বাড়াতে হয়েছে।
ঋণ-নির্ভর বাজেটের আকার বাড়ায় এর অর্থ সংস্থানের চাপ ঘুরে ফিরে সাধারণ নাগরিকদের উপরই পড়বে। বাজেটে অর্থ সংস্থানের যে খাত দেখানো হয়েছে এর বড় একটি অংশ আসবে দেশি-বিদেশি ঋণ থেকে। এর মধ্যে এক লাখ কোটি টাকার বেশি বিদেশি ঋণ পাওয়ার লক্ষ্য ধরা হয়েছে। দেশের ব্যাংক খাত থেকে এক লাখ ৩২ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে বাজেট ঘাটতি পূরণের লক্ষ্য ধরা হয়েছে। টাকার মান কমা এবং মূল্যস্ফীতি বাড়ায় এবার করমুক্ত আয় সীমা বাড়িয়ে পুরুষের ক্ষেত্রে সাড়ে তিন লাখ এবং নারীর ক্ষেত্রে চার লাখ করা হয়েছে। মূল্যস্ফীতির ছয় শতাংশের মধ্যে রাখার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। নতুন অর্থ বছরে প্রবৃদ্ধি সাড়ে সাত শতাংশ হবে বলে আশা করছেন অর্থমন্ত্রী। বাজেটের প্রস্তাবিত ব্যয় বিদায়ী অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের চেয়ে ১৫.৩৩ শতাংশ বেশি। টাকার ওই অংক বাংলাদেশের মোট জিডিপি’র ১৫.২১ শতাংশের সমান। স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে জাতীয় সংসদে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের এই বাজেট প্রস্তাব উপস্থাপন করেন অর্থমন্ত্রী। তার আগে মন্ত্রিসভার অনুমোদনের পর ওই প্রস্তাবে সই করেন প্রেসিডেন্ট মো. সাহাবুদ্দিন।
বাজেট প্রস্তাব থেকে জানা গেছে, ব্যাপক হারে নতুন কর আরোপ করা হয়েছে। ভর্তুকি কমানোর শর্ত বাস্তবায়নে এ খাতেও লাগাম টেনে সরকারি সেবা ও পণ্যেও দাম বাড়িয়ে দেয়ার ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে। কর ছাড় না থাকায় বিদ্যুৎ গ্যাস ও জ্বালানির দাম আরও বাড়বে। এর প্রভাবে জীবন যাত্রার ব্যয়ও বাড়বে। এতে নির্বাচনী বছরে ভোটার তুষ্টির পরিবর্তে ভোটার অসন্তুষ্টি বাড়বে। আইএমএফ’র শর্তের কারণে এর বাইরে যাওয়ারও সুযোগ ছিল না সরকারের। এছাড়া করোনার পর অর্থনৈতিক মন্দা, রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বৈশ্বিক ও দেশীয় মন্দা তো আছেই।
‘উন্নয়নের অভিযাত্রার দেড় দশক পেরিয়ে স্মার্ট বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা’- শীর্ষক বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী বলেন, আমাদের ‘স্মার্ট বাংলাদেশে’ মাথাপিছু আয় হবে কমপক্ষে ১২ হাজার ৫০০ ডলার; দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকবে ৩ শতাংশের কম মানুষ আর চরম দারিদ্র্য নেমে আসবে শূন্যের কোঠায়; মূল্যস্ফীতি সীমিত থাকবে ৪ থেকে ৫ শতাংশের মধ্যে, বাজেট ঘাটতি থাকবে জিডিপি’র ৫ শতাংশের নিচে, রাজস্ব-জিডিপি অনুপাত হবে ২০ শতাংশের ওপরে, বিনিয়োগ হবে জিডিপি’র ৪০ শতাংশ।
শতভাগ ডিজিটাল অর্থনীতি আর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিভিত্তিক সাক্ষরতা অর্জিত হবে। সকলের দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে যাবে। স্বয়ংক্রিয় যোগাযোগ ব্যবস্থা, টেকসই নগরায়নসহ নাগরিকদের প্রয়োজনীয় সকল সেবা থাকবে হাতের নাগালে। তৈরি হবে পেপারলেস ও ক্যাশলেস সোসাইটি। সবচেয়ে বড় কথা, স্মার্ট বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত হবে সাম্য ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজব্যবস্থা।
