ঢাকা, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, শুক্রবার, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

শেষের পাতা

সর্বজনীন পেনশন আস্থা আর স্বচ্ছতা নিশ্চিতই বড় চ্যালেঞ্জ

অর্থনৈতিক রিপোর্টার
২৭ জানুয়ারি ২০২৩, শুক্রবার
mzamin

সরকারি চাকরিজীবীদের বাইরে দেশের সব প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিককে পেনশন ব্যবস্থার আওতায় আনতে জাতীয় সংসদে বহুল আলোচিত ‘সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনা বিল-২০২৩’- পাস হয়েছে। খসড়া বিলে বলা হয়েছে, সামাজিক নিরাপত্তা প্রদান, বেকারত্ব, ব্যাধি, পঙ্গুত্ব বা 
বার্ধক্যজনিত কারণে নাগরিকদের সরকারি সাহায্য দেয়া, বয়স্ক জনগোষ্ঠীকে একটি টেকসই নিরাপত্তা বলয়ে নিয়ে আসার উদ্দেশ্যে এই সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা তৈরি করা হচ্ছে। সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালু করা একটি ভালো উদ্যোগ বলে উল্লেখ করেছেন অর্থনীতিবিদরা। এ ছাড়া আস্থা আর স্বচ্ছতা নিশ্চিত করাও বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করেন তারা। কারণ এখানে একটা বড় ফান্ড তৈরি হবে, সেটার সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। এদিকে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা নিয়ে বেশকিছু অসঙ্গতি তুলে ধরে বিরোধীদলীয় সংসদ সদস্যরা সমালোচনা করেন। 
সংশ্লিষ্টরা জানান, দেশে গড় আয়ু ও প্রবীণের সংখ্যা বাড়ায় সামাজিক নিরাপত্তাহীনতার ঝুঁকি বাড়ছে। এ অবস্থায় সর্বজনীন পেনশন স্কিমের প্রয়োজনীয়তাও বাড়ছে। অবশ্য এটি নতুন কোনো ধারণা নয়। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও এ স্কিম চালু আছে। নেদারল্যান্ডসসহ অনেক উন্নত দেশে এ স্কিম কার্যকর রয়েছে। 
‘সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনা বিল-২০২৩’ মঙ্গলবার সংসদে কণ্ঠভোটে পাস হয়।

