প্রথম পাতা
বাংলাদেশের ভোটের আগে যুক্তরাষ্ট্রের বাজি
মাইকেল কুগেলম্যান
২ জুন ২০২৩, শুক্রবার
বাংলাদেশে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিতের লক্ষ্যে গত সপ্তাহে একটি নতুন ভিসা নীতি ঘোষণা করেছেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন। ওই ঘোষণায় বলা হয়, বাংলাদেশে কেউ যদি নির্বাচনকে বাধাগ্রস্ত করা ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে ক্ষতিগ্রস্ত করার প্রচেষ্টায় যুক্ত থাকে তাহলে যুক্তরাষ্ট্র তার ভিসা প্রত্যাখ্যান করবে। আগামী জানুয়ারিতে বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন হওয়ার কথা।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিরোধী দল, গণমাধ্যম এবং ভিন্নমতের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছেন। ২০১৪ ও ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশের আগের দু’টি নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ রয়েছে। যদিও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন এই পদক্ষেপ বিস্ময়কর কিছু ছিল না। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের অনেকেই নিয়মিত যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণ করেন। শেখ হাসিনাসহ কয়েকজনের পরিবারের সদস্যও আছেন এরমধ্যে।
যুক্তরাষ্ট্রের জো বাইডেন প্রশাসনের পররাষ্ট্রনীতিতে বিশ্বজুড়ে মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের প্রচারের উপর জোর দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশের জন্য এই ভিসা নীতি ঘোষণাও তারই অংশ। যুক্তরাষ্ট্র সাধারণত বেছে বেছে এই নীতির প্রয়োগ করে। উদাহরণ স্বরূপ, নয়াদিল্লির গণতান্ত্রিক পদ্ধতি থেকে ক্রমশ সরে আশা নিয়ে ওয়াশিংটন প্রকাশ্যে খুব কমই বলেছে। তবে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে যে নীতিটি ঘোষণা করা হয়েছে তা শক্তিশালী ও দৃঢ়।
বাইডেন প্রশাসন বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করার চেষ্টা করেছে যাতে চীনের অর্থনৈতিক সহায়তার উপর বাংলাদেশের নির্ভরতা কমে যায়। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সঙ্গে সকল দ্বিপক্ষীয় সম্পৃক্ততার ক্ষেত্রে গণতন্ত্রকে সবার আগে রেখেছে। মার্কিন কর্মকর্তারা বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক পদ্ধতি থেকে পশ্চাদপসরণের সমালোচনা করেছেন। ওয়াশিংটন সমালোচনার পাশাপাশি শাস্তি দিতেও যে ভয় পায়না তার উদাহরণ হচ্ছে, ২০২১ সালে মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য বাংলাদেশের আধা-সামরিক বাহিনী র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল দেশটি।
বাইডেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের গুরুত্বের কথা বলেন। কিন্তু নির্বাচনে কারচুপি হলে বাংলাদেশের জন্য মার্কিন নীতির পরিবর্তন হবে কিনা তা তারা এখনই নির্ধারণ করতে চান না। যদিও নতুন ভিসা নীতি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করার জন্য বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতাদের ওপরে শক্তিশালী চাপ তৈরি করবে।