প্রস্তাবিত বাজেটে এবার উন্নয়ন ব্যয় ১৫ শতাংশ বাড়িয়ে ধরা হয়েছে ২ লাখ ৭৭ হাজার ৫৮২ কোটি টাকা। এর মধ্যে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকার ২ লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকা।
এবার পরিচালন ব্যয় (ঋণ, অগ্রিম ও দেনা পরিশোধ, খাদ্য হিসাব ও কাঠামোগত সমন্বয় বাদে) ধরা হয়েছে ৪ লাখ ৭৫ হাজার ২৮১ কোটি টাকা, যা বিদায়ী অর্থবছরের সংশোধিত অনুন্নয়ন বাজেটের চেয়ে প্রায় ১৪.৭২ শতাংশ বেশি। এর মধ্যে ৯৪ হাজার ৩৭৬ কোটি টাকা যাবে সরকারের ঋণের সুদ পরিশোধে, যা মোট অনুন্নয়ন ব্যয়ের প্রায় ২০ শতাংশ। অনুন্নয়ন ব্যয়ের প্রায় ১৬.২০ শতাংশ প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের বেতন-ভাতা পরিশোধে ব্যয় হয়ে, যার পরিমাণ ৭৭ হাজার কোটি টাকা। প্রস্তাবিত বাজেটে রাজস্ব খাতে আয় ধরা হয়েছে ৫ লাখ ৩ হাজার ৯০০ কোটি টাকা। এই অঙ্ক বিদায়ী অর্থবছরের সংশোধিত রাজস্ব আয়ের ১৫.৫০ শতাংশ বেশি।
এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের মাধ্যমে কর হিসাবে ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা আদায় করা যাবে বলে আশা করছেন অর্থমন্ত্রী। ফলে এনবিআর’র কর আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা বাড়ছে ১৬ শতাংশের বেশি। টাকার ওই অঙ্ক মোট বাজেটের ৫৬.৪৪ শতাংশের মতো।
বাজেটে সবচেয়ে বেশি কর আদায়ের লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট থেকে ১ লাখ ৬৩ হাজার ৮৩৭ কোটি টাকা। এই অঙ্ক বিদায়ী অর্থবছরের সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ১২ শতাংশের মতো বেশি। বিদায়ী অর্থবছরের বাজেটে ভ্যাট থেকে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য ধরা ছিল ১ লাখ ৪১ হাজার ১৯২ কোটি টাকা। সংশোধনে তা বাড়িয়ে ১ লাখ ৪৬ হাজার ২২৭ কোটি টাকা করা হয়। আয়কর ও মুনাফার ওপর কর থেকে ১ লাখ ৫৩ হাজার ২৬০ কোটি টাকা রাজস্ব পাওয়ার আশা করা হয়েছে এবারের বাজেটে। বিদায়ী সংশোধিত বাজেটে এর পরিমাণ ছিল ১ লাখ ২১ হাজার ৯৪ কোটি টাকা।
প্রস্তাবিত বাজেটে আমদানি শুল্ক থেকে ৪৬ হাজার ১৫ কোটি টাকা, সম্পূরক শুল্ক থেকে ৬০ হাজার ৭০৩ কোটি টাকা, রপ্তানি শুল্ক থেকে ৬৬ কোটি টাকা, আবগারি শুল্ক থেকে ৪ হাজার ৫৭৯ কোটি টাকা এবং অন্যান্য কর ও শুল্ক থেকে ১ হাজার ৫৪০ কোটি টাকা আদায়ের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। এ ছাড়া বৈদেশিক অনুদান থেকে ৩ হাজার ৯০০ কোটি টাকা পাওয়া যাবে বলে বাজেট প্রস্তাবে বলা হয়েছে।
বিদায়ী অর্থবছরের মূল বাজেটে মোট রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য ধরা হয়েছিল ৪ লাখ ৩৬ হাজার ২৭১ কোটি টাকা, সংশোধনে তা সামান্য কমিয়ে ৪ লাখ ৩৬ হাজার ২৬৩ কোটি টাকা করা হয়।
