ঢাকা, ৯ মে ২০২৫, শুক্রবার, ২৬ বৈশাখ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ১০ জিলক্বদ ১৪৪৬ হিঃ

প্রথম পাতা

ফলোআপ: ২০,০০০ তরুণীর সর্বনাশ

কাঠগড়ায় পমপম চক্রের লম্পটরা

শুভ্র দেব
৩০ মে ২০২৩, মঙ্গলবার
mzamin

সম্পর্ক থাকাকালীন সময়ে প্রেমিকের চাহিদা অনুযায়ী নগ্ন ভিডিও ও ছবি যারা শেয়ার করেছিলেন তারা এখন বিপদে। কারণ বিচ্ছেদের পর সাবেক প্রেমিকরা এসব ভিডিও ও ছবি টাকার বিনিময়ে বিক্রি করে দিয়েছেন একটি চক্রের কাছে। পমপম নামের ওই চক্রের হোতারা টাকা দিয়ে এগুলো কিনে পর্নো ভিডিও তৈরি করে বিভিন্ন গ্রুপে শেয়ার করেছে। টাকা দিয়ে মাসিক প্যাকেজ কিনে বাংলাদেশ তথা বিভিন্ন দেশের ব্যক্তিরা এসব ভিডিও দেখতো। চক্রটির কাছে এখন পর্যন্ত ২০ হাজার ভিডিও ও ৩০ হাজার নগ্ন ছবি পাওয়া গেছে। যারা ভুক্তভোগী হয়েছেন তাদের ৮০ শতাংশের বয়স ১৮ বছরের নিচে। আর বাকি ২০ শতাংশের বয়স ১৮ থেকে ২৫ বছরের মধ্যে। স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে নামিদামি সরকারি-বেসরকারি বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা রয়েছেন এই তালিকায়। চিত্র জগতের নায়িকাদের ভিডিও রয়েছে। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) এই চক্রের ৯ সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে এমন খবর জানাজানি হওয়ার পরে বহু তরুণী সংস্থাটির হটলাইনে ফোন করছেন। প্রত্যেকেই নিজের অসহায়ত্ব তুলে ধরে তাদের সাবেক প্রেমিককে কাঠগড়ায় তুলছেন। সিআইডি তাদের দেয়া তথ্য সংগ্রহ করছে। 

সিআইডি’র তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, টেলিগ্রামে মূলহোতা সায়েমের ১০টি অ্যাকাউন্ট পাওয়া গেছে। প্রত্যেকটি অ্যাকাউন্টই পর্নো ভিডিও দিয়ে ব্যবসা করার জন্য খোলা হয়। চক্রের সদস্যরা কিশোরী-তরুণীদের সাবেক প্রেমিকদের কাছ থেকে নগ্ন ভিডিও ও ছবি কিনতো। ধরন ও কোয়ালিটি দেখে প্রতিটি ভিডিও ১০ থেকে ৩০ হাজার টাকা। কিছু ভিডিও পর্নো আকারে তৈরি করা থাকতো। এর বাইরে টার্গেট করে সুন্দরী তরুণীদের মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ ও টেলিগ্রামে ফিশিং লিঙ্ক পাঠাতো। লিঙ্কে ঢুকলে তরুণীদের আইডি নিজের কব্জায় নিয়ে যেত পমপম চক্র। পরে তরুণীদের মেসেঞ্জার থেকে নিয়ে যেত তাদের প্রেমিককে শেয়ার করা ছবি ও ভিডিও। একইভাবে ইনস্টাগ্রাম আইডি হ্যাক করেও ভিডিও নিত তারা। বেশি টাকা খরচ করে চিত্র জগতের নায়িকাদের নগ্ন ভিডিও তারা সংগ্রহ করতো।

তদন্ত কর্মকর্তারা জানান, সম্পর্ক চলাকালীন প্রেমিকার যেসব অন্তরঙ্গ মুহূর্ত প্রেমিকরা ক্যামেরাবন্দি করেছে প্রতিশোধের নেশায় ও টাকার বিনিময়ে একসময় সেগুলো তুলে দিয়েছে চক্রের কাছে। সায়েম তার এডমিনদের দিয়ে ওই ভিডিওতে মিউজিক ও ছবি দিয়ে ১০-২০ সেকেন্ডের প্রমো তৈরি করে পমপম পাবলিক গ্রুপে দিত। ওই গ্রুপে ৪ লাখের উপরে সদস্য। গ্রুপ সদস্যরা প্রমো দেখে ফুল ভার্সন দেখার আগ্রহ দেখালে সাবস্ক্রিপশন ফি দিতে হতো। মাসিক ফি ছিল ১ থেকে ২ হাজার টাকা পর্যন্ত। বিকাশের মাধ্যমে ফি পরিশোধ করলেই প্রাইভেট গ্রুপে ওইসব ভিডিও’র পুরো অংশ দেখানো হতো। এছাড়া গ্রুপে থাকা অন্যান্য ভিডিও দেখার সুযোগ থাকতো। মাস শেষ হলে ওই ব্যক্তি নতুন করে সাবস্ক্রিপশন ছাড়া আর কোনো ভিডিও দেখার সুযোগ পেতেন না। টাকা দিয়ে এসব ভিডিও দেখতেন, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, পর্তুগাল, কানাডা, আমেরিকা এবং ইংল্যান্ডের নাগরিকরা। প্রতি মাসে মাসিক ফি দিয়ে পমপম প্রিমিয়াম গ্রুপের সদস্য ছিলেন ৭৫০ জন। সিআইডি বলছে, চক্রের সদস্যরা জানিয়েছে তাদের সংগ্রহে যেসব ভিডিও ছিল তার বেশির ভাগই ১৮ বছরের কম বয়সীদের। কারণ এসব ভিডিও দেখার প্রতি বিভিন্ন দেশের সাবস্ক্রিপশনকারীদের বেশি আগ্রহ ছিল। চাইল্ড ভিডিও’র প্রমো দিলে সাড়া আসতো বেশি। এসব ভিডিও তারা বেশি দাম দিয়ে কিনতো। শুধু ভিডিও দিয়ে পর্নো  তৈরি করেই যে তারা ইনকাম করতো তা নয়। যেসব কিশোরী ও তরুণীদের ভিডিও তারা কিনতো ও হ্যাক করতো তাদেরকেই আবার নক দিত। মেসেঞ্জার, মোবাইল বা অন্য মাধ্যমে যোগাযোগ করে বলতো টাকা না দিলে ভিডিও ভাইরাল করে দিবে। টাকা নিয়েও অনেকের ভিডিও তারা ভাইরাল করে দিত। আর যারা টাকা দিতে পারতো না তাদেরকে নগ্নভাবে ভিডিও কলে আসতে বলতো। এভাবে আসার পর তারা আবারো ওই তরুণীর ভিডিও রেকর্ড করে নিত। এভাবে জিম্মি করে হাজার হাজার তরুণীর ভিডিও সংগ্রহ করেছে।  

