ঢাকা, ২৮ মার্চ ২০২৪, বৃহস্পতিবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ, ১৭ রমজান ১৪৪৫ হিঃ

প্রথম পাতা

নতুন শিক্ষাক্রম

ভুল নিয়েই পাঁচ মাস পার, প্রশিক্ষণ কার্যক্রমও হচ্ছে না

পিয়াস সরকার
৩১ মে ২০২৩, বুধবার

শিক্ষার আমূল পরিবর্তনের মূলমন্ত্র নিয়ে চলতি বছর শুরু হয় নতুন শিক্ষাক্রম। নতুন শিক্ষাক্রম ও এর পরিকল্পনা নিয়ে আশাবাদী ছিলেন অনেকে। কিন্তু শুরুতেই হোঁচট খায় নতুন পাঠ্যসূচির নতুন বই নিয়ে। ভুলে ভরা পাঠ্য বইয়ের দুটি ইতিমধ্যে প্রত্যাহার করে নেয়া হয়েছে। সংশোধন করা হয়েছে অন্যগুলো। এই ভুল সংশোধন নিয়ে পার হয়ে গেছে বছরের প্রথম ৫ মাস। নতুন পাঠ্যসূচি নিয়ে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ কার্যক্রমও এগুচ্ছে না। গত বছরের নভেম্বরে শিক্ষক প্রশিক্ষণ শেষ হবার কথা থাকলেও চলতি বছরের মে মাসেও প্রশিক্ষণের বাইরে রয়ে গেছে প্রায় সাড়ে ৬ লাখ শিক্ষক। প্রথম বছরে প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণি দিয়ে শুরু হয় নতুন শিক্ষাক্রম।

বইয়ের ভুল নিয়ে আলোচনা নতুন কিছু নয়। তবে এ বছরের বইয়ের ভুলের মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে অন্যান্য বছরের ভুলকেও।

বিজ্ঞাপন
প্রায় প্রতিটি বইয়ে দেয়া হয়েছে একাধিক সংশোধনী। সর্বশেষ সংশোধনী দেয়া হয় ২৮শে এপ্রিল। পাঠ্য বইয়ে ভুলের কারণে বাতিল করা হয় ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির ‘ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুসন্ধানী পাঠ’। শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে গঠন করা হয়েছিল তদন্ত কমিটি। এই কমিটির রিপোর্টে দেখা যায় ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির চার বইয়ে ৫৮টি অসঙ্গতিসহ ১৮৮টি ভুল। এই বইয়ের সংশোধনী দেয়া হয় শিক্ষাবর্ষের ৪ মাস পেরিয়ে যাবার পর।

জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) সূত্র জানায়, নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে শিক্ষকদের অনলাইন ও সরাসরি ৫ দিনব্যাপী প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। আবার প্রশিক্ষণ পাওয়া শিক্ষকরাও বলছেন, যে প্রশিক্ষণ মিলেছে তা পর্যাপ্ত নয়। রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলার এক শিক্ষক বলেন, প্রশিক্ষণ আমরা নিয়েছি। কিন্তু এই প্রশিক্ষণে আমাদের প্রাথমিক ধারণাটাও মেলেনি। অনলাইনে যে প্রশিক্ষণ হয়েছে এটার কোর্স ডিজাইন ছিল অত্যন্ত বোরিং। তিনি বলেন, আমাদের ধরে ধরে নির্দেশনা দেয়া উচিত এই বিষয়ে এভাবে পাঠদান করাতে হবে। 

একই জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিক্ষক হোসাইন মোহাম্মদ মূল্যায়ন নিয়ে বিপাকে আছেন উল্লেখ করে বলেন, অনেক সময় ক্লাসে শিক্ষার্থীরা বলে বসছে স্যার এগুলোর পরীক্ষা তো এভাবে নেবার কথা নয়। শিক্ষার্থীরা এগুলো বলার পর আমি রাগান্বিত হয়ে চুপ করিয়ে দেই। এরপর নিজে থেকে সিদ্ধান্ত নিয়ে পরবর্তী ক্লাসে ভুল থাকলে সংশোধন করে দেই। কিন্তু সমস্যাটা হচ্ছে কোনটা ভুল করছি আর কোনটা সঠিক করছি তাই বুঝতে পারছি না।

তিনি বলেন, নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে আমরা ট্রেনিং করেছি মাত্র ৫ দিন। এ ট্রেনিং মোটেও কাজে দেয়নি। আবার যারা ট্রেনিং করেননি তাদের ট্রেনিং করিয়েছি আমরা। বিষয়টা এমন আমরা নিজেরাই সঠিকভাবে বুঝতে পারিনি। আবার আমরাই ট্রেনিং করিয়েছি অন্যদের। আমাদের নিয়মিতভাবে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করতে হচ্ছে। নিয়মিত এই মূল্যায়ন আপ করতে হচ্ছে অনলাইনে। এর মাধ্যমে অটোমেটিক পদ্ধতিতে ফল চলে আসবে। নতুন এই শিক্ষাক্রম নিঃসন্দেহে ভালো। এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া, নেতৃত্ব গুণ, খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক প্রতিভা সবই ফুটে উঠছে। প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সৃজনশীল যখন আসলো আমরা দীর্ঘ সময় অন্ধকারে ছিলাম। কয়েকটা ব্যাচ এই সৃজনশীলের কোনো সফলতা পায়নি। এবারও একইভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। এটা তো বলাই যায়, প্রথম বছর যারা নতুন শিক্ষাক্রম পেয়েছে তারা ধোঁয়াশা নিয়েই বছর শেষ করবে।

