প্রথম পাতা
সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমেছে
অর্থনৈতিক রিপোর্টার
৩ অক্টোবর ২০২২, সোমবার
সুদের হার হ্রাস ও নানা কড়াকড়ি আরোপের পরও সাধারণ মানুষের সবচেয়ে নিরাপদ বিনিয়োগ সঞ্চয়পত্র বিক্রি বেড়েছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে বাজারে সব নিত্যপণ্যের দাম চড়াসহ পরিবহন, শিক্ষা, চিকিৎসার খরচ বেড়েছে। এতে মানুষের সঞ্চয় করার ক্ষমতা কমে গেছে। এর প্রভাবে সঞ্চয়পত্র বিক্রি তলানিতে নেমে এসেছে।
দীর্ঘদিনের সঞ্চয়ের টাকা দিয়ে বছর দুয়েক আগে দশ লাখ টাকার পরিবার সঞ্চয়পত্র কিনেছিলেন রুবিনা ইসলাম। স্বামীর বেতনের সঙ্গে প্রতি মাসে সঞ্চয়পত্রের মুনাফা বাবদ সাড়ে ৮ হাজার টাকা যোগ হওয়ায় তাদের পাঁচ জনের পরিবার ভালোই চলছিল। কিন্তু করোনার মহামারি, নিত্যপণ্যের দাম ঊর্ধ্বমুখী, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও দেশে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধিতে সবকিছু এলোমেলো করে দিয়েছে। তিনি বলেন, এখন সংসার চালানো কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। মেয়াদ পুরো হওয়ার আগেই সঞ্চয়পত্রের বিনিয়োগ ভেঙে সংসারের খরচ মেটাচ্ছি। আগে তারা সংসার খরচ থেকে জমানো টাকা দিয়ে সঞ্চয়পত্র কিনেছিলেন, অথচ এখন তাদের সেই টাকা ভাঙতে হচ্ছে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, মধ্যবিত্ত ও নিম্ন আয়ের মানুষেরা শুধু জমানো সঞ্চয় নয়, সঞ্চয়পত্র ভেঙে জীবিকা নির্বাহ করছে। পাশাপাশি অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্থবির হয়ে পড়ায় কমেছে মানুষের আয়ও। ব্যাংকগুলোর আমানতের সুদের হার কম এবং পুঁজিবাজারে দীর্ঘ মন্দার কারণে বেশ কয়েক বছর ধরে লাফিয়ে বাড়ছিল সঞ্চয়পত্র বিক্রি। কিন্তু এখন বাজারে সব জিনিসের দামই চড়া। এর প্রভাব পড়ছে সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে।
জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের সঞ্চয়পত্র বিক্রির হালনাগাদ তথ্যে দেখা গেছে, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের দ্বিতীয় মাস আগস্টে মাত্র ৮ কোটি টাকার নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে, যা দেশের ইতিহাসে সর্বনিম্ন। গত বছরের আগস্টে নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রির পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ৬২৮ কোটি ৫৮ লাখ টাকা। এই সংখ্যা গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৪৪৯ গুণ এবং আগের মাসের (জুলাই ২০২২) চেয়ে ৪৮ গুণ কম। অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে ৩৯৩ কোটি ১১ লাখ টাকার নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। গত বছরের জুলাইয়ে বিক্রির অঙ্ক ছিল ২ হাজার ১০৪ কোটি টাকা। এ হিসাবে এই বছরের জুলাইয়ের চেয়ে গত বছরের জুলাইয়ে সঞ্চয়পত্র খাতে সাড়ে পাঁচ গুণ বেশি বিনিয়োগ হয়েছিল। ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে (জুলাই-আগস্ট) ৪০১ কোটি ২০ লাখ টাকার নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। গত বছরের একই সময়ে এই বিক্রির পরিমাণ ছিল ৫ হাজার ৭৩২ কোটি ৫৮ লাখ টাকা।
প্রতিবেদন বলছে, গত অর্থবছরের আগস্টে রেকর্ড ৩ হাজার ৬২৮ কোটি ৫৮ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছিল। আর গত অর্থবছরের শেষ মাস জুনে সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছিল ১ হাজার ৭৪৯ কোটি টাকা। কিন্তু চলতি অর্থবছরে সেই বিক্রিতে ব্যাপক ধস নেমেছে। অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে নিট বিক্রি হয় ৩৯৩ কোটি টাকা। আর গত আগস্টে তা ব্যাপকভাবে কমে মাত্র ৮ কোটিতে নেমে এসেছে।
জানা গেছে, বিক্রির চাপ কমাতে ২০১৯ সালের ১লা জুলাই থেকে মুনাফার ওপর উৎসে করের হার ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হয়। একই সঙ্গে এক লাখ টাকার বেশি সঞ্চয়পত্র কিনতে টিআইএন (কর শনাক্তকরণ নম্বর) বাধ্যতামূলক করা হয়। ব্যাংক অ্যাকাউন্ট না থাকলে সঞ্চয়পত্র বিক্রি না করার শর্ত আরোপসহ আরও কিছু কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হয়। তারপরও বাড়তে থাকে বিক্রি। এর পর গত বছরের ২২শে সেপ্টেম্বর থেকে ১৫ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সব ধরনের সঞ্চয়পত্রের সুদের হার ২ শতাংশের মতো কমিয়ে দেয় সরকার। এর পরও বিক্রি বাড়ছিল। তবে গত কয়েক মাস ধরে বিক্রি বেশ কমেছে। এখন একেবারে তলানিতে নেমে এসেছে।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষক জায়েদ বখত বলেন, গত দুই বছরের করোনা মহামারির কারণে মানুষের আয়-উপার্জন কমে গেছে। অনেকে চাকরি হারিয়ে গ্রামে চলে গেছেন। কারও বেতন কমেছে। এরপর শুরু হয় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কা। এই ধাক্কায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশে ডলারের বিপরীতে টাকার ব্যাপক দরপতন হয়েছে। জ্বালানি তেলের দাম বাড়াতে বাধ্য হয়েছে সরকার। আগে থেকেই বাজারে জিনিপত্রের দাম বেশি ছিল। এরপর যুদ্ধের কারণে তা আরও বেড়ে গেছে। ফলে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় অর্থাৎ বাজারে জিনিসপত্রের দাম বাড়ায় মানুষের সঞ্চয় করার ক্ষমতা কমে গেছে। এ কারণে মানুষ আর আগের মতো সঞ্চয়পত্র কিনতে পারছে না। আর সঞ্চয়পত্র কেনার মতো সঞ্চয় নেই মানুষের কাছে। সে কারণে কমে গেছে এ খাতে বিনিয়োগ।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, পয়েন্ট-টু-পয়েন্ট ভিত্তিতে (মাসভিত্তিক) গত জুলাই মাসে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৭.৪৮ শতাংশ। সেপ্টেম্বর মাস শেষ হয়ে গেলেও আগস্ট মাসের মূল্যস্ফীতির তথ্য প্রকাশ করেনি বিবিএস। অনেকের ধারণা ৯ শতাংশ ছাড়িয়ে ১০ শতাংশের কাছাকাছি গিয়ে পৌঁছতে পারে।