প্রথম পাতা
পর্যবেক্ষণ
ভিসা নীতির তাৎপর্য
শহীদুল্লাহ ফরায়জী
২৯ মে ২০২৩, সোমবার
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যে নতুন এবং বিরল ভিসা নীতি ঘোষণা করেছে তা সরকারের জন্য শাস্তিমূলক, সতর্কতামূলক, হুঁশিয়ারিমূলক এবং রাষ্ট্রের জন্য অসম্মানজনক। এই গভীর সত্য উপলব্ধি করতে মার্কিন ভিসা নীতি পর্যালোচনা করা প্রয়োজন। ভিসা নীতিতে বলা হয়েছে- বাংলাদেশের নির্বাচনে বাধা সৃষ্টি করে গণতন্ত্রকে ক্ষতিগ্রস্তকারী ব্যক্তি ও তার পরিবার বা প্রতিষ্ঠানের কর্তাদের বিরুদ্ধে ভিসায় বিধিনিষেধ আরোপ করা হবে।
এই বিষয়ে বলার অপেক্ষা রাখে না গণতন্ত্রকে কারা ধ্বংস করেছে, কারা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানকে হাতের খেলনা হিসেবে ব্যবহার করেছে। প্রতিনিয়ত সভা-সমাবেশের অধিকার এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা কারা ব্যাহত করছে!
অ্যান্টনি ব্লিনকেনের ঘোষণায় খোলাসা করেই বলা হয়েছে- বাংলাদেশের অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিতে কেবলমাত্র বাংলাদেশের জন্য ওই ভিসা নীতি প্রণয়ন করা হলো। এই নীতির অধীনে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে দুর্বল বা বাধা প্রদানের জন্য দায়ী ব্যক্তি এবং তাদের পরিবারের সদস্য তথা জীবনসঙ্গী, ছেলে বা মেয়ের ভিসার ওপর বিধিনিষেধ আরোপ হবে।
কূটনৈতিক ইতিহাসে দেখা যায়- ১) কোনো দেশ কর্তৃক তার আইনগত অধিকার রক্ষা বা বিপদগামী দেশকে সংশোধনের উদ্দেশ্যে; ২) আইনগতভাবে প্রতিপক্ষের অবন্ধুসুলভ বক্তব্য ও ব্যবস্থার জবাবে; ৩) প্রতিপক্ষের ক্ষতিকর তৎপরতা নিয়ন্ত্রণে এবং ৪)
নিষেধাজ্ঞা প্রদানের মাধ্যমে এই ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।
প্রথাগত আন্তর্জাতিক আইনে (Customary international law) এই ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ বৈধ বলে পরিগণিত হয়ে আসছে।
বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনী ব্যবস্থা ধ্বংস করা হয়েছে কিন্তু বাংলাদেশ রাষ্ট্র তা পুনরুদ্ধারের জন্য কোনো পরিকল্পনা গ্রহণ না করায়- নতুন ভিসা নীতি আরোপ করা হয়েছে। যদিও সরকার ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনকে জনগণের ম্যান্ডেট হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে অবাধ ও সুষ্ঠু করার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে এখানেই হচ্ছে মূল সংকট।
প্রশ্ন হচ্ছে বিগত পনেরো বছর যাবৎ যদি সকল নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ হয় এবং তাতে যদি গণরায়ের প্রতিফলন ঘটে তাহলে সরকারকে নতুন করে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি কেন দিতে হয়!
আওয়ামী লীগ বিশ্বাস করতো- বিচারপতি কে এম হাসান তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হলেই সমগ্র তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিএনপি দলীয় সরকারে রূপান্তরিত হতো। ফলে তার বিরুদ্ধে প্রচণ্ড সংগ্রাম গড়ে তোলা আওয়ামী লীগ নৈতিক দায়িত্ব মনে করেছে। আর এখন আওয়ামী লীগ মনে করে দলীয় সভাপতি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে থাকলেও নির্বাচন দলীয় প্রভাবমুক্ত হবে। আওয়ামী লীগের এই নৈতিক সংকট জাতির বর্তমান দুর্দশার অন্যতম কারণ। আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে থাকলে গণতন্ত্রের জন্য প্রাণ দিতে পিছপা হয় না আর ক্ষমতায় থাকলে প্রাণ নিতেও অনুতপ্ত হয় না। আওয়ামী লীগের অবস্থান বিরোধী দলে থাকলে এক আর ক্ষমতাসীন হলে আরেক।
আওয়ামী লীগ সত্যের মুখোমুখি হতে ভয় পায়, সত্যকে স্বীকার করে না। সুতরাং মার্কিন ভিসা নীতি তাদের কাছে বিএনপি বিরোধী বার্তা বলেই প্রতিভাত হয়েছে। ভিসা নীতি প্রশ্নে সরকারের যুক্তিহীন উপসংহার একেবারেই অর্থহীন। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনে সরকারের প্রতিশ্রুতি সত্য ও জনগণের বিশ্বাস থেকে বহুদূর। তাই স্টেট ডিপার্টমেন্টের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার বলেছেন- এটা আমাদের পক্ষ থেকে একটি সিগন্যাল। যাতে বাংলাদেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ জন্য দায়ী যেকোনো ব্যক্তিকে জবাবদিহিতায় নেয়ার সক্ষমতা আমাদের আছে। এটা সব বাহিনী, বিচারবিভাগ সহ সবার জন্য একটি সতর্কতা। যদি নির্বাচনে কোনো অনিয়ম দেখতে পাই তাহলে আমরা ব্যবস্থা নেবো।