শিক্ষার্থীরা নতুন শিক্ষাক্রম উপভোগ করছে। তবে তাদের সুনির্দিষ্ট কোনো পরিকলল্পনা না থাকায় যাচ্ছে তাই অবস্থা। ফরিদপুর জিলা স্কুলের সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী আলিফ হাসান বলেন, এই শিক্ষাক্রমে আগের মতো চাপ নাই। লেখাপড়া অনেক কম। ক্লাসেই কখনো গ্রুপ কিংবা কখনো এককভাবে এর উত্তর দিতে হয়।

ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির অভিভাবকদেরও কাছে নেই সুনির্দিষ্ট কোনো পরিকল্পনা। সাবেরা খান নামে এক অভিভাবক বলেন, ছেলেকে যে পড়াবো, কী পড়াবো? কীভাবে পড়াবো? কিছুই জানি না। ছেলে আর পড়তেই বসছে না। বললে বলে, পড়া সব ক্লাসে হয়ে গেছে। তিনি দাবি করে বলেন, শিক্ষকদের পাশাপাশি অভিভাবকদের একটা প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকা জরুরি। এমনকি এটা অভিভাবকদের জন্য অনলাইনে একটা ধারণামূলক ভিডিও বা কোর্স হলেও চালু করা প্রয়োজন। তিনি বলেন, নতুন শিক্ষাক্রম আমি কীভাবে সন্তানকে গাইড করবো সেটাতো আমাদের সঠিক ধারণা থাকতে হবে।

একদিন পরেই শেষ ২০২৩ সালের মে মাস। বছরের ৫টি মাস চলে গেলেও এখনো প্রশিক্ষণের আওতার বাইরে লাখো শিক্ষক। বইজুড়ে আলোচনায় বইয়ের ভুল ও সংশোধনী। বই নিয়ে বিতর্ক শুরু হয় বছরের প্রথম দিন থেকেই। সময়মতো বই না মেলা, নিম্নমানের কাগজ দিয়ে বই নিয়ে সমালোচনা হয়। অনেক শিক্ষার্থীর হাতে বই পৌঁছাতে এপ্রিল মাস পর্যন্ত লেগে যায়।
শিক্ষাবিদরা বলছেন, নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের আগে শিক্ষক প্রশিক্ষণ কার্যক্রম শেষ করা উচিত ছিল।  মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) থেকে জানা যায়, ‘ডেসিমনেশন অব নিউ কারিকুলাম স্কিম’ প্রকল্পের আওতায় মাধ্যমিক পর্যায়ে সারা দেশে শ্রেণিশিক্ষক, প্রধান শিক্ষক, মাস্টার ট্রেইনারদের অনলাইন ও সরাসরি প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। সর্বশেষ প্রকাশিত তথ্যানুুযায়ী (৮ই মে), ১ লাখ ৩৮ হাজার ৫২৬ জন শিক্ষকের প্রশিক্ষণ বাকি। এর মধ্যে শ্রেণিশিক্ষক রয়েছেন ১ লাখ ৩৭ হাজার ২১০ জন, উপজেলা প্রশিক্ষক ৮৮০ জন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান ৪ হাজার ৪৩৬ জন। 

প্রাথমিক পর্যায়ে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশাপাশি কিন্ডারগার্টেন স্কুল এবং ইবতেদায়ী মাদ্রাসার শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা করছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর (ডিপিই)। সেকেন্ডারি এডুকেশন ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রামের বাস্তবায়ন অগ্রগতি পর্যালোচনা সভা থেকে জানা যায়, ডিপিই সাড়ে ৭ লাখের বেশি শিক্ষককে এই প্রশিক্ষণের আওতায় আনবে। ৮ই মে পর্যন্ত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও কিন্ডারগার্টেনের ৩ লাখ ৪৪ হাজার ৮৩৭ শিক্ষকের প্রশিক্ষণ এখনো বাকি। আর বেসরকারি ইবতেদায়ী মাদ্রাসার ১ লাখ ২০ হাজার ৫৯৮ জন শিক্ষকের প্রশিক্ষণ এখনো বাকি।

ওই সভায় ডেসিমনেশন অব নিউ কারিকুলাম স্কিমের পরিচালক অধ্যাপক সৈয়দ মাহফুজ আলী মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষক প্রশিক্ষণের অগ্রগতি প্রতিবেদন তুলে ধরে বলেন, জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা ২০২১-এর আলোকে প্রণীত ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির পরিমার্জিত শিক্ষাক্রম-২০২৩ শিক্ষাবর্ষে বাস্তবায়নের নিমিত্তে নভেম্বর ২০২২-এর মধ্যে জেলাপর্যায়ের প্রশিক্ষক প্রশিক্ষণের বাধ্যবাধকতা ছিল।
এ বিষয়ে এনসিটিবি সদস্য (প্রাথমিক শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক ড. এ কে এম রিয়াজুল হাসান বলেন, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষকের প্রশিক্ষণ কার্যক্রম শেষ। আর যেসব শিক্ষক এখনো প্রশিক্ষণের বাইরে রয়েছেন, তারা বেসরকারি কিন্ডারগার্টেন ও ইবতেদায়ী মাদ্রাসার শিক্ষক।

এনসিটিবি সদস্য (শিক্ষাক্রম) মো. মশিউজ্জামান বলেন, এসএসসি পরীক্ষা, রমজানসহ বিভিন্ন কারণে ট্রেনিং কার্যক্রম সঠিক সময়ে শেষ করা সম্ভব হয়নি। আশা করছি, খুব শিগগিরই ট্রেনিং কার্যক্রম শেষ করা সম্ভব হবে।

প্রথম পাতা থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

   

প্রথম পাতা সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status