বিজ্ঞাপন
এর জন্য পৃথক কর্তৃপক্ষ গঠন করা হবে। আগামী ছয় মাস থেকে এক বছরের মধ্যে এ ব্যবস্থা চালু করা সম্ভব হবে বলে জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এই স্কিমে ১৮ থেকে ৫০ বছর বয়সী কোনো নাগরিক যদি প্রতি মাসে ১০ বছর টাকা জমা করেন, তাহলে তার বয়স ৬০ পার হলেই সরকার তাকে প্রতি মাসে পেনশন দেবে। কিস্তির হার কত হবে, তা এখনও নির্ধারণ হয়নি। 
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, দেশে ১৮ থেকে ৫০ বছর বয়সী মানুষের সংখ্যা প্রায় সাড়ে ৮ কোটি। এর মধ্যে সরকারি চাকরিজীবী রয়েছেন ১৪ লাখের কিছু বেশি। বিলটি আইনে পরিণত হলে অর্থাৎ সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালু হলে প্রায় ৮ কোটি ৩৫ লাখ মানুষ এই ব্যবস্থার আওতায় আসবেন।
যেসব শর্তে পেনশন ব্যবস্থা চালু হতে পারে:
১. জাতীয় পরিচয়পত্রের ভিত্তিতে ১৫ থেকে ৫০ বছর বয়সী নাগরিকরা এই স্কিমে অংশ নিতে পারবেন।
২. বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশি নাগরিকরাও অন্তর্ভুক্ত হতে পারবেন।
৩. সরকার প্রজ্ঞাপন জারি না করা পর্যন্ত সরকারি, আধা-সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থার বাইরে থাকবে। এ ধরনের চাকরিজীবীরা এর মধ্যেই অবশ্য সরকারিভাবে পেনশন সুবিধা পেয়ে থাকেন।
৪. প্রাথমিকভাবে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্তি স্বেচ্ছামূলক থাকবে। তবে পরবর্তীতে সরকার বাধ্যতামূলক করতে পারে।
৫. এই পেনশন ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্তি হওয়ার পর কমপক্ষে ১০ বছর চাঁদা প্রদান করলে পেনশন সুবিধা পাওয়ার যোগ্যতা হবে। চাঁদা দাতার বয়স ৬০ বছর পূর্তিতে পেনশন তহবিলে জমা ও মুনাফার বিপরীতে তিনি পেনশন পাবেন। ইলেকট্রনিক ফান্ড ব্যবস্থাপনায় গ্রহীতার কাছে পেনশন পৌঁছে দেয়া হবে।
৬. প্রত্যেক চাঁদা দাতার জন্য আলাদা আলাদা পেনশন হিসাব থাকবে।
৭. চাকরিজীবীরা চাকরি পরিবর্তন করলেও নতুন করে হিসাব খুলতে হবে না। নতুন কর্মস্থলের বিপরীতে তাদের আগের হিসাবই পরিচালিত হবে।
৮. পেনশন কর্তৃপক্ষ সর্বনিম্ন চাঁদার হার নির্ধারণ করে দেবে। এই চাঁদা মাসিক ও ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে, অগ্রিম বা কিস্তি আকারে জমা দেয়া যাবে। তবে চাঁদার হার কত হবে, তা এখনো নির্ধারিত হয়নি।
৯. কোনো কারণে মাসিক চাঁদা জমা দিতে দেরি হলে জরিমানা হবে। পরবর্তীতে জরিমানার টাকা সহ মাসিক চাঁদা জমা দিয়ে পেনশন হিসাব সচল রাখতে হবে।
১০. পেনশনারগণ আজীবন, অর্থাৎ মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত পেনশনের সুবিধা পাবেন।
১১. পেনশনে থাকাকালে ৭৫ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই মৃত্যু হলে, তার নমিনি অবশিষ্ট সময় (মূল পেনশনারের ৭৫ বছর পূর্ণ হওয়া পর্যন্ত) মাসিক পেনশন পাবেন।
১২. পেনশন তহবিলে অন্তর্ভুক্ত হয়ে চাঁদা দেয়া শুরু করে ১০ বছর পার হওয়ার আগেই কেউ মারা গেলে, তার সব জমা টাকা মুনাফাসহ তার নমিনিকে ফেরত দেয়া হবে।
১৩. পেনশন তহবিলে জমা দেয়া টাকার ৫০ শতাংশ পর্যন্ত চাঁদা দাতা ঋণ আকারে উত্তোলন করতে পারবেন। তবে সেজন্য ফি দিতে হবে। পরবর্তীতে ফিসহ মূল টাকা আবার পেনশন তহবিলে ফেরত দিতে হবে।
১৪. পেনশন তহবিলে যে টাকা জমা দেয়া হবে, সেজন্য কর রেয়াত পেতে পারে। মাসিক পেনশন হিসাবে পাওয়া টাকাও করমুক্ত আয় থাকবে।
১৫. সার্বজনীন পেনশন পদ্ধতিতে সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান অংশ নিতে পারবে। সেক্ষেত্রে কর্মী ও প্রতিষ্ঠানের চাঁদার অংশ জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ নির্ধারণ করে দেবে।