এ ঘটনায় সিআইডি চট্টগ্রামের শ্যামলী পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী মো. আবু সায়েম ওরফে মার্ক সাকারবার্গ (২০), বেসরকারি চাকরিজীবী মো. মশিউর রহমান শুভ (২৬), সিলেট পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী মো. সাহেদ খান (২২), নর্থসাউথ বিশ^বিদ্যালয়ের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থী কেতন চাকমা (২০), ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগের শিক্ষার্থী মো. নাজমুল হাসান সম্রাট (২২), তেজগাঁও কলেজের ফাইন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী মো. মারুফ হোসেন (৩৪), চট্টগ্রাম সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী জুনাইদ বোগদাদী শাকিল (২০),  বেসরকারি চাকরিজীবী মো. জসিম উদ্দিন (৩৮) ও শাহরিয়ার আফসান অভ্র (২৪)কে গ্রেপ্তার করেছিল। এদের মধ্যে আবু সায়েম, মশিউর রহমান শুভ, কেতন চাকমা ও সাহেদ খান স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। তারা তাদের অপরাধে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছে।

আবু সায়েম সিআইডি’র জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছে, তার ৪টি বিকাশ, ২টি রকেট ও ৪টি নগদ অ্যাকাউন্ট রয়েছে। তদন্ত সংশ্লিষ্টরাও প্রাথমিকভাবে এই কয়েকটি অ্যাকাউন্টে লেনদেনের তথ্য পেয়েছেন। এসব অ্যাকাউন্টে ২০২২ সালের ২৮শে ডিসেম্বর থেকে ২০২৩ এর ২৫শে মে পর্যন্ত দেশের ভেতর ও বিদেশ থেকে ঢুকেছে ২৪ লাখ ৭৭ হাজার ৬৭০ টাকা। সব অ্যাকাউন্ট মিলে প্রায় ১ কোটি ২১ লাখ টাকার হিসাব পাওয়া গেছে। মোবাইল ব্যাংকিংয়ে আসা এসব টাকা সায়েম ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ট্রান্সফার করেছে। যেসব মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্টে লেনদেন হয়েছে তার বেশির ভাগই অন্যদের নামে রেজিস্ট্রেশন করা। সায়েম চট্টগ্রাম থেকে বেশি দামে বিকাশ অ্যাকাউন্ট করা এসব সিম কিনেছে।   

সিআইডি’র সাইবার পুলিশ সেন্টারের বিশেষ পুলিশ সুপার মুহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম মানবজমিনকে বলেন, হাজার হাজার ভুক্তভোগী আমাদের হটলাইনে ফোন করছেন। অফিসেও এসেছেন বিভিন্ন বিশ^বিদ্যালয় ও কলেজে পড়ুয়া ভুক্তভোগীরা। প্রত্যেকেই তাদের ভিডিও এসব গ্রুপ থেকে সরিয়ে দেয়ার অনুরোধ করছেন। আমরা যে গ্রুপে পর্নো ভিডিও ছিল সেটি বন্ধ করে দিয়েছি। তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত ৪ জন স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। তাদের কাছ থেকে আরও এ ধরনের আরও কিছু গ্রুপ আছে বলে জানতে পেরেছি। আমরা সেগুলো নিয়ে তদন্ত করছি। যাদের কাছ থেকে তারা ভিডিও কিনেছে ও সংগ্রহ করেছে তাদের বিষয়ে খোঁজখবর নিচ্ছি। মূলহোতা সায়েমের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ও  মোবাইল ব্যাংকিং ট্রানজেকশন থেকে কোটি টাকা লেনদের তথ্য পেয়েছি। আরও কয়েকটি গ্রুপের সন্ধান পেয়েছি। পাশাপাশি এসব কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত কয়েকজন রাঘব বোয়ালের নাম পেয়েছি।

 

প্রথম পাতা থেকে আরও পড়ুন

প্রথম পাতা সর্বাধিক পঠিত

   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2025
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status