ঢাকা, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, শুক্রবার, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

শেষের পাতা

নির্মমতা

দাদা, দুইটারে মেরে বালু চাপা দিয়েছি

রাশিম মোল্লা
১৭ সেপ্টেম্বর ২০২২, শনিবার
mzamin

সাইদুল ও সোহেলের কী অপরাধ ছিল? তারা চাকরি চেয়েছিলেন। ভাগ্যের চাকা ঘোরাতে লড়াই করেছেন। না   ভাগ্যের চাকা ঘোরেনি। বরং নির্মমতার শিকার হন। কি সেই নির্মমতা? সাইদুল ও সোহেল প্রতিবেশী। আবার দু’জন ভালো বন্ধুও। দরিদ্র পরিবারের সন্তান তারা। পরিবারে স্বচ্ছলতা আনতে সাইদুল তিন বছর আগে কাতার যান। কিন্তু সেখানে কোনো সুবিধা করতে পারেননি। চলে আসেন দেশে।

বিজ্ঞাপন
এবার দুবাই যাওয়ার চেষ্টা সাইদুলের। কিন্তু করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের কারণে যাওয়া হয়ে ওঠেনি। সাইদুলের মা রাজিয়া বেগম মানবজমিনকে বলেন, চাকরির জন্য দুই বন্ধু দেখা করেন পাশের গ্রামের সাজ্জাত মোল্লার সঙ্গে। সাজ্জাত দু’জনকেই একই এলাকার চঞ্চল মোল্লার মাওয়া বালুর ড্রেজারে চাকরি দেয়ার আশ্বাস দেন। কয়েকদিন পর ২০২১ সালের ২০শে এপ্রিল সকাল ১০ টায় সাজ্জাত মোল্লা তার মোবাইল ফোন থেকে সাইদুলকে ফোন করে জানায়, এখনই মাওয়া যেতে হবে। চঞ্চল মোল্লা তাড়াতাড়ি যেতে বলেছে। ফোন পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দু’জনেই সাজ্জাত মোল্লার সঙ্গে চঞ্চল মোল্লার কাছে যাচ্ছেন বলে সাইদুল আমাকে জানায়। তখন ছিল রমজান মাস। প্রায় সন্ধ্যা। ইফতারির খবর নিতে আমি ছেলে সাইদুলের মোবাইলে ফোন করি। সাইদুল আমাকে জানায়, আমি সাজ্জাত কাকা ও চঞ্চল মামার সঙ্গে মাওয়াতে আছি। 

কাজ বুঝে নিতে রাত হবে তাই আজ আসবো না। কাল সকালে আসবো। রাজিয়া বেগম বলেন, পরের দিন সাইদুলের মোবাইলে ফোন দেই। কিন্তু মোবাইল বন্ধ পাই। এ ঘটনা জানিয়ে থানায় মামলা করতে যাই। কিন্তু থানা কর্তৃপক্ষ সেদিন আমার মামলা/জিডি কিছুই নেয়নি। তিনদিন পর ২৩শে এপ্রিল আবার থানায় গেলে সেদিনও মামলা না নিয়ে জিডি নেন। এভাবে চার মাসেরও বেশি সসয় পার হয়ে যায়। কিন্তু ছেলের কোনো সন্ধান নেই। অবশেষে ওই বছরের সেপ্টেম্বর মাসে অতিরিক্ত চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ও দোহার আমলী আদালতে একটি মামলা করি। পরে সিআইডি’র মাধ্যমে জানতে পারি আমার ছেলে আর জীবিত নেই। মামলায় আবেদনে উল্লেখ করা হয়, সাজ্জাত মোল্যার সঙ্গে আমার পুত্র সাইদুল মৃধার তুচ্ছ বিষয় নিয়ে ঝগড়া হয়। সাজ্জাত মোল্যা আমার ছেলেকে বলে, সুযোগ পেলে তোকে দেখে নেবো। এরপর স্থানীয় গণ্যমান্য লোকজন সাজ্জাত মোল্যা এবং সাইদুল মৃধার আপস করিয়ে দেয়। প্রতিবেশী হওয়ায় আমার ছেলে এবং সাজ্জাত মোল্যার মধ্যে ফের আন্তরিক সম্পর্ক হয়। একদিন আমার ছেলে সাইদুল করোনার কারণে বিদেশ যেতে না পারার কথা জানালে সাজ্জাত মোল্যা মাওয়াতে চঞ্চল মোল্যার ড্রেজারে চাকরি দেয়ার কথা বলে নিয়ে যায়। পরের দিন ছেলেকে ফোন দিলে তার মোবাইল বন্ধ পাই। আমরা সাজ্জাত মোল্যা ও চঞ্চল মোল্যার বাসায় গিয়ে ছেলের সন্ধান জানতে চাই। তারা বলে আমরা তোমার ছেলের খবর জানি না। 

