ঢাকা, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, শুক্রবার, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

শেষের পাতা

সংবাদ সম্মেলনে বক্তারা

ভারতের সঙ্গে কুশিয়ারার পানি প্রত্যাহার চুক্তি একটা ভুল দৃষ্টান্ত

স্টাফ রিপোর্টার
১৮ সেপ্টেম্বর ২০২২, রবিবার
mzamin

দেশের ভেতরে কুশিয়ারা নদী থেকে ১৫৩ কিউসেক পানি তুলতে ভারতের অনুমতি নেয়ার চুক্তি করে একটি ভুল ও খারাপ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে বাংলাদেশ। এ চুক্তির কারণে এখন থেকে বাংলাদেশ-ভারতের যৌথ নদীগুলো থেকে বাংলাদেশ পানি উত্তোলন করতে চাইলে ভারত হস্তক্ষেপ করতে পারে। কুশিয়ারা নদীর পানি প্রত্যাহারে ভারতের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক সইয়ের যৌক্তিকতাও নেই। গতকাল রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ বিশ্লেষণমূলক সাময়িকী সর্বজনকথা আয়োজিত ‘ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক: নদী, সীমান্ত ও বিদ্যুৎ’ শীর্ষক ভার্চ্যুয়াল সংবাদ সম্মেলনে বিশেষজ্ঞরা এসব মন্তব্য করেন। সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, বাংলাদেশের উচিত জাতিসংঘের ১৯৯৭ সালের আন্তর্জাতিক পানিপ্রবাহ আইনে সই করা। আন্তর্জাতিক আইনের মাধ্যমেই দেশের সব যৌথ নদীর পানি বণ্টনসহ সার্বিক সমস্যার সমাধান করা। কুশিয়ারা নদীর পানি প্রত্যাহারে ভারতের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক সইয়ের যৌক্তিকতা দেখছেন না নদী বিশেষজ্ঞ মো. খালেকুজ্জামান। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরে ৬ই সেপ্টেম্বর যে ৭টি সমঝোতা স্মারকে সই হয়েছে, সেটির একটি হচ্ছে সিলেটের কুশিয়ারা নদীর পানি প্রত্যাহার সম্পর্কিত।

 এই চুক্তির অধীনে ভারত ও বাংলাদেশের যৌথ নদী কুশিয়ারা থেকে ১৫৩ কিউসেক পানি উত্তোলন করবে বাংলাদেশ। তার মতে, শুকনো মৌসুমে নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কুশিয়ারা নদীর বাংলাদেশ অংশে গড়ে ৫,২৯৫ থেকে ১৭,৬৫০ কিউসেক পানি প্রবাহিত হয়। সেই তুলনায় ১৫৩ কিউসেক পানি নিতান্তই সামান্য পরিমাণ (১ থেকে ৩ শতাংশ)।

বিজ্ঞাপন
এই সামান্য পরিমাণ পানি দেশের অভ্যন্তরে প্রত্যাহার করার জন্য বাংলাদেশকে যদি ভারতের অনুমতি নিতে হয়, তা অযৌক্তিক ও অনৈতিক। যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভেনিয়া অঙ্গরাজ্যের লক হ্যাভেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক খালেকুজ্জামানের মতে এই সমঝোতা স্বাক্ষরটিও ‘অসংগতিপূর্ণ’। এর কারণ তুলে ধরে তিনি বলেন, কুশিয়ারার যে অংশের জন্য সমঝোতা হয়েছে, সেই অংশটি পুরোপুরি বাংলাদেশের অভ্যন্তরে অবস্থিত। খালেকুজ্জামান বলেন, এখন ভারত যদি বলে, বাংলাদেশের সঙ্গে তাদের চুক্তি হয়ে গেছে। বাংলাদেশ ১৫৩ কিউসেক পানি নিতে পারবে, বাকি পানি ভারতের। এ চুক্তির অজুহাতে ভারত বাকি পানি নিয়ন্ত্রণ করা শুরু করলে বাংলাদেশ কী করবে, সে বিষয়ে চুক্তিতে কিছু উল্লেখ আছে কিনা, তা জানতে চান তিনি। এই পানি সম্পদ বিশেষজ্ঞ বলেন, রহিমপুর খালের কয়েক কিলোমিটার ভাটিতে কুশিয়ারা নদীর ভারতের অংশে ‘নোম্যান্সল্যান্ডে’ নোটি খালের গতিপথ পুরোপুরি বন্ধ করে দিয়ে সেখানে একটি জনপদ তৈরি করা হয়েছে, সেজন্য ভারতের বাংলাদেশের অনুমতি নেয়ার দরকার হয়েছিল বলে জানা যায় না। এই নোটি খালটি বহমান থাকলে বরং শুকনো মৌসুমে কুশিয়ারাতে পানি প্রবাহের পরিমাণ আরও বাড়তো। এই চুক্তি ন্যায্য ও সঠিক হয়নি বলেও মন্তব্য করেন মো. খালেকুজ্জামান। 

তিনি বলেন, এ চুক্তিতে পুরো অববাহিকার পানি ও পলি কীভাবে ব্যবস্থাপনা হবে, তার উল্লেখ নেই। চুক্তিতে এমন কোনো বিধান নেই, ইতিমধ্যে বিদ্যুৎ ও সেচ প্রকল্পের মাধ্যমে যে পরিবেশগত ক্ষতি করা হয়েছে, তার জন্য তারা ভর্তুকি বা ক্ষতিপূরণ দেবে কিনা। ভবিষ্যতে এ রকম প্রকল্প নিলে আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী তারা বাংলাদেশের সঙ্গে বোঝাপড়া করবে কিনা। উন্নয়নের জোয়ার বেশি বোঝানোর জন্য বাংলাদেশ সরকার ১৫৩ কিউসেক পানি দিয়ে ১০ হাজার হেক্টর জমি চাষাবাদের কথা বলেছে। আসলে এই পানি দিয়ে ৩ হাজার ৭০০ হেক্টরের বেশি জমি চাষাবাদ করা সম্ভব নয় বলেও মন্তব্য করেন খালেকুজ্জামান। তিনি বলেন, কুশিয়ারার পানি ব্যবহার করতে হলে তা সেচ দিয়ে উজানে নিতে হবে, যা যুক্তিসংগত নয়। সংবাদ সম্মেলনে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, এবারের চুক্তিটার যে সাফল্য বলা হচ্ছে, এটা আমাদের কাছে বোধগম্য নয়। কেন মাত্র ১৫৩ কিউসেক পানি প্রত্যাহার করবে বাংলাদেশ? ভারতের কাছ থেকে কেন অনুমতি নিতে হবে? ভারত ও চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক পানি আইনে সমাধানের আহ্বান জানান তিনি। 

জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক পানি আইন যেটা আছে, সেটাতে বাংলাদেশ কেন স্বাক্ষর করে নাই, এটা আমাদের কাছে বোধগম্য নয়। ভাটির দেশ হিসেবে বাংলাদেশের জন্য এটা খুব দরকার। ওই আইনে একটা বিধিমালা আছে, কীভাবে নদীর পানি বণ্টন হবে। সেই হিসেবে এটাকে ভাটির দেশের নিরাপত্তার সনদ বলা যায়। এটাতে বাংলাদেশের সরকারকে অবশ্যই স্বাক্ষর করতে হবে, ভারতও যাতে করে সেটার জন্য চাপ সৃষ্টি করতে হবে এবং আন্তর্জাতিক পানি আইন অনুযায়ী যাতে ভারত ও চীনের সঙ্গে সমস্ত নদীর পানি সমস্যার নিষ্পত্তি হয়, সেজন্য যথাযথ ব্যবস্থা নিয়ে টেকসই সমাধানের দিকে অগ্রসর হতে হবে।  জাতিসংঘের অধীনে সীমান্ত হত্যার তদন্ত করার দাবি জানিয়ে ‘সর্বজনকথা’ সম্পাদক আনু মুহাম্মদ বলেন, সীমান্ত হত্যা বন্ধে ভারত সরকার তার দেয়া প্রতিশ্রুতি বারবার ভঙ্গ করছে। দুদেশের মানুষের সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য সীমান্ত হত্যা বন্ধের পাশাপাশি ফেলানি ও মিনারসহ সব হত্যাকাণ্ডের তদন্ত করতে হবে। ভারতকে দেয়া ট্রানজিটকে কেন্দ্র করে নানা অবকাঠামোগত প্রকল্প চলছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, সর্বশেষ প্রস্তাব হিলি থেকে মেঘালয় মহাসড়ক ও সেতু। এসব প্রকল্পে বাংলাদেশের সামাজিক, পরিবেশগত, নিরাপত্তাজনিত ক্ষতি বা ঝুঁকি এখনো বাংলাদেশের মানুষ জানে না। এ বিষয়ে সকল তথ্য জনগণের কাছে স্পষ্ট করতে অবিলম্বে এ বিষয়ে একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করতে হবে। সংবাদ সম্মেলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ তানজীম উদ্দিন খান বলেন, বিজিবির তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫ সালের জুন থেকে ২০২২ পর্যন্ত সীমান্তে ১৬১ জন বাংলাদেশি নাগরিক বিএসএফের গুলিতে মারা গেছে।

