প্রথম পাতা
নতুন ভিসা নীতি নিয়ে সাধারণের ভয়ের কিছু নেই
কূটনৈতিক রিপোর্টার
৩১ মে ২০২৩, বুধবার
নিজের এবং মার্কিন দূতাবাসের নিরাপত্তা বিষয়ক প্রশ্নের জবাব এড়িয়ে গেলেন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস। তবে তিনি জোর দিয়ে বললেন, নতুন ভিসা নীতি নিয়ে সাধারণের ভয়ের কিছু নেই। বাংলাদেশের মানুষের কাক্সিক্ষত আসন্ন নির্বাচনকে অবাধ ও সুষ্ঠু অর্থাৎ সুষ্ঠু নির্বাচনকে উৎসাহিত করতে এ নীতি প্রণয়ন করা হয়েছে। এমন নির্বাচনের বিষয়ে স্পষ্ট অঙ্গীকার রয়েছে প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে সরকারের দায়িত্বশীল বিভিন্ন পর্যায়ের। বাংলাদেশের মানুষের মতোই যুক্তরাষ্ট্র এখানে একটি অবাধ, সুষ্ঠু এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দেখতে চায় বলে জানান রাষ্ট্রদূত পিটার হাস।
বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে রাজধানীর ইএমকে সেন্টারে গতকাল আলোকচিত্র প্রদর্শনীর ফাঁকে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে রাষ্ট্রদূত এ মন্তব্য করেন। পিটার হাস খোলাসা করেই বলেন, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং মার্কিন ভিসা নীতি সেই প্রতিশ্রুতিকেই সমর্থন করে। এটা বাংলাদেশের জনগণের জন্যই। গত ২৪শে মে বাংলাদেশের জন্য নতুন ভিসা নীতি ঘোষণা করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। সেই ঘোষণা অনুযায়ী নির্বাচনে কারচুপি, ভীতি প্রদর্শন এবং নাগরিক ও গণমাধ্যমের বাকস্বাধীনতায় যারা বাধা দেবে, তাদের বিরুদ্ধে মার্কিন ভিসা নিষেধাজ্ঞা দেয়া হতে পারে। রাষ্ট্রদূত বলেন, বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনে সহায়তা করতে আগ্রহী এমন আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের স্বাগত জানায় যুক্তরাষ্ট্র। প্রদর্শনীর উদ্বোধনীতে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম এমপি, বিএনপি নেতা আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, আওয়ামী লীগ নেতা শাম্মী আহমেদ প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
দীর্ঘ বক্তৃতায় রাষ্ট্রদূত যা বললেন-: রাজধানীর ধানমণ্ডিস্থ এডওয়ার্ড এম কেনেডি সেন্টারে ‘বন্ধুত্বের শেকড়: যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ সম্পর্কের ৫০ বছর’ শীর্ষক আলোকচিত্র প্রদর্শনীর উদ্বোধনীতে দেয়া বক্তব্যে মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস বলেন, যুক্তরাষ্ট্র সরকারের পক্ষ থেকে আজকের এই প্রদর্শনীর উদ্বোধন করতে পেরে আমি সম্মানিত বোধ করছি- যেখানে দুই মহান দেশ যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের মধ্যে ক্রমপ্রসারমাণ যাত্রার আদি থেকে শুরু করে এর বিভিন্ন পথরেখা তুলে ধরা হয়েছে। এই প্রদর্শনীর মধ্যদিয়ে এগিয়ে যেতে যেতে আপনি দেখতে পাবেন এগুলো শুধু অতীতের কিছু ঘটনার ছবি নয়, বরং এগুলো আমাদের দীর্ঘস্থায়ী সম্পর্ক ও দু’দেশের মানুষের মধ্যেকার মেলবন্ধনের সাক্ষ্য যা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আরও শক্তিশালী হয়েছে। তিনি বলেন, এই দুই দেশের মধ্যেকার বন্ধুত্বকে তুলে ধরার লক্ষ্যে আয়োজিত এই আলোকচিত্র প্রদর্শনীর তত্ত্বাবধানে সহায়তার জন্য প্রায় দুই বছর আগে আমরা যুক্তরাষ্ট্রের অলাভজনক সংস্থা মেরিডিয়ান ইন্টারন্যাশনাল সেন্টারের সঙ্গে এই বিশেষ সহযোগিতা কার্যক্রম শুরু করেছিলাম। ব্যাপকভিত্তিক ও সতর্ক গবেষণার মাধ্যমে আমরা শত শত ছবির মধ্য থেকে ৫০টি ব্যতিক্রমী ছবি নির্বাচন করেছি যার প্রতিটির মধ্যে আছে একটি গল্প, তুলে ধরার মতো একটি বার্তা, আর আছে সেই বন্ধন যা আমাদেরকে একত্র করে রেখেছে। আমাদের এই প্রদর্শনীর ভেতরে এগিয়ে যেতে যেতে আপনি দেখতে পাবেন বাংলাদেশি ও আমেরিকানদের মধ্যেকার নিত্যদিনের বন্ধুত্ব ও সহযোগিতার আদি শেকড় সংবলিত বিভিন্ন ছবি।