এ নিয়ে বাড়াবাড়ি করলে তোকে ও তোর অন্য ছেলেদেরকে মেরে লাশ গুম করে ফেলবো। রাজিয়ার আইনজীবী এডভোকেট শ্রেষ্ঠ আহমেদ রতন মানবজমিনকে বলেন, এ ঘটনায় রাজিয়া বেগম প্রথমে দোহার থানায় মামলা করতে যান। কিন্তু থানা কর্তৃপক্ষ  সেদিন মামলা না নিয়ে দুই দিন পর জিডি নেন। পরে  ছেলের সন্ধান না পেয়ে মা আদালতে মামলা করেন। আদালত মামলাটি দোহার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে এজাহার হিসেবে গ্রহণ করে তদন্তের আদেশ দেন। দোহার থানা মামলাটি গ্রহণ করে কিছুদিন তদন্ত কার্যক্রম করেন। তথ্য প্রযুক্তির বিষয় জড়িত থাকায় পরে দোহার থানা মামলাটি সিআইডিতে হস্তান্তর করেন।  সিআইডি’র তদন্ত শুরু করেন। এক পর্যায়ে এ ঘটনায় সোহাগ ব্যাপারী ও ইয়াছিন মোল্লাকে আটক করে সিআইডি। তারা  ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন। বেরিয়ে আসে সাইদুল ও সোহেলকে নির্মমভাবে হত্যা করার আদ্যোপান্ত।  

যেভাবে হত্যা করা হয় সাইদুল ও সোহেলকে

জোড়া হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে সোহাগ ব্যাপারী ও ইয়াছিন মোল্লা আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়। সোহাগ ব্যাপারী দোহার থানার ডুলি হাসির মোড় গ্রামের এমদাদুলের বাসায় থাকতো। ওই বাসায় থেকে মোটরসাইকেলের মিস্ত্রির কাজ করতো। সেই সুবাদে এমদাদ, সাজ্জাত মোল্লা, কাওছার মোল্লা, মনির শেখ, ইয়াসিন, আলিমদার ও ইয়াসিনের ভাতিজার সঙ্গে তার পরিচয় হয়। 

জবানবন্দিতে সোহাগ ব্যাপারী ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে বলে, ঘটনার সপ্তাহ খানেক আগে সাজ্জাত মোল্লা ও এমদাদ আমাকে বলে, আমরা বোটে (ট্রলার) করে মাওয়া ব্রিজ দেখতে যাবো। তুমি কি আমাদের সঙ্গে যাবা? তাদেরকে বলি- যাবো। ঘটনার দিন এমদাদ আমাকে সাজ্জাত মোল্লার বাসায় যেতে বলে। সে আমাকে ৩ হাজার ৫০০ টাকা দিয়ে বাঁশতলার আজিমের  কাছে যেতে বলে। সেখানে গেলে আজিম টাকা রেখে ৩৫টি ইয়াবা দিয়ে বোটে যেতে বলে। আমি বোটে যাই। সেখানে এমদাদ, আলিমদার, মনির, কাওছার, ইয়াসিন ও তার ভাতিজা বসা ছিল। ১০/১২ মিনিট পরে সাজ্জাত মোল্লা একটা ব্যাগ ও দুইজন ছেলেকে নিয়ে আসে। সন্ধ্যার পর বোটে আবার দোহারের দিকে ফিরতে থাকি। ব্রিজ থেকে ৪/৫ কিলোমিটার আসার পর পদ্মা নদীর একটা চরে বোট থামে। বোট থেকে তখন সবাই নেমে ইয়াবা ও মদ খায়।  ম্যাজিস্ট্রেটকে আরও জানায়, পদ্মার চর থেকে সাইদুল তার মায়ের সঙ্গে কথা বলে জানায়, আমি আজ ফিরবো না। আগামীকাল ফিরবো। মদ খাওয়া শেষ হলে প্রথমে রিভলবার দিয়ে সাইদুলের পিঠে গুলি করে। সে পড়ে যায়। এরপর সাজ্জাদ মোল্লা সোহেলের মাথায় নৌকার  বৈঠা দিয়ে বাড়ি দেয়। তখন এমদাদুল রিভলবার দিয়ে সোহেলকে গুলি করে। এরপর ওরা সবাই মিলে সাঈদুলের গলায় রশি দিয়ে প্যাঁচ দিয়ে চাপ দেয়।  সাইদুল মারা যায়। তখন ওরা সোহেলের গলায় একইভাবে প্যাঁচ দিয়ে চাপ দেয়। সোহেলও মারা যায়।

 এরপর সবাই মিলে বালি খুঁড়ে গর্ত করে লাশ ২টা- একই গর্তে রেখে বালু দিয়ে চাপা দেয়।  এরপর ওই গর্তের বালুর উপরে ডিজেল ঢেলে দেয়। এরপর আমরা সবাই বোটে উঠি। হঠাৎ সাজ্জাত মোল্লার মোবাইলে ফোনে একটা কল আসে। তখন সাজ্জাত মোল্লা বলেন, ওদের দুইজনকে মেরে ফেলেছি। তখন ফোন করা লোকটা বলে, তোরা ইন্ডিয়া গিয়ে পাসপোর্ট কর। তোদের আমি ইতালি নিয়ে আসবো।  ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেয়া আরেক আসামি হলো মো. ইয়াসিন মোল্যা। ইয়াসিন ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে বলে, ঘটনা ছিল রোজার ৭ম দিন। সেদিন দুপুরের দিকে ইমদাদুল আমাকে ফোন করে মুকসেদপুর ঘাটে যেতে বলে। মুকসