প্রথম পাতা
এবার রপ্তানিতেও হোঁচট
অর্থনৈতিক রিপোর্টার
৩ অক্টোবর ২০২২, সোমবারমহামারি করোনাভাইরাসের মধ্যে রপ্তানি আয় ঘুরে দাঁড়ালেও ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ আর গ্যাস সংকটের কারণে পোশাক রপ্তানিতে বড় ধাক্কা লেগেছে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) জুলাই-সেপ্টেম্বর ২০২২-২৩ অর্থবছরের রপ্তানি আয়ের তথ্যে দেখা গেছে, সদ্য সমাপ্ত সেপ্টেম্বর মাসে বিভিন্ন দেশে ৩৯০ কোটি ৫০ লাখ ডলার পণ্য রপ্তানি করেছেন উদ্যোক্তারা। এই আয় গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৬.২৫ শতাংশ কম। আর নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৭.০২ শতাংশ কম। সেপ্টেম্বরে পণ্য রপ্তানি থেকে ৪.২০ বিলিয়ন ডলার আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল সরকারের। সেপ্টেম্বরে পোশাক রপ্তানি অস্বাভাবিকভাবে কমে গেছে। ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর মাসের তুলনায় প্রবৃদ্ধি ৭.৫২ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। দীর্ঘ ১৩ মাস পর রপ্তানি আয়ের প্রবৃদ্ধিতে হোঁচট খেলো বাংলাদেশ। গতকাল ইপিবি প্রকাশিত তথ্য বিবরণী থেকে এ তথ্য জানা গেছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, যেমনটা আশঙ্কা করা হচ্ছিল, তেমনটিই ঘটতে শুরু করেছে।
ইপিবি তথ্যে দেখা গেছে, চলতি অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে বাংলাদেশের রপ্তানিকারকরা ১২.৫০ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করছেন, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ১৩.৩৮ শতাংশ বেশি। আর লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি ০.৬২ শতাংশ। এর আগে ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে আগের বছরের জুলাইয়ের চেয়ে রপ্তানি আয় কমেছিল ৬.০১ শতাংশ। এরপর থেকে এক বছরের বেশি সময় ধরে রপ্তানি আয়ে বড় প্রবৃদ্ধি হচ্ছিল। ৩৪.৩৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি নিয়ে ২০২১-২২ অর্থবছর শেষ হয়েছিল। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ২৫.৩১ শতাংশ। কিন্তু সেপ্টেম্বর মাসে এসে ৬.২৫ শতাংশ নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছে। ইপিবি’র তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, সেপ্টেম্বর মাসে রপ্তানি আয়ে যে ধাক্কা লেগেছে, তা মূলত তৈরি পোশাক রপ্তানি কমার কারণে হয়েছে। গত মাসে ৩১৬ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছে, যা গত বছরের সেপ্টেম্বরের তুলনায় ৭.৫২ শতাংশ কম। গত মাসে ওভেন ও নিট উভয় ধরনের পোশাক রপ্তানিই হ্রাস পেয়েছে।
ইপিবি’র তথ্য মতে, চলতি অর্থবছরের জুলাই-আগস্ট সময়ে তৈরি পোশাক রপ্তানি থেকে এসেছে ১ হাজার ২৭ কোটি ৪৩ লাখ ডলার, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ১৩.