শরীর ও মন
স্ট্রোক আক্রান্ত রোগীদের আশার আলো
ডা. মো. বখতিয়ার
২০ মে ২০২৩, শনিবার
আশঙ্কাজনক হারে বেড়েই চলেছে স্ট্রোক। বাচ্চা থেকে শুরু করে শিশু, যুবা, বৃদ্ধা কেউ-ই রেহাই পাচ্ছে না স্ট্রোক থেকে। হঠাৎ স্ট্রোক করলে কোথায় চিকিৎসা করাবেন, কার কাছে দ্রুত নিয়ে যেতে হবে তা নিয়ে চিন্তার শেষ নেই। তাই সচেতনতার সহিত প্রত্যেকটা পরিবারের জেনে রাখা ভালো যেকোনো রোগের জরুরি চিকিৎসাগুলো নিকটস্থ কোনো চিকিৎসালয়ে হয়ে থাকে। স্ট্রোক হলে প্রথম ধাপের জরুরি চিকিৎসা শেষে ক্ষতিগ্রস্ত রোগীর সুস্থতার জন্য রিহ্যাবের প্রয়োজন হয়। আর রিহ্যাবের প্রোগ্রামের মধ্যে ফিজিওথেরাপি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। স্ট্রোকের পর হাত-পা একেবারে এলিয়ে পড়লে তা সেই অবস্থা থেকে তুলে এনে পেশির জোর বাড়ানো ও হাত-পা যাতে শক্ত এবং তার কার্যকারিতা বৃদ্ধি করা হয় ফিজিওথেরাপির মাধ্যমে।
মূলত স্ট্রোকের আপৎকালীন বা শুরুতে চিকিৎসা হয় হাসপাতালে, যেহেতু রোগটি একটি স্নায়ুজনিত সমস্যা তাই স্ট্রোক করলে জরুরি পর্যায়ে নিওরোলজি বিশেষজ্ঞরা চিকিৎসা করে থাকেন। চিকিৎসকরা রোগীকে কিছু ওষুধ ও নির্দেশনা দেন। এই নির্দেশনাগুলো রোগীকে পরবর্তী স্ট্রোক ঠেকানোর জন্য মেনে চলতে হয়। তবে রোগীকে স্বাভাবিক ও কর্মময় জীবন ফিরিয়ে দেয়ার জন্য রিহ্যাবের প্রয়োজন।
মনে রাখতে হবে শুধু হাত-পা সচল করলেই স্ট্রোক মিটে যায় না।
রিহ্যাব হলো:
একজন ব্যক্তি স্ট্রোক করলে তার ব্রেনের কিছু কোষ মরে যায়। ফলে তাদের নির্দেশে শরীরের যে যে কাজ চলতো, সেখানে ব্যাঘাত ঘটে। সেই ব্যাঘাত দূর করা হয় রিহ্যাবের মাধ্যমে। মৃত কোষেদের চারপাশে যে সমস্ত ঘুমন্ত কোষ থাকে তাদের জাগিয়ে তুলে ট্রেনিং দিয়ে কর্মক্ষম করা হয়। প্রথম ৪০ দিন এরা দ্রুত জাগতে থাকে, কাজ শেখার হারও খুব চটপট হয়। তারপর গতি কিছুটা কমে গেলেও ৩-৬ মাস পর্যন্ত বেশ ভালো কাজ হয়। রিহ্যাব ঠিকভাবে চালিয়ে গেলে ৬ মাস থেকে এক বছর, কখনো দু’বছর পর্যন্ত তাদের মধ্যে প্রাণ সঞ্চার করা যায়। এবং এরাই ধীরে ধীরে শরীরকে সচল ও স্বাভাবিক করে তোলে। এটাই রিহ্যাব।
কেন রিহ্যাবের প্রয়োজন
