ঢাকা, ৭ মে ২০২৪, মঙ্গলবার, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

প্রথম পাতা

ঢাকায় বিষাক্ত বায়ু, ভুগছে শিশুরা

ফরিদ উদ্দিন আহমেদ
২০ মার্চ ২০২৩, সোমবার
mzamin

ঢাকায় চারদিকে ধূলিকণা ভাসছে কুয়াশার মতো। বাতাসের বিষে চরম ঝুঁকিতে পড়েছে জনস্বাস্থ্য। গর্ভে পূর্ণ সময় থাকার আগেই শিশু জন্মানোরও একটি কারণ বায়ুদূষণ। এ দূষণের শিকার মায়েদের কম ওজনের শিশু জন্ম দেয়ার হার বেশি বলে গবেষণায় উঠে এসেছে। বায়ুদূষণজনিত রোগে দেশে কতো সংখ্যক মানুষ আক্রান্ত, তার কোনো সরকারি পরিসংখ্যান নেই। তবে চিকিৎসকেরা বলছেন, বায়ুদূষণজনিত রোগ বাড়ছে। এ ক্ষেত্রে বেশি ঝুঁকির শিকার গর্ভবতী মা ও শিশুরা। অটিস্টিক শিশুর জন্ম হওয়ার একটি কারণ দূষিত বায়ু। বাচ্চাদের জন্মকালীন ওজন কম হওয়ার একটি কারণও বায়ুদূষণ। বায়ুদূষণের কারণে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হয়।

বিজ্ঞাপন
হাঁচি-কাশি, ব্রঙ্কাইটিস, শ্বাসকষ্ট থেকে শুরু করে হতে পারে ফুসফুসের ক্যান্সার। এর বড় কারণ দূষিত বায়ু। এ ছাড়া কিডনি ও হৃদরোগের কারণও হতে পারে বায়ুদূষণ।
ঢাকায় সন্তানসম্ভবা মায়েদের ওপর বায়ুদূষণের বিরূপ প্রভাব পড়ছে। জন্ম নেয়া ৩ হাজার ২০৬ নবজাতককে নিয়ে করা এক গবেষণায় দেখা গেছে, গর্ভাবস্থায় বেশি বায়ুদূষণের শিকার মায়েদের মধ্যে কম ওজনের শিশু জন্ম দেয়ার হার বেশি। অকালে সন্তান জন্মদানের ঝুঁকিও তাদের মধ্যে বেশি। গবেষণাটি করেছেন আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআর,বি’) গবেষকরা। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে আইসিডিডিআর,বি’তে এক অনুষ্ঠানে এই গবেষণার বিস্তারিত আলোচনা করা হয়। আইসিডিডিআর,বি’র জলবায়ু পরিবর্তন ও স্বাস্থ্যবিষয়ক শাখার (ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড হেলথ ইনেশিয়েটিভ) গবেষক ও এই গবেষণা দলের প্রধান মাহীন আল নাহিয়ান বলেন, তারা রাজধানীর বায়ুদূষণের তথ্য-উপাত্ত নিয়েছেন পরিবেশ অধিদপ্তরের উৎস থেকে।
আর মা ও নবজাতকের তথ্য-উপাত্ত নেয়া হয়েছে রাজধানীর আজিমপুরের মা ও শিশু স্বাস্থ্য প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট থেকে। তিনি বলেন, আমরা দেখেছি, তুলনামূলকভাবে বেশি দূষণের শিকার মায়েরা বেশিসংখ্যক কম ওজনের শিশু জন্ম (লো বার্থ ওয়েট) দিচ্ছেন। তাদের মধ্যে সময়ের আগে সন্তান জন্ম (প্রিটার্ম বার্থ) দেয়ার হারও বেশি।