৪১ শতাংশ বেশি। আর জুলাই-আগস্ট ও সেপ্টেম্বর এই ৩ মাসের মধ্যে সবচেয়ে কম পোশাক রপ্তানি হয়েছে গত সেপ্টেম্বর মাসে। সেপ্টেম্বর মাসে পোশাক রপ্তানিতে আয় হয়েছে ৩১৬ কোটি ডলার। আগের বছরের সেপ্টেম্বরে এসেছিল ৩৪১ কোটি ডলার। চলতি বছরের আগস্টে পোশাক রপ্তানি করে আয় হয়েছিল ৩৭৪ কোটি ডলার। আর আগের মাস জুলাইয়ে রপ্তানি হয়েছিল ৩৩৬ কোটি ডলার। ইপিবি’র তথ্য অনুযায়ী, সেপ্টেম্বরে নিট পোশাক থেকে এসেছে ১৭৩ কোটি ডলার। আগের বছরের একই সময়ে রপ্তানি হয়েছিল ১৯০ কোটি ডলার। আর সেপ্টেম্বর মাসে ওভেন পোশাক রপ্তানি হয়েছে ১৪২ কোটি ডলার। আগের বছরের একই সময়ে রপ্তানি হয়েছিল ১৫১ কোটি ডলার। যদিও আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে জুলাইয়ে পোশাক খাতে রপ্তানি ১৬.৬১ বেড়েছিল। এ ছাড়া আগস্টে পোশাক খাতে রপ্তানি বেড়েছিল ৩৬.০৪ শতাংশ।
পোশাক শিল্প মালিকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমই’র সাবেক সভাপতি এবং বাংলাদেশ চেম্বারের বর্তমান সভাপতি আনোয়ার-উল-আলম চৌধুরী পারভেজ বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বাংলাদেশের পোশাকের প্রধান দুই বাজার যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দেশগুলোতে মূল্যস্ফীতি অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় তারা পোশাক কেনা কমিয়ে দিয়েছে। তাদের এখন খাদ্যের পেছনেই অনেক বেশি খরচ করতে হচ্ছে। সে কারণেই আমাদের রপ্তানি আয় কমছে। বিশ্বব্যাংক-আইএমএফসহ বিভিন্ন সংস্থা বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দার আশঙ্কা করছে। এ অবস্থায় আগামী দিন আমাদের রপ্তানি আয়ে সুখবর নেই বলেই মনে হচ্ছে।
বিজিএমইএ পরিচালক ও মুখপাত্র মহিউদ্দিন রুবেল বলেন, সেপ্টেম্বর থেকে যে প্রবৃদ্ধিতে মন্দা হবে, সে বিষয়ে ইতিমধ্যে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে বিজিএমইএ, যা সেপ্টেম্বরের রপ্তানি পরিসংখ্যানে স্পষ্টতই প্রতিফলিত হয়েছে। কোভিড পরবর্তীতে বিশ্বব্যাপী খুচরা বাজার বিভিন্ন সংকটের কারণে ব্যাহত হচ্ছে। বিশেষ করে, কনটেইনারের অপ্রতুলতা এবং সাপ্লাই চেইন সংকট, কাঁচামালের মূল্য বৃদ্ধি এবং পরবর্তীতে বিশ্ব অর্থনীতিতে পূর্বাভাষ অনুযায়ী মন্দার আবির্ভাব। যার কারণে খুচরা বিক্রয়ে ধস নেমেছে, ক্রেতাদের পোশাকের চাহিদা হ্রাস পাচ্ছে, প্রভৃতি সংকটে শিল্প বিপর্যস্ত। তিনি বলেন, ক্রেতারা তাদের ইনভেন্টরি এবং সাপ্লাই চেইনকে নিজেদের জন্য লাভজনক রাখতে সতর্কতামূলক পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করেছে, এমনকি তাদের মধ্যে কেউ কেউ উৎপাদন এবং অর্ডার পর্যন্ত আটকে রেখেছে। মহিউদ্দিন রুবেল বলেন, সামগ্রিকভাবে শিল্পের জন্য একটি বিপর্যয়কর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। যদিও আমরা টেকসই উন্নয়ন এবং প্রতিযোগী সক্ষমতায় আমাদের শক্তি আমরা দেখিয়েছি, তারপরও বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ২০২২ সালের শেষ ত্রৈমাসিকের জন্য আশাব্যঞ্জক কিছু অনুমান করা কঠিন করে তোলে।
চলতি অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর পাট ও পাটজাত দ্রব্যে ১৫.৭১ শতাংশ, প্লাস্টিক পণ্যে ৫৬.৫৫ শতাংশ ও চামড়াজাত পণ্যে ২০.৮৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। অন্যদিকে গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় কম আয় হয়েছে একাধিক পণ্যে। কৃষিপণ্যে ১৭.৯৮ শতাংশ, কেমিক্যাল পণ্যে ২৩.২৮ শতাংশ ও কাঁচাজাত পণ্যে ৫২.৭৯ শতাংশ কম আয় হয়েছে।