মূলত ট্রেনিং বা এক্সারসাইজ প্রশিক্ষণ দিয়ে রোগ সারানোর জন্য রোগীকে যে প্রশিক্ষিত করাই রিহ্যাবের উদ্দেশ্য। যেমন- ধরুন ডান হাত অবশ। ফিজিওথেরাপিতে অবশ ভাব একটু একটু করে কাটলেও হাত দিয়ে কিছু করতে গেলে বাঁ হাত আগে এগিয়ে যায়। তখন করা হয় কনস্ট্রেইন্ট ইনডিউজড মুভমেন্ট থেরাপি। এতে বাঁ হাত বেঁধে দেয়া হয়। তার পর থেরাপিস্টের নির্দেশমতো ডান হাতকে চালনা করা শুরু করলে ব্রেনের যে সমস্ত কোষ এই কাজটা নিয়ন্ত্রণ করে, তারা জেগে উঠতে থাকে। ব্রেনের যে সমস্ত কোষ এই কাজটা নিয়ন্ত্রণ করে, তারা জেগে উঠতে থাকে। ফলে এক সময় থেরাপিস্টের সাহায্য ও নির্দেশ ছাড়াই সচল হয় ডান হাত।
আর পায়ের অবশ ভাব কাটাতেও সেটা স্বাভাবিক করতে রিফ্লেক্স ইনহিবিটিভ ট্রেনিং ও টাস্ক স্পেসিফিক ট্রেনিং দিলে কাজ হয়। এই ট্রেনিং বা পদ্ধতিগুলো মোটেও জটিল নয়। হাঁটু ভাঁজ করে সঠিক পদ্ধতিতে হাঁটতে শেখানো।
যা করতে হবে
মনে সাহস আনতে হবে, ঘাবড়ানো যাবে না।
জরুরি অবস্থার পর রিহ্যাব শুরু করুন।
শরীরকে যতটা সম্ভব সচল রাখুন।
সময়ের সঙ্গে সব ঠিক হয়ে যাবে- এরকম বলে স্বজনদের রোগীকে সাহস যোগাতে হবে।
অ্যান্টি অক্সিজেনযুক্ত সুষম খাবার খেলে চটপট কর্মক্ষম হওয়া যায়। রঙিন শাক-সবজি-ফল, মাছ, ডিম রাখুন খাদ্য তালিকায়। একেবারে বেশি খেতে না পারলে অল্প করে বারে বারে খান। পেটে অস্বস্তি থাকলে নিজে থেকে খাওয়া না কমিয়ে ডাক্তারকে জানান।
শুকনো ফল ও বাদাম অল্প করে খান।
ফিজিওথেরাপিসহ থেরাপিগুলো নিন
হাত-পায়ের শক্তি ও কার্যকারিতা ফিরিয়ে আনার নামই রিহ্যাব তা কিন্তু নয়। ফিজিওথেরাপি ও অকুপেশনাল থেরাপি করে এই উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়। তার পাশাপাশি কথার জড়তা কাটাতে, সঠিকভাবে কথা বলা শেখাতে করা হয় স্পিচ থেরাপি। চিন্তাভাবনার স্তরে গোলমাল হয়ে গেলে প্রয়োজন হয় সাইকো-কগনিট থেরাপির।
একজন স্ট্রোকের রোগীকে সাধারণত রিহ্যাব সেন্টারে ১৫ দিন থেকে মাস দুয়েক ভর্তি থাকতে হবে। তারপর সপ্তাহে ৩-৪ দিন বাড়িতে থেকে যাতায়াত করে করা যেতে পারে। দেখা যায় রোগীর ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে তার বাড়ির একজন ও থেরাপিস্টের উপস্থিতিতে রিহ্যাব বিশেষজ্ঞ রোগীর অবস্থা, কতোদিনে উন্নতি সম্ভব, নতুন প্ল্যান ইত্যাদি সবকিছু নিয়ে আলোচনা করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেন। এই পর্যায়ে আত্মীয়রা ধীরে ধীরে বুঝে যান কী করতে হবে। পরিশেষে বলতে পারি স্ট্রোক রোগীদের আশার আলো রিহ্যাব। যা রোগীকে নতুনভাবে জীবন পেতে স্বপ্ন দেখায়।
লেখক: জনস্বাস্থ্য বিষয়ক গবেষক
এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক
খাজা বদরুদজোদা মডার্ন হাসপাতাল, সফিপুর, কালিয়াকৈর, গাজীপুর।