নতুন ভিসা নীতি বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে ক্ষুণ্ন করার জন্য দায়ী বা জড়িত যেকোনো ব্যক্তির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে। এর মধ্যে বর্তমান বা প্রাক্তন বাংলাদেশি কর্মকর্তা, সরকার সমর্থক এবং বিরোধী দলের সদস্য এবং তাদের পরিবারের সদস্যরাও অন্তর্ভুক্ত।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সর্বত্র অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনকে সমর্থন করে। নতুন ভিসা নীতিটি সেই প্রচেষ্টা এবং বাংলাদেশি জনগণকে সমর্থন করার জন্য ডিজাইন করা হয়েছে, যাতে তারা তাদের পছন্দের নেতা নির্বাচন করতে পারে।
বাংলাদেশে গণতন্ত্র বা নির্বাচন প্রক্রিয়াকে ধ্বংস করার জন্য, জনগণের ইচ্ছা ও আকাঙ্ক্ষা (Public Will) কে নিষিদ্ধ করার জন্য, কাউকে আমরা অভিযুক্ত বা অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করা বা বিচারের মুখোমুখি করার প্রয়োজন বোধ করিনি। আর জনগণের সম্মতি প্রদানের জন্য কোনো ডিজাইনও প্রস্তুত করতে পারিনি।
বিদেশিরা আমাদের ছবক দিচ্ছে, হুঁশিয়ারি দিচ্ছে, এটাকে ‘সিগন্যাল’ বলে চিহ্নিত করেছে। অথচ আমরা তার তাৎপর্য উপলব্ধি করার প্রয়োজনও বোধ করছি না ।
ওয়াশিংটন-ভিত্তিক উইলসন সেন্টারের সাউথ এশিয়ান ইনস্টিটিউটের পরিচালক মাইকেল কুগেলম্যান বিবিসি বাংলাকে বলেন- এটা বেশ কঠোর একটা সিদ্ধান্ত এবং এখানে একটা খুবই স্পষ্ট বার্তা দেয়া হয়েছে। মার্কিন প্রশাসন এখন দেখবে নির্বাচন ঘনিয়ে এলে সেখানে কী ঘটে।
মি. কুগেলম্যান বলছেন- তার মনে হচ্ছে যে, জো বাইডেন প্রশাসনের গণতন্ত্র প্রসারের এজেন্ডার ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে একটা দৃষ্টান্ত হিসেবে নেয়া হচ্ছে। তার কথায়, ‘বাইডেন প্রশাসন একটা মূল্যবোধ-ভিত্তিক পররাষ্ট্রনীতিকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে এবং বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এটা জোরালোভাবে প্রয়োগ করছে।’
‘বাংলাদেশের ২০১৮ সালের নির্বাচন নিয়েও অনেক প্রশ্ন উঠেছিল কিন্তু তখন যুক্তরাষ্ট্র এ রকম কোনো ভূমিকাই নেয়নি। কারণ, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ‘নীতি’ মূল্যবোধভিত্তিক ছিল না। কিন্তু বাইডেনের পররাষ্ট্রনীতি মূল্যবোধভিত্তিক এবং গণতন্ত্র ও মানবাধিকারকে তারা অগ্রাধিকারের তালিকায় এক নম্বরে রেখেছে।’ নতুন ভিসা নীতিকে এ প্রেক্ষাপটে ব্যাখ্যা করাটাই সবচেয়ে সঠিক হবে বলে গণ্য করছেন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেলো ড. আনু আনোয়ার।
তাঁর কথা হচ্ছে- ‘বাইডেন সরকার যদি বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক শাসন আছে বলে মনে করতো তাহলে নিশ্চয়ই ডেমোক্রেসি সামিটে ঢাকা আমন্ত্রিত হতো।’
মাইকেল কুগেলম্যান আরও বলেছেন-‘এখন দেখা যাচ্ছে যে, কূটনৈতিক পন্থার বাইরে গিয়ে তারা প্রয়োজনে শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নিতেও ইচ্ছুক এবং অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন, গণতন্ত্র এবং অধিকার নিশ্চিত করতে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতেও প্রস্তুত’।
বাংলাদেশের ভয়াবহ গণতন্ত্রের ঘাটতিকে মোকাবিলা করে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বহাল করার প্রশ্নটি যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক ব্যবস্থার অংশ হিসেবে উত্থাপিত হচ্ছে।
এসব সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের জন্য চরম লজ্জাজনক। বাংলাদেশ যে রোল মডেলের আড়ালে ভূ-রাজনীতিতে ‘অরাজকপূর্ণ’ রাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে বা চিহ্নিত হচ্ছে, উগান্ডা বা মিয়ানমারের সঙ্গে সমমর্যাদার অধিকারী হয়ে যাচ্ছে, তা জাতীয় মর্যাদাকে কোনো ক্রমেই সুরক্ষা দেয় না।
ভিসা নীতির অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে নির্বাচন প্রশ্নে সরকারের অনুসৃত নীতিতে মৌলিক পরিবর্তন আনা। সামরিক, কূটনৈতিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য তো আছেই। এ ধরনের পরিস্থিতিতে মার্কিন ভিসা নীতির অবলম্বনে সম্ভাব্য ফলাফলের প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত জটিল রাজনৈতিক হিসাব (extremely delicate political calculation) বিবেচনা করতে হয়। যা জাতীয়ভাবে আমাদের নেই।
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যদি রাতের ভোটের মতো বা প্রতিদ্বন্দ্বিতাবিহীন হয় তাহলে রাষ্ট্র বড় ঝুঁকিতে পড়বে এবং বাংলাদেশ ব্যর্থ রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ হয়ে উঠবে। এটা ক্ষমতাসীন সরকার যত দ্রুত উপলব্ধি করতে পারবে ততই আমাদের জন্য মঙ্গল।
লেখক: গীতিকবি
[email protected]