পিটার হাস বলেন, আমরা সবাই “নলাকৃতি নকশার জনক” ড. ফজলুর আর. খানের রেখে যাওয়া মহান কর্মগুলো সম্পর্কে জানি। কিন্তু আপনি কি জানেন যে, তিনি বাংলাদেশের প্রথম ফুলব্রাইট বৃত্তিপ্রাপ্ত শিক্ষার্থী ছিলেন? তিনি ১৯৫২ সালে যখন যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েছিলেন তখন তিনি আমার নিজ রাজ্য ইলিনয়ে লেখাপড়া করেছেন। শিক্ষায়তনিক আদান-প্রদানের মাধ্যমে আমাদের দেশ দুটি যেভাবে বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিকভাবে সমৃদ্ধ হয়েছিল তার বহু অসামান্য উদাহরণের মাত্র কয়েকটি এখানে তুলে ধরা হয়েছে। এটি শুরু হয়েছিল ১৯৪০ সালের দিকে অর্থাৎ বাংলাদেশের স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশের ৩০ বছরেরও বেশি আগে। দীর্ঘদিনের শিক্ষায়তনিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক অংশীদারিত্বের কারণে আমরা এখন গর্ব করে একথা বলতেই পারি যে, বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা যুক্তরাষ্ট্রকে তাদের উচ্চশিক্ষার জন্য শীর্ষস্থান হিসেবে বেছে নিয়েছে। বাংলাদেশের নাগরিকদের স্বাস্থ্যের অবস্থা উন্নয়নে যুক্তরাষ্ট্র অন্যতম প্রধান অংশীদার হিসেবে রয়েছে।
প্রদর্শনীতে এক আমেরিকান ডাক্তারের একটি দুর্লভ ছবি প্রদর্শিত হয়েছে। ছবিতে তিনি ১৯৬৮ সালে ঢাকার কলেরা রিসার্চ সেন্টার পরিদর্শনরত এক দর্শনার্থীর সঙ্গে আছেন। কলেরা নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূলের লক্ষ্যে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার তিনটি গবেষণাগারের অন্যতম এই প্রতিষ্ঠানটি ইউএসএআইডি’র আরেকটি প্রয়াস। আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ হিসেবে পুনঃনামকরণকৃত এবং সাধারণভাবে ও সহজ উচ্চারণে আইসিডিডিআর’বি’ নামে পরিচিত এ প্রতিষ্ঠানটি এখন এ অঞ্চলের অন্যতম সেরা স্বাস্থ্য গবেষণা প্রতিষ্ঠান হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। কোভিড-১৯ মহামারি মোকাবিলায় ইউএসএআইডি ৫০,০০০-এরও বেশি স্বাস্থ্যসেবা কর্মীকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে এবং বাংলাদেশের জনগণকে এই মহামারি থেকে সুরক্ষা দিতে এ সংক্রান্ত সহায়তা হিসেবে প্রায় ১৫ কোটি ডলার প্রদান করেছে। আমার মনে আছে, যুক্তরাষ্ট্রের অনুদানে প্রাপ্ত বহু টিকা চালানের একটির বিতরণ উপলক্ষে মেয়র ড. সেলিনা হায়াৎ আইভীর সঙ্গে আমি নারায়ণগঞ্জ কালেক্টরেট প্রিপারেটরি স্কুল পরিদর্শনে গিয়েছিলাম।
মহামারি শুরু হওয়ার পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে কোভিড-১৯’র সাড়ে ১১ কোটিরও বেশি টিকা বিনামূল্যে অনুদান দিয়েছে যা আন্তর্জাতিক পর্যায় থেকে বাংলাদেশের পাওয়া করোনাভাইরাসের টিকা অনুদানের ৭০ শতাংশেরও বেশি। স্বাধীনতার পর থেকে সক্রিয় ইউএসএআইডি বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম ও সবচেয়ে সফল উন্নয়ন সহায়তা কার্যক্রম হিসেবে রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সরকারের ঔদার্য ও বিনিয়োগ এখানে মানুষের জীবন বাঁচিয়েছে- হোক সেটা দেশের স্বাধীনতার পর খাদ্য সহায়তা অথবা দুর্যোগ মোকাবিলায় ঝুঁকি-সহিষ্ণুতা জোরদারকরণ ও স্বাস্থ্যসেবার মান উন্নতকরণের সাম্প্রতিক প্রচেষ্টা যাতে সারা দেশের পরিবারগুলো দীর্ঘ ও স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন করতে পারে।
