ঢাকা, ৩ মে ২০২৪, শুক্রবার, ২০ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২৩ শাওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

প্রথম পাতা

জাফরুল্লাহ চৌধুরী দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবেন

মুনির হোসেন
১৩ এপ্রিল ২০২৩, বৃহস্পতিবার
mzamin

ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। রণাঙ্গনের বীর মুক্তিযোদ্ধা। বিশিষ্ট চিকিৎসক। সমাজ ও রাজনীতিতে ইতিবাচক পরিবর্তন প্রত্যাশী এক লড়াকু যোদ্ধা। আমৃত্যু লড়াই করেছেন সাম্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠায়। লড়াকু মানসিকতা দেখিয়েছেন জীবনের শেষ পর্যন্ত। দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে জাতীয় স্বার্থে কথা বলেছেন। বৃহত্তর সমাজের কথা চিন্তা করেছেন। কাজ করেছেন অতিভোগবাদী সমাজের বিপরীতে সাম্যের সমাজ প্রতিষ্ঠায়। ছিলেন স্বাস্থ্য নিয়ে সবচেয়ে বড় চিন্তাবিদ, পথপ্রদর্শক ও গবেষক।

বিজ্ঞাপন
লড়েছেন স্বাস্থ্যের বাণিজ্যিকীকরণের বিরুদ্ধে। স্বাস্থ্যসেবাকে তৃণমূলে সহজলভ্য করার পথ দেখিয়েছেন। সাহসের প্রমাণ রেখেছেন ঔষুধনীতি প্রণয়নে। প্রয়াত বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে মূল্যায়ন করে বিশিষ্টজনরা বলছেন, তার কর্ম, আদর্শ এবং সংগ্রামের প্রতিটি বিষয় দেশ ও মানুষের জন্য দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। 

ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর স্মৃতিচারণ করে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ্উদ্দিন আহমেদ বলেন, তাকে আমি চিনি আজ থেকে ৩০-৪০ বছর ধরে। তিনি অল্পতেই মানুষের সঙ্গে মিশতে পারতেন। একজন নির্মোহ, কর্মবীর ও স্পষ্টবাদী মানুষ ছিলেন। আমি তার সঙ্গে বিভিন্ন কাজে যুক্ত ছিলাম। ঢাকার বাইরেও বিভিন্ন কর্মসূচিতে তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছি। অত্যন্ত স্বভাবসুলভ বিনয়ী মানুষ ছিলেন। একেবারেই একজন রেয়ার মানুষ। তিনি ছিলেন একজন উঁচু মানের  দেশপ্রেমিক। বিশেষ করে চিকিৎসার ক্ষেত্রে তার অবদান অনস্বীকার্য। জীবনের শেষ সময়েও চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে যাননি। যেটি একেবারেই বিরল ও কল্পনাতীত। গত রোববারও আমি তাকে আইসিইউতে দেখতে গিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম সুস্থ হয়ে আমাদের মাঝে ফিরে আসবেন। তিনি সারা জীবন সাধারণ মানুষের কাজ করেছেন। মানুষের উপকার ছাড়া অন্য কিছু কখনো ভাবেননি। একজন আদর্শ দেশপ্রেমিকের রোল মডেল। সবসময় স্পষ্টভাবে কথা বলতেন। তিনি বিদায় নিলেও তার কর্ম- বিশেষ করে গণস্বাস্থ্য ও গণ বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন কর্মের মাধ্যমে তিনি চির স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। 

ইতিহাসবিদ প্রফেসর ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বলেন, ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। একই সঙ্গে তিনি ছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের মুক্তির যোদ্ধা। সব সময় সাহসী বিবেকের প্রতিধ্বনি করতেন। তার মৃত্যুতে বাংলাদেশ একটি সাহসী কণ্ঠ থেকে বঞ্চিত হবে। আমি তার আত্মার শান্তি কামনা করছি। তিনি জীবন থেকেও কর্মকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। কর্মের মাধ্যমে তিনি বাংলাদেশের মানুষের কাছে বেঁচে থাকবেন। 

ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর বিষয়ে ব্র্যাক’র চেয়ারপারসন ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, তার মৃত্যুতে সর্বজনীন একটা শোক হচ্ছে। এটা তার কর্মের কারণেই সম্ভব হয়েছে। ১৯৭২ সাল থেকে ওনার সঙ্গে আমার পরিচয়। ছাত্রজীবন থেকেই তাঁর কথা শুনেছি। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তার স্বপ্ন ছিল দেশটা স্বাবলম্বী হবে। যার কারণে তিনি গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেছেন। যেটি সে সময় সবার মধ্যে একটি আগ্রহ তৈরি করেছিল। ৮৮’র বন্যার সময়ও ত্রাণের ব্যাপারে তিনি সারা দেশে ছুটে বেরিয়েছেন। ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। বিভিন্ন কারণেই তার সঙ্গে সম্পর্ক ছিল। তিনি কী কী করে গেছেন তা আজ বলা দরকার। তিনি স্বাস্থ্যকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অন্যতম এজেন্ডা হিসেবে তুলে ধরেছেন। ভোগবাদী বিশ্বায়নের যুগে স্বাস্থ্যের বাণিজ্যিকীকরণের বিরোধিতা করেছেন। পথ দেখিয়ে গেছেন স্বাস্থ্য হচ্ছে মানুষের মৌলিক অধিকার, এটা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে তিনি এটা ধারণ করতেন। স্বাস্থ্য নিয়ে সবচেয়ে বড় চিন্তাবিদ, পথপ্রদর্শক ও গবেষক ছিলেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। তিনি স্বাস্থ্যকে বাণিজ্যিকীকরণের বিপরীতে তৃণমূলে নিয়ে যাওয়ার পথ দেখিয়েছেন। আর বাংলাদেশে গর্বের বাস্তবতা হচ্ছে ওষুধের সহজলভ্যতা। আজ ঢাকা থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত অঞ্চল কিংবা পাহাড়  দেশের সব জায়গায় ওষুধ খুব সহজে পাওয়া যায়। এটার পেছনের অন্যতম কারিগর হচ্ছেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। জাতীয় ওষুধ নীতি প্রণয়ন তার সুস্পষ্ট প্রমাণ। আগে বাংলাদেশের ঔষধ শিল্প বাইরের মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলোর নিয়ন্ত্রণে ছিল। সেটি থেকে তার কারণে বর্তমানে বাংলাদেশে ফার্মাসিউটিক্যাল শিল্প একটি স্থায়িত্ব পেয়েছে। ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী আজীবন নিজের প্রতিষ্ঠিত গণস্বাস্থ্যেই চিকিৎসা নিয়েছিলেন। আর সেখানেই মৃত্যুবরণ করেছেন। জাফরুল্লাহ চৌধুরী সবসময় বৃহত্তর সমাজের কথা চিন্তা করেছেন। সাম্য, ন্যায়, টেকসই সমাজের চিন্তা সবসময় তাকে তাড়িত করেছে। যার কারণে তিনি রাজনীতিতেও যুক্ত হয়েছিলেন। সেটি একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে নয় বরং গণতন্ত্র, সাম্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য। তিনি ভোগবাদী বিশ্বায়নের যে উন্মাদনা চলছে এ সংস্কৃতির বিপরীতে তিনি সাম্যের সমাজের স্বপ্ন দেখেছেন। তিনি চেয়েছেন একটি মূল্যবোধের সমাজ তৈরি হোক। তরুণ প্রজন্মের জন্য একটি টেকসই সমাজ তৈরি করে যেতে চেয়েছেন। জীবনের শেষ পর্যন্ত তিনি লড়াকু মানসিকতা দেখিয়েছেন। বৃহত্তর সমাজের কথা চিন্তা করেছেন। অতিভোগবাদী ধারণার উন্নয়নের বিপরীতে সাম্যের সমাজ তৈরিতে কাজ করেছেন। 

অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী নাগরিক সমাজের অহঙ্কার ও গৌরব ছিলেন। তিনি পেশাজীবী হিসেবে জাতির উন্নয়নে যে ভূমিকা রেখেছেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় সাহসী ভূমিকার জন্য তিনি সর্বজনশ্রদ্ধেয় ছিলেন। একজন পেশাজীবী হিসেবে জাফরুল্লাহ চৌধুরীর ঔষুধনীতি প্রণয়ন ছিল অত্যন্ত সাহসের। নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি হিসেবে দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে জাতীয় স্বার্থের জন্য আজীবন কথা বলে গেছেন। তার ব্যক্তিত্ব ও দৃঢ়তার কারণেই তিনি এটি পেরেছেন। বর্তমানে রাজনীতিকে কলুষিত করার যে একটা চেষ্টা তার বিরুদ্ধেও তিনি সংগ্রাম করে গেছেন। 

লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, জাফর ভাইকে চিনি ১৯৭৯ সাল থেকে। তাঁকে নিয়ে একটা বিশাল পুরাণ লিখে ফেলা যায়। লেখালেখির কাজে সাক্ষাৎকার নিতে যখনই গেছি, বিমুখ করেননি। শুরু হয়েছিল ১৯৮৮ সালে। এডিবি’র একটি স্টাডির জন্য। শেষবার গেছি মওলানা ভাসানী প্রসঙ্গে জানতে। সাক্ষাৎকারটি এখনো অপ্রকাশিত। তাঁর আরও তিনটি সাক্ষাৎকার ব্যবহার করেছি আমার ‘এক-এগারো’, ‘প্রতিনায়ক’ আর  ‘১৯৭১: ভারতের বাংলাদেশ যুদ্ধ’ বইয়ে। আরেকটি সাক্ষাৎকার নিয়ে রাখবো ভেবেছিলাম। তা আর হলো না। জাফর ভাইয়ের সঙ্গে অনেক টকশো করেছি। প্রতিবার এক কপি ‘গণস্বাস্থ্য’ ম্যাগাজিন দিতেন। শো শেষে তাঁর গাড়িতে আমাকে বাসায় নামিয়ে দিতেন। গল্প করতে করতে আসতাম। একবার বলেছিলেন, আমেরিকায় গিয়ে কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট করার সুযোগ আছে। কিন্তু তিনি সেটা করাবেন না। সপ্তাহে তিনদিন ডায়ালিসিস করাতেন। কখনো বা ডায়ালিসিস শেষ করেই ছুটতেন টকশোতে। বছর তিনেক আগে ৫০ জনের সঙ্গে এক বিবৃতিতে সই দেয়ার জন্য আদালতের সমন পান। আদালত অবমাননার অভিযোগ ছিল। তিনি ছাড়া সবাই আদালতে গিয়ে মাফ চান। তিনি চাননি। শেষে আদালত তাঁকে ‘রং-হেডেড পার্সন’Ñ মন্তব্য করে অব্যাহতি দেন। আরেকবার এক টকশোতে ক্ষমতাধর এক ব্যক্তি সম্পর্কে মন্তব্য করলে তাঁর বিরুদ্ধে জমি দখল, গাছ আর মাছ চুরির মামলা হয়। তাঁকে আদালতেও যেতে হয়। সেই মামলার কী গতি হয়েছে জানি না। যতদূর জানি, তাঁর কোনো ব্যক্তিগত সম্পদ নেই। আমাদের কাছে তিনি দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবেন।

প্রথম পাতা থেকে আরও পড়ুন

প্রথম পাতা সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status