 বিভিন্ন তথ্যসূত্রে জানা যায়, ২০০০ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত সীমান্তে এ রকম হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে ১২৫৩ জন বাংলাদেশি নাগরিক। সীমান্ত হত্যা বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা না নেয়ায় তা অব্যাহতই থাকছে। তাই প্রধানমন্ত্রীর সফরকালেই দিনাজপুর সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে নিহত হয় ১৭ বছরের স্কুল শিক্ষার্থী মিনাহাজুল ইসলাম মিনার। ভারতের রাষ্ট্রীয় স্বার্থের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ইস্যুগুলো বাস্তবায়নের জন্য সীমান্তের সমন্বিত বা যৌথ ব্যবস্থাপনার আওতায় যতটা তৎপরতা দেখা যায়, সীমান্ত হত্যা বন্ধের ক্ষেত্রে সে রকম কোনোকিছু দেখা যায় না। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে দিন দিন ভারতের ওপর নির্ভরশীলতা বাড়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করে অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মোশাহিদা সুলতানা বলেন, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) হিসাব অনুযায়ী, ভারত থেকে পরিশোধিত তেল আমদানি করলে ব্যারেল প্রতি বাংলাদেশের সাশ্রয় হবে ২ থেকে ৩ ডলার।

 অন্যদিকে বিদেশ থেকে অপরিশোধিত তেল এনে দেশের পরিশোধনাগার ইস্টার্ন রিফাইনারির সক্ষমতা বাড়িয়ে সেখানে পরিশোধন করে ডিজেল উৎপাদন করা হলে সাশ্রয় হত ব্যারেল প্রতি ১১ ডলার। ভারত থেকে তেল আমদানির প্রক্রিয়া চলছে ২০১৭ সাল থেকে, অথচ ২০১২ সালের ইস্টার্ন রিফাইনারির সক্ষমতা বৃদ্ধির প্রকল্প এখনো ঝুলে আছে। এই জ্বালানি গবেষক বলেন, পেট্রোবাংলা অগভীর সমুদ্রের এসএস ০৪ এবং এসএন ০৯ ব্লকের জন্য ২০১৪ সালের ১৭ই ফেব্রুয়ারি পাঁচ বছরের পিএসসি সই করে ভারতের ওএনজিসির সঙ্গে। ২০১৯ সালে মেয়াদ শেষ হবার পর চুক্তির মেয়াদ দুই বছর বাড়ানো হয়; কিন্তু কাজ হয়নি। অথচ পেট্রোবাংলার সক্ষমতা বাড়িয়ে সমুদ্রে কাজ শুরু করলে এতদিনে গ্যাস পাওয়া যেতো। সংবাদ সম্মেলন সঞ্চালনা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক সামিনা লুৎফা।

শেষের পাতা থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

   

শেষের পাতা সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status