১৬. নিম্ন্ন আয়ের মানুষের জন্য পেনশন তহবিলে চাঁদার একটি অংশ সরকার অনুদান হিসাবে দেবে।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, আগামী ১লা জুলাই থেকে চালু করা হবে ‘সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা’ স্কিমের পরীক্ষামূলক কার্যক্রম। শুরুতে মডেল জেলা হিসেবে রাখা হবে ঢাকাসহ দেশের অন্য যে কোনো একটি জেলাকে। পরীক্ষামূলক এ কার্যক্রমের মেয়াদ হবে সর্বোচ্চ দুই বছর। এর সাফল্যের ওপর ভিত্তি করে পরবর্তী দুই বছরের মধ্যে ‘সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা’ একই পদ্ধতিতে সারা দেশে বিস্তৃত করা হবে। তবে শুরুর প্রক্রিয়াটি হবে সীমিত পরিসরে। সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা সারা দেশে চালু হওয়ার পর অন্তত পাঁচ বছর তা ঐচ্ছিক রাখা হবে। পরে ২০২৮-২০৩০ সালের মধ্যে এটি সবার জন্য বাধ্যতামূলক করা হতে পারে।
জাপার সংসদ সদস্য মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, এটা ব্যাংকের ডিপিএস স্কিমের মতো। গুঞ্জন আছে, সরকারের টাকার অভাব হয়েছে। জনগণের কাছ থেকে টাকা নিয়ে কি সরকার চলবে? 
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, এই স্কিম উন্নত অনেক দেশে আছে। দেশে চালু করা বেশ ভালো উদ্যোগ। তবে বর্তমানে দেশে প্রাতিষ্ঠানিক যে কাঠামো বিরাজ করছে তাতে এই স্কিম বাস্তবায়ন করা বেশ কঠিন হতে পারে। কারণ আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে সুশাসনের খুবই অভাব। সেই জায়গায় নতুন আরেকটি বড় তহবিলের প্রতিষ্ঠান গঠন হবে, সেখানে জবাবদিহিতা কতোটা নিশ্চিত করা যাবে সেটা বড় চ্যালেঞ্জ হতে পারে। 
অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মুনসুর বলেন, একটি জাতি যখন সামনে এগোয় এবং উন্নত হয় তখন তাদের জন্য আর্থিক সুরক্ষা দরকার হয়। সেই হিসেবে সর্বজনীন পেনশন স্কিম দরকার আছে। বরং আরও আগে বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন ছিল। শুরুটা হচ্ছে এটা ভালো। তবে চ্যালেঞ্জ আছে। কারণ এখানে বড় একটা তহবিল তৈরি হবে। এই তহবিল কীভাবে ব্যবহার হবে? টাকা যাতে অন্যত্র সরিয়ে নিতে না পারে তার নিশ্চিয়তা দিতে হবে। এখানে অনেকের কষ্টার্জিত টাকা থাকবে। তিনি বলেন, মানুষ টাকা দিবে এর জন্য স্বচ্ছতা দেখাতে হবে। সাধারণ মানুষের আস্থা তৈরি করতে হবে। তা না হলে ভালো উদ্যোগ হলেও সফলতার মুখ দেখবে না। 
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফলো অধ্যাপক ড. মুস্তাফিজুর রহমান সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, এটা সব শ্রেণির মানুষের কাছে সঠিকভাবে তুলে ধরতে হবে। প্রথমত: পুরো পেনশন ব্যবস্থার সুবিধার ব্যাপারে সবাইকে সুস্পষ্টভাবে জানাতে হবে, যে কত চাঁদা দিলে কত টাকা পাওয়া যাবে। সরকারের একটা ভালো ডাটাবেজ থাকতে হবে। আরেকটি বড় বিষয় হলো- এখানে তো বড় আকারের একটা ফান্ড হবে। সেটা কীভাবে ব্যবহার করা হবে, কীভাবে বিনিয়োগ করা হবে, সেটার সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। পেনশন তহবিলের কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে বলে তিনি মনে করেন। প্রথমত: পুরো ব্যবস্থাকে ডিজিটাল প্লাটফর্মের মাধ্যমে নজরদারি করা। দ্বিতীয়ত: যে কর্তৃপক্ষ থাকবে, তারা যাতে বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত ঠিকভাবে নিতে পারেন সেটা দেখা এবং তৃতীয়ত: স্বচ্ছতা, নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। কারণ এটা খুব বড় একটা তহবিল হবে, সেটাকে নিরাপদ ও সঠিকভাবে ব্যবহার করতে হবে।

 

শেষের পাতা থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

   

শেষের পাতা সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status