সাম্প্রতিককালে ঢাকার বায়ুদূষণ বড় ধরনের উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সুইজারল্যান্ডভিত্তিক বায়ুর মান পর্যবেক্ষণকারী প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠান আইকিউ এয়ারের তথ্যমতে, ঢাকা বিশ্বের দূষিত নগরগুলোর একটি। প্রায়ই এটি তালিকার শীর্ষে থাকে। গত ১৬ই মার্চ সকাল সোয়া ৯টায় বিশ্বজুড়ে আবহাওয়ার মান পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা আইকিউ এয়ারের তথ্য বলছে, ঢাকার বাতাসের মানে বেশ অবনতি হয়েছে। মানে অস্বাস্থ্যকর। ওই তালিকায় ২৩১ স্কোর নিয়ে শীর্ষে রয়েছে ভারতের দিল্লি। ১৭৫ স্কোর নিয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে ঢাকা। ভালো বায়ুর তালিকায় চার স্কোর নিয়ে সবচেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে যথাক্রমে যুক্তরাষ্ট্রের সল্ট লেক সিটি এবং ডেনভার।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের বায়ুমান গবেষণা কেন্দ্রের হিসাবে, ধুলা ও ধোঁয়া ঢাকার বায়ুদূষণের ক্ষেত্রে ৫০ শতাংশ ভূমিকা রাখে। এ ধুলার বড় উৎস অব্যবস্থাপনার মধ্যদিয়ে নির্মাণকাজ, পুরনো যানবাহনের দূষিত বায়ু; আর ৪০ শতাংশ দূষণের উৎস খড়, কাঠ ও তুষের মতো জৈববস্তুর ধোঁয়া ও সূক্ষ্ম বস্তুকণা। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করেন, দূষণ নিয়ন্ত্রণে সরকারের তেমন কোনো উদ্যোগ না থাকায় এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
গবেষকেরা বলেন, একজন নারী তার গর্ভধারণকালে (৯ মাসে) কতো দিন বায়ুদূষণের শিকার হয়েছেন তা সরাসরি পরিমাপ করা যায়নি। ৯ মাসের প্রতিদিন এবং ৩ হাজারের বেশি নারীর প্রত্যেকের ক্ষেত্রে কাজটি করা সময়সাপেক্ষ ও জটিল। তবে একটি নির্দিষ্ট এলাকায় নির্দিষ্ট দিনে একজন মানুষ কতোটা দূষণের শিকার হতে পারেন, তা পরিমাপ করা সম্ভব। এভাবে গর্ভধারণের পুরো ৯ মাসে মোট দূষণের পরিমাণ বের করেছেন গবেষকরা। এভাবেই সবচেয়ে কম ও সবচেয়ে বেশি দূষণের শিকার সন্তানসম্ভবা নারীদের শ্রেণি তৈরি করেছিলেন তারা। গবেষকেরা এর সঙ্গে মায়েদের জন্ম দেয়া সন্তানদের তথ্য মিলিয়েছেন এবং শেষে তুলনা করেছেন। তাতে বায়ুদূষণের ভূমিকাটি ধরা পড়েছে। জন্মের সময় নবজাতকের ওজন যদি ২ হাজার ৫০০ গ্রামের কম হয়, তাহলে তাকে ‘লো বার্থ ওয়েট’ বা কম জন্মওজন বলা হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, সবচেয়ে কম দূষণের শিকার মায়েদের মধ্যে কম ওজনের শিশু জন্ম দেয়ার হার ২০ শতাংশ। সবচেয়ে বেশি দূষণের শিকার মায়েদের মধ্যে এই হার ৩৬ শতাংশ। অর্থাৎ বেশি দূষণের শিকার মায়েদের মধ্যে কম ওজনের শিশু জন্ম দেয়ার হার ১৬ শতাংশীয় বিন্দু বেশি। কোনো শিশুর জন্ম মায়ের গর্ভধারণের ২৫৯ দিনের আগে হলে তা অকালিক শিশু হিসেবে বিবেচিত হয়। গবেষকরা দেখেছেন, সবচেয়ে কম দূষণের শিকার মায়েরা ৯ শতাংশ অকালিক শিশুর জন্ম দিয়েছেন। বেশি দূষণের শিকার মায়েদের মধ্যে এই হার ১৫ শতাংশ, অর্থাৎ ৬ শতাংশীয় বিন্দু বেশি। এ ক্ষেত্রেও পার্থক্যটি চোখে পড়ার মতো।