নতুন অর্থবছরের জন্য অর্থমন্ত্রী যে বাজেট প্রস্তাব করেছেন এতে আয় ও ব্যয়ের সামগ্রিক ঘাটতি থাকছে রেকর্ড ২ লাখ ৫৭ হাজার ৮৮৫ কোটি টাকা, যা মোট জিডিপি’র ৫.২ শতাংশের সমান। বাজেট ঘাটতি পূরণে অভ্যন্তরীণ এবং বৈদেশিক ঋণের ওপর নির্ভর করতে হবে। প্রস্তাবে বলা হয়, বিদেশ থেকে ১ লাখ ২৭ হাজার ১৯০ কোটি টাকা এবং অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ১ লাখ ৫৫ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা ঋণ করে ওই ঘাটতি পূরণ করা হবে।
অভ্যন্তরীণ খাতের মধ্যে ব্যাংকিং খাত থেকে ১ লাখ ৩২ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা, সঞ্চয়পত্র থেকে ১৮ হাজার কোটি টাকা এবং অন্যান্য খাত থেকে আরও ৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেয়ার লক্ষ্য ধরা হয়েছে বাজেটে।
বড় বাজেটে রাজস্ব আহরণেরও বড় লক্ষ্যমাত্রা দেয়া হয়েছে। এরপরও বিশাল অঙ্কের ঘাটতি রয়েছে। ফলে সরকার ব্যয়, আয় এবং ঘাটতির যে প্রক্ষেপণ করেছে তাতে টানাটানি করে করা হয়েছে বলে মনে করেন দেশের অর্থনীতিবিদরা। তারা বলেছেন, এটি আইএমএফ’র শর্ত পূরণ করতে গিয়েই এই টানাটানি করতে হয়েছে। এখন আইএমএফ’র শর্ত মেনে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে ৪৮ হাজার কোটি টাকার অতিরিক্ত কর আদায় করতে হবে। এ জন্য এনবিআরকে আরও কঠোর হতে হবে। বাস্তবায়ন করতে হবে আরও অনেক শর্ত।
অন্যদিকে দেশে মূল্যস্ফীতি এখনো ৯ শতাংশের বেশি। আইএমএফ’র শর্ত মেনে নানা খাতে ভর্তুকি যদি আরও কমে, তবে মানুষের ব্যয় বাড়বে। এরমধ্যে ঠিক করা হয়েছে, ৪৪ ধরনের সরকারি সেবা পেতে হলে আয়কর রিটার্ন দাখিলের প্রমাণ দিতে হবে। সেক্ষেত্রে সর্বনিম্ন করের হারও বেঁধে দেয়া হয়েছে। মধ্যবিত্তের খরচ বাড়ার সব ইঙ্গিতই রয়েছে বাজেটে। সুতরাং একজন সাধারণ ভোটার শেষপর্যন্ত এই বাজেটে কতোটা খুশি হবেন, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।
এবারের বাজেটে জনতুষ্টির খুব সীমিত কিছু পদক্ষেপের কথা বলা হয়েছে। বেশির ভাগ পদক্ষেপই জনভোগান্তি বাড়াবে। আইএমএফ’র শর্ত বাস্তবায়নের ফলে গ্যাস, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি তেলের দাম বাড়বে। এর প্রভাবে সব ধরনের পণ্য ও সেবার দাম বাড়বে। ডলারের দাম ও সুদের হারও বাড়বে। এতে শিল্পের ও ব্যবসার খরচ বাড়বে। সব মিলে পণ্যমূল্যকে আরও উস্কে দেবে, যা মোকাবিলা করার মতো যথেষ্ট পদক্ষেপ নেই বলে মনে করছেন দেশের শীর্ষ অর্থনীতিবিদরা।
এদিকে সরকারি দল আওয়ামী লীগ প্রস্তাবিত বাজেটকে ‘জনবান্ধব’ বলে আখ্যায়িত করেছে। দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘জনবান্ধব এ জন্য বলেছি, কারণ সাধারণ মানুষের কথা মাথায় রেখে এ বাজেট প্রণীত হয়েছে। অন্যদিকে প্রস্তাবিত বাজেটকে বিএনপি বলেছে, স্মার্ট লুটপাটের বাজেট। এই বাজেটে দেশের মানুষের চিন্তার প্রতিফলন ঘটবে না বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী।