ঢাকা, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, শুক্রবার, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

শেষের পাতা

নাইজেরিয়ানদের পার্সেল ফাঁদ

শ’ শ’ কোটি টাকার প্রতারণায় নিঃস্ব অনেকে

শুভ্র দেব
২৯ সেপ্টেম্বর ২০২২, বৃহস্পতিবার

কৌশল একই। নাটের গুরুও একই দেশের নাগরিক। টার্গেটও সামাজিক যোগাযোগ ব্যবহারকারীরা। টাকা আদায়ের কৌশলও এক। শুধু ভিন্ন ভিন্ন চক্র এই প্রতারণায় জড়িত। বহু বছর ধরে ফেসবুকে ছদ্ম পরিচয়ে বাংলাদেশের নারী-পুরুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব তৈরি করে শ’ শ’ কোটি টাকা হাতিয়ে  নিয়েছে কয়েকটি পার্সেল প্রতারক চক্র। তাদের প্রতারণায় নিঃস্ব হয়েছে বহু মানুষ। ভুক্তভোগীরা প্রতারিত হয়ে প্রশাসনের কাছে অভিযোগ করছে। বিভিন্ন অভিযোগের প্রেক্ষিতে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে শতাধিক প্রতারককে গ্রেপ্তার করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এসব প্রতারকদের ৯০ শতাংশই নাইজেরিয়ান নাগরিক।

বিজ্ঞাপন
গ্রেপ্তারের পর তাদের বিরুদ্ধে মামলা-জেল হয়েছে। কিন্তু তবুও থেমে নেই এই প্রতারণা। বরং প্রতিনিয়ত নতুন নতুন প্রতারক চক্রের সৃষ্টি হচ্ছে। আর নতুন নতুন ব্যক্তিরা তাদের ফাঁদে পড়ে বিদেশি পার্সেল পাওয়ার লোভে প্রতারিত হচ্ছে।  সূত্রগুলো বলছে, পার্সেল প্রতারকদের প্রতিটি চক্র একই কৌশলে প্রতারণা করে। তারা প্রথমে বিভিন্নভাবে সাধারণ মানুষের ফেসবুক আইডি, হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর, ই-মেইল সংগ্রহ করে। পরে ইউএস আর্মি, ইউএস নেভীসহ বিভিন্ন ধরনের ছদ্ম পরিচয় ও ছবি দিয়ে ফেক  ফেসবুক আইডি তৈরি করে সাধারণ মানুষের ওইসব আইডিকে টার্গেট করে বন্ধু হওয়ার প্রস্তাব পাঠায়। তারপর টার্গেট করা ওই ব্যক্তির সঙ্গে চ্যাটিংয়ের মাধ্যমে কথা বলে সম্পর্ক গড়ে তোলে। সম্পর্ক গভীর করার জন্য তারা নিজেদের বিভিন্নভাবে উপস্থাপন করে।

 কখনো বলে তারা আমেরিকার আর্মিতে চাকরি করে। আবার কেউ বলে তারা নেভিসহ অন্যান্য বড় বড় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত। একপর্যায়ে তারা টার্গেট ব্যক্তিদেরকে নানা রকম উপহার পাঠানোর কথা বলে। কৌশল হিসাবে তারা স্বর্ণ, দামি পাথর, হীরা, জহরত, বিশাল অংকের বৈদেশিক মুদ্রা, ডলার, ইউরো ইত্যাদির ছবি পাঠায়। পাশাপাশি প্রতারণার উদ্দেশ্যে টার্গেট ব্যক্তির নাম ঠিকানা সংগ্রহ করে পার্সেল পাঠিয়েছে বলে বুকিং স্লিপের ছবি পাঠায়। এতে করে দেশে থাকা পার্সেল প্রত্যাশীদের আগ্রহ আরও বাড়ে এবং প্রতারককে তারা বিশ্বাস করে।  তারপর প্রতারক চক্রের কলিং ডিভিশন থেকে বাংলাদেশি মোবাইল নম্বর দিয়ে কাস্টমস অফিসার সেজে ভুক্তভোগীকে কল দিয়ে জানানো হয় একটি পার্সেল এসেছে। কাস্টমস অফিস থেকে এটি ছাড়িয়ে নিতে হবে। এজন্য বড় অংকের কাস্টমস ফি লাগবে। এ সময় প্রতারকরা ভুক্তভোগীকে তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন একটি ব্যাংক হিসাব নম্বরও দেয়। ভুক্তভোগী তখন বিদেশি বন্ধুর পার্সেল পাওয়ার আশায় তাদের পাঠানো ব্যাংক হিসাব নম্বরে টাকা পাঠিয়ে দেয়। টাকা পাওয়ার পরও থামে না প্রতারকদের লোভ। এ সময় কাস্টমস কর্মকর্তা পুনরায় ফোন দিয়ে ভুক্তভোগীকে জানায়, পার্সেল বক্সে অবৈধ কিছু মালামাল রয়েছে এগুলো ছাড়ানোর জন্য আরও টাকা প্রয়োজন। টাকা না দিলে ভুক্তভোগীর নামে মানি লন্ডারিং আইনে মামলা হবে বলেও ভয়ভীতি দেখায় কাস্টমস অফিসার নামীয় প্রতারকরা। মামলা থেকে বাঁচার জন্য ভুক্তভোগী আবারো প্রতারকদের চাহিদামতো টাকা দেয়। সেই টাকা পাওয়ার পর আবার ভিন্ন কৌশলে টাকা দাবি করে প্রতারকরা।

 ফোন করে প্রতারক ভুক্তভোগীকে জানায় ঘটনাটি পুলিশ ও সাংবাদিকরা জেনে গেছে তাই তাদেরকেও ম্যানেজ করতে হবে। এজন্য আরও টাকার প্রয়োজন। এভাবে কৌশলে প্রতারকরা এক ভুক্তভোগীর কাছ থেকে কয়েক লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়। এদিকে ভুক্তভোগী অপেক্ষায় থাকে কখন পার্সেল হাতে এসে পৌঁছাবে। অন্যদিকে প্রতারকরা তাদের মোবাইল নম্বর ও ফেসবুক আইডি বন্ধ করে দিয়ে উধাও হয়ে যায়।  তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেছেন, প্রতারক চক্রটি নারীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার লোকজনের সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বন্ধুত্ব স্থাপন করে পরে লোভ দেখিয়ে পার্সেল পাঠানোর কথা বলে প্রতারণা করে। কাস্টমস কর্মকর্তা পরিচয়ে কল দেয়ার জন্য তাদের একটি কলিং ডিভিশন আছে। কলের জন্য বেশিরভাগ সময় বাংলাদেশি নারীদের ব্যবহার করা হয়। নাইজেরিয়া, ক্যামেরুন এবং অ্যাঙ্গোলাসহ বিভিন্ন আফ্রিকান দেশের নাগরিকরা ভিজিট, স্টুডেন্ট, ফুটবল খেলা ও পোশাক ব্যবসার কথা বলে বাংলাদেশে আসে। এখানে আসার পর তাদের ভিসার মেয়াদ শেষ হলেও তারা নিজ দেশে ফেরত যায় না। তারা প্রতারণাসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত হয়ে যায়। কর্তৃপক্ষের নজরদারি এড়াতে বিপথগামী নাগরিকরা শুধু বাংলাদেশ নয় সারা বিশ্বেই পার্সেল প্রতারণার মাধ্যমে অবৈধভাবে উপার্জিত অর্থ সরাসরি তাদের নিজ দেশে না নিয়ে ব্যবসার মাধ্যমে বিভিন্ন দেশে পাঠিয়ে দেয়। চলতি মাসে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগ একটি পার্সেল প্রতারণা চক্রের মূলহোতাসহ ১১ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। এদের মধ্যে পাঁচজনই নাইজেরিয়ান, অ্যাঙ্গোলান ও ক্যামেরুনের নাগরিক। এদের মূলহোতা বাংলাদেশের বিপ্লব লস্কর (৩৪)। এই বিপ্লব লস্কর গোপালগঞ্জের মোকসেদপুরে বিভিন্ন বাজারে এবং ঘাটে বাবা-ভাইদের সঙ্গে এক সময় কুলি হিসাবে কাজ করতো। 

কিন্তু কুলির কাজ ছেড়ে ঢাকায় এসে নাইজেরয়িানদের সঙ্গে জড়িত হয়ে পার্সেল প্রতারণা শুরু করে। তারপর আর  পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। এক দশকে বিপ্লব লস্কর শত কোটি টাকার মালিক হয়েছে বলে জানিয়েছে ডিবি। তার সঙ্গে সঙ্গে ওই তিন দেশের নাগরিকরাও কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এর আগেও ডিবি’র অন্যান্য টিম পার্সেল প্রতারণার সঙ্গে জড়িত দেশি-বিদেশি অনেককেই গ্রেপ্তার করেছে। এসব চক্রও কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। ডিবির পাশপাশি সিআইডি ও র‌্যাবও অনেক পার্সেল প্রতারক বিদেশি নাগরিককে গ্রেপ্তার করেছে।  ডিবি সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, পার্সেল প্রতারণার সঙ্গে অনেক চক্র জড়িত। মূলত নাইজেরিয়ান নাগরিকদের হাত ধরেই এসব প্রতারণা দেশে ছড়িয়েছে। একেকটি চক্রকে ধরার পরে কিছুদিন পর নতুন চক্র প্রতারণা শুরু করে। মানুষ লোভে পড়ে তাদের ফাঁদে পা দেয়। উপহার পাওয়ার জন্য অনেকে তার শেষ সম্বলও প্রতারকদের হাতে তুলে দেয়।

শেষের পাতা থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

   

শেষের পাতা সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status