আইসিডিডিআর,বি’র গবেষকরা তাদের প্রবন্ধের সূচনা অংশে বিরূপ প্রভাবের কিছু উদাহরণও উদ্ধৃত করেছেন। তাতে বলা হয়েছে, বায়ুদূষণ ভ্রƒণের বিকাশ বাধাগ্রস্ত করে। বাতাসে থাকা অতি সূক্ষ্ম বস্তুকণার (পিএম ২.৫) কারণে ২০১৯ সালে সারা বিশ্বে আনুমানিক ২৮ লাখ কম জন্মওজনের ও ৫৯ লাখ অকালিক শিশুর জন্ম হয়েছিল। সময়ের আগে জন্ম নেয়া এবং কম জন্মওজন অর্থাৎ অপরিণত জন্ম বাংলাদেশে শিশুমৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ। বাংলাদেশে প্রতি ৪০টি নবজাতকের একটি জন্মের ২৮ দিনের মধ্যে মারা যায় অপরিণত অবস্থায় জন্মের কারণে। 

মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্য নিয়ে তিন দশকের বেশি সময় কাজ করেছেন জনস্বাস্থ্যবিদ আবু জামিল ফয়সাল। তিনি বলেন, বায়ুদূষণ থেকে স্বাস্থ্যকে রক্ষার জন্য যারা আন্দোলন বা দেনদরবার করছেন, এই গবেষণার তথ্য তাদের হাতিয়ার হিসেবে কাজ করবে। চাইলেও বায়ুদূষণ পুরোপুরি দূর করা যাবে না। তবে বেশি দূষণের এলাকায় মাত্রা কমিয়ে আনা সম্ভব। এটাও মনে রাখা দরকার যে, মাস্ক বায়ুদূষণ থেকে সুরক্ষা দেয়।
জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল এবং অ্যাজমা সেন্টারের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. খায়রুল আনাম মানবজমিনকে বলেন, তার হাসপাতালে দিন দিন রোগী বাড়ছে। তিনি বলেন, বায়ুদূষণের কারণে রোগী বৃদ্ধি পাচ্ছে এটা সঠিক। বায়ুদূষণের কারণে হাঁপানি, অ্যাজমা, নিউমোনিয়া নিয়ে রোগীরা আসছেন বেশি। তবে পোস্ট কোভিডের রোগীও পাচ্ছেন তারা। কারণ হিসেবে বললেন, কোভিড রোগীদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়ায় তারা এসব রোগে ভুগছেন। সব বয়সের রোগীরাই আসছে। তবে শিশু ও বৃদ্ধ যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম তারাও কম আসছে না তার হাসপাতালে। মুগদা জেনারেল হাসপাতালের শিশু বিভাগের অধ্যাপক ডা. মো. সেলিম মানবজমিনকে বলেন, বায়ুদূষণের ফলে শিশুদের এলার্জি সমস্যা বেশি বাড়ছে। অ্যাজমা রোগীও পাচ্ছেন তারা। 