বাংলাদেশে গণতন্ত্রকে উৎসাহিত করতে মার্কিন প্রচেষ্টা বেশ নড়বড়ে। ঢাকা ওয়াশিংটনের সমালোচনার পর কখনও ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া জানায়নি। বাংলাদেশের কিছু পরিচিত মানুষ আমাকে বলেছেন যে, যুক্তরাষ্ট্র শেখ হাসিনার ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ দলের প্রতি বিরক্ত এবং জানুয়ারিতে বিরোধী দল বিএনপি’র জয়কেই তারা পছন্দ করবে। গত মাসে একটি সংসদীয় ভাষণে শেখ হাসিনা পরোক্ষভাবে ওয়াশিংটনের বিরুদ্ধে তার সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার চেষ্টার অভিযোগ করেন।
নতুন ঘোষিত ভিসা নীতিতে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনকে বাধা দেয় এমন ‘যেকোনো’- ব্যক্তির জন্য এই নীতি প্রযোজ্য হবে। বাংলাদেশে যদিও সরকারি এবং বিরোধীদলীয় নেতারা উভয়েই এই নীতির পক্ষে অনুকূল প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। উভয় পক্ষই বলছে যে, এই নীতিতে তাদের বিরোধীরাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তবে বাইডেনের এই ‘মূল্যবোধ-ভিত্তিক’ বৈদেশিক নীতি বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের উত্তেজনাকে উস্কে দিতে পারে।
বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস এই নীতিকে ‘পাবলিক ডিপ্লোমেসি’র সাফল্য হিসেবে চিত্রিত করেছেন। ওয়াশিংটন এবং ঢাকা উভয়ই যে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে একমত তাই প্রমাণিত হয়েছে। তবুও প্রশ্ন উঠছে যে, কেন বাইডেন প্রশাসন ঢাকাকে তার গণতন্ত্র প্রচারের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করেছে! কারণ, বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক শক্তিশালী করতে আগ্রহী ওয়াশিংটন, যেখানে এই নতুন পদক্ষেপ সেই সম্পর্ককে ঝুঁকিতে ফেলে দিতে পারে। বাংলাদেশ চীনের মতো প্রতিদ্বন্দ্বী দেশও নয়, মিয়ানমারের মতো বিচ্ছিন্ন দেশও নয়।
এর উত্তর আসলে বেশ সহজ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বাস করে যে, বাংলাদেশ মানবাধিকার এবং গণতন্ত্র নিয়ে ওয়াশিংটনের দীর্ঘ দিনের উদ্বেগকে শনাক্তই করেনি। বাইডেন প্রশাসনের আগে থেকেই এই উদ্বেগের কথা বলে আসছে যুক্তরাষ্ট্র। সাম্প্রতিক এই পদক্ষেপ হয়তো শুধুমাত্র যুক্তরাষ্ট্রের নীতির ধারাবাহিকতা বজায় রাখা এবং স্ক্রুগুলিকে কিছুটা টাইট দেয়া।
এটাও স্পষ্ট যে, বাংলাদেশকে গণতন্ত্রের এজেন্ডা চাপিয়ে দিলে দেশটিকে চীনের দিকে ঠেলে দেয়ার ঝুঁকি বৃদ্ধি পাবে। সাম্প্রতিক বছরগুলিতে বাংলাদেশি পণ্য সবথেকে বেশি রপ্তানি হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে। আবার বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগের সবচেয়ে বড় উৎসও যুক্তরাষ্ট্র। ঢাকা চীনের অবকাঠামোগত সহায়তাকে প্রাধান্য দিতে পারে, তবে ওয়াশিংটনের সঙ্গে এর বাণিজ্যিক অংশীদারিত্বও গুরুত্বপূর্ণ। তাছাড়া শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। ঢাকা এই তিন শক্তির সঙ্গে সম্পর্কের ভারসাম্য বজায় রাখতে চায়।
ভূ-রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশ বাদ দিলেও প্রশ্ন উঠে যে, নতুন মার্কিন ভিসা নীতি সত্ত্বেও যদি বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু না হয় তাহলে কী হবে? এমন পরিস্থিতিতে হয়তো ওয়াশিংটন ঢাকার প্রতি তার নীতি পুনর্মূল্যায়ন করতে বাধ্য হবে।
(ফরেন পলিসিতে প্রকাশিত মাইকেল কুগেলম্যানের লেখা থেকে অনূদিত। তিনি ফরেন পলিসির সাপ্তাহিক ‘সাউথ এশিয়া ব্রিফের’ লেখক। এছাড়া তিনি উইলসন সেন্টারের সাউথ এশিয়া ইনস্টিটিউটের পরিচালক।)