গণতান্ত্রিক মূলনীতির প্রচার, সুশীল সমাজ শক্তিশালীকরণ এবং স্থানীয় সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোকে তাদের নির্বাচনী এলাকায় আরও কার্যকর সেবাদানে সহায়তা করার জন্যও যুক্তরাষ্ট্র বিনিয়োগ করে থাকে। খুলনার স্থানীয় জেলেদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনাকালে তোলা আমাদের বর্তমান কৃষি অ্যাটাশে মেগান ফ্রান্সিকের একটি ছবি দেখতে পেয়ে আমি অত্যন্ত আনন্দিত। এই ছবিগুলো কূটনীতি, উন্নয়ন ও মানবিক সহায়তা এবং মানুষে-মানুষে সম্পর্কসহ পুরো সময়জুড়ে দু’দেশের মধ্যেকার বন্ধন কীভাবে জোরদার করা হয়েছে তারই প্রমাণ। তিনি বলেন, আপনি মুগ্ধ হবেন ১৯৭৪ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের যুক্তরাষ্ট্র সফরের ঐতিহাসিক ছবি দেখে। এটাই ছিল যুক্তরাষ্ট্রের কোনো প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বাংলাদেশের কোনো রাষ্ট্রপ্রধানের প্রথম সাক্ষাৎ। বিয়াল্লিশ বছর পর ৫ই মে ২০১২, বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি রডহ্যাম ক্লিনটনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের মধ্যে সম্পর্ক গভীর করতে যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ অংশীদারিত্ব সংলাপে স্বাক্ষর করেন।
এ প্রদর্শনীতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিত্বকারী পূর্ববর্তী অন্যান্য বাংলাদেশি রাষ্ট্রপ্রধানদের যুক্তরাষ্ট্র সফরকালীন বিভিন্ন ঐতিহাসিক ছবিও প্রদর্শিত হয়েছে। এই ছবিগুলোতে সুশাসন, বিভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রতি সম্মান ও কার্যকরী গণতন্ত্রের অন্যতম স্তম্ভ হিসেবে মত প্রকাশের স্বাধীনতার প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গীকারের বিষয়টি গুরুত্ব পেয়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশ দীর্ঘস্থায়ী অংশীদারিত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে এবং যুক্তরাষ্ট্রের বহু কোম্পানি ১৯৭১ সালের আগে থেকেই বাংলাদেশে কাজ করছে।
ওয়াশিংটন, ডিসিতে ২০১৩ সালে তোলা গুরুত্বপূর্ণ একটি ছবিতে যুক্তরাষ্ট্রের ভারপ্রাপ্ত ডেপুটি ট্রেড রিপ্রেজেন্টেটিভ ওয়েন্ডি কাটলার ও বাংলাদেশের বাণিজ্য সচিব মাহবুব আহমেদকে ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট কো-অপারেশন ফোরাম চুক্তি (টিকফা) স্বাক্ষর করতে দেখা যাচ্ছে। অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও উন্নয়নে ব্যাপক মাত্রা অর্জনের লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্র টিকফা’র মাধ্যমে বাংলাদেশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করে যাচ্ছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫১তম বার্ষিকী উপলক্ষে সেক্রেটারি ব্লিনকেন বলেন, ‘আমাদের উভয় দেশেরই অভ্যুদয় ঘটেছে স্বাধীনতার জন্য সর্বাত্মক যুদ্ধের মাধ্যমে এবং আমরা উভয় দেশই আমাদের প্রতিষ্ঠাকালীন গণতান্ত্রিক আদর্শ নিয়েই বেঁচে থাকার চেষ্টা করি। গত পাঁচ দশক ধরে আমাদের অব্যাহত সহযোগিতা বর্তমান ও আগামী প্রজন্মের জন্য একটি নিরাপদ ও আরও সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করছে।’
মার্কিন দূত বলেন, আজ ৫০ বছরেরও বেশি সময়ের বন্ধুত্বের স্মারক এই ঐতিহাসিক আলোকচিত্র প্রদর্শনীর উদ্বোধনকালে আমি সুশাসন ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশকে সহায়তা দেয়ার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করছি। এ ধরনের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রদর্শনী আয়োজনে অমূল্য সহায়তার জন্য মেরিডিয়ান ইন্টারন্যাশনাল সেন্টারকে আমি ধন্যবাদ জানাই। আমি আমাদের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে শক্তিশালী করতে এই গুরুত্বপূর্ণ সময়ে আমাদের বিভিন্ন বিনিময় কার্যক্রমের প্রাক্তন শিক্ষার্থী ও অংশীদারদের কার্যকর ভূমিকার প্রশংসা করি। তিনি বলেন, আমি টেড কেনেডি জুনিয়রের এক জ্ঞানগর্ভ উক্তির মাধ্যমে আমার বক্তব্যের ইতি টানতে চাই, ‘বন্ধুত্বের চেতনা ও বটবৃক্ষের মতো শক্তিশালী ও বিস্তৃত বন্ধন বজায় রাখা আমাদের যৌথ দায়িত্ব।’