রাজধানীর পুরান ঢাকার হাজারীবাগ পার্ক এলাকায় অবস্থিত একটি বড় ওষুধের ফার্মেসিতে বিকালের পর দেখা যায়, অনেক শিশুকে তাদের স্বজনরা শ্বাসকষ্টের জন্য নেবুলাইজার দিতে নিয়ে আসেন। এমন একজন স্বজনের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। স্বজন বললেন, তিন বছরের শিশুটিকে প্রায় ১০ থেকে ১৫ দিন পর পরই নেবুলাইজার দিতে হয়। তাদের পরিবারের অন্য কোনো সদস্যের এমন সমস্যা নেই বলেও তিনি জানিয়েছেন।
বৈশ্বিক বায়ুদূষণের ঝুঁকিবিষয়ক ‘দ্য স্টেট অব গ্লোবাল এয়ার-২০১৯’ শীর্ষক প্রতিবেদন অনুযায়ী বিশ্বের যে পাঁচটি দেশের শতভাগ মানুষ দূষিত বায়ুর মধ্যে বসবাস করে, তার একটি বাংলাদেশ। বায়ুদূষণজনিত মৃত্যুর সংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশ পঞ্চম। এ কারণে ২০১৭ সালে দেশে মারা গেছে ১ লাখ ২৩ হাজার মানুষ। ২০১৩ সালে পরিবেশ অধিদপ্তরের গবেষণা বলছে, ঢাকায় বায়ুদূষণের জন্য ইটভাটা দায়ী ৫৮ শতাংশ, রোড ডাস্ট ও সয়েল ডাস্ট ১৮, যানবাহন ১০, বায়োমাস পোড়ানো ৮ এবং অন্যান্য উৎস ৬ শতাংশ দায়ী। 

বিশ্বব্যাংকের তথ্য বলছে, দূষণের কারণে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে আছেন বয়স্ক মানুষ, শিশু এবং যাদের ডায়াবেটিস ও হৃদরোগ আছে তারা। দূষিত এলাকার প্রধান সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে শ্বাসকষ্ট। নিউমোনিয়াসহ অন্যান্য বক্ষব্যাধিও এসব এলাকার বয়স্ক ও শিশুদের মধ্যে দেখা গেছে। বায়ুদূষণের কারণে মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব পড়ছে। দূষিত এলাকাগুলোর মধ্যে বিষণ্নতার রোগী দেখা গেছে সবচেয়ে বেশি। ৬৫ বছর কিংবা তার চেয়ে বেশি বয়সী ব্যক্তিদের মধ্যে বিষণ্নতার মাত্রা দিন দিন বাড়ছে। পুরুষের চেয়ে নারীরা বেশি বিষণ্নতায় ভোগেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত দূষণের মাত্রা থেকে এক শতাংশ দূষণ বাড়লে বিষন্নতার অশঙ্কা ২০ গুণ বেড়ে যায়। বায়ুদূষণের কারণে অর্থনীতিও ক্ষতির মুখে পড়ছে। প্রতিবছর জিডিপি’র চার দশমিক চার শতাংশ ক্ষতি হচ্ছে।

গবেষণা বলছে, ঢাকায় সবচেয়ে বেশি বায়ুদূষণ হচ্ছে অপরিকল্পিত ও অনিয়ন্ত্রিত রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি ও নির্মাণ কাজের মাধ্যমে। বায়ূদূষণের জন্য নির্মাণখাত ৩০ শতাংশ দায়ী। এরপর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বায়ুদূষণ হচ্ছে ইটভাটা ও শিল্পকারখানার মাধ্যমে। যার হার ২৯ শতাংশ। বায়ুদূষণের তৃতীয় সর্বোচ্চ কারণ হলো যানবাহনের কালো ধোঁয়া, যার শতকরা হার ১৫ শতাংশ। ঢাকার স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটির বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) গবেষণায় এই তথ্য উঠে এসেছে। 
এদিকে, এবার গবেষকেরা ঢাকার বাতাসে বিষাক্ত অতিক্ষুদ্র প্লাস্টিক কণা বা মাইক্রো প্লাস্টিকের অস্তিত্ব খুঁজে পেয়েছেন। ঢাকাবাসীর নিঃশ্বাসের সঙ্গে ওই কণা শরীরে প্রবেশ করছে। এতে ক্যান্সার, শ্বাস-প্রশ্বাসের রোগ তৈরি হচ্ছে, যা ওষুধেও দূর হবে না বলে আশঙ্কা করছেন চিকিৎসকেরা। ফলে এর উৎস নিয়ন্ত্রণে জোর দিয়েছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।

প্রথম পাতা থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

প্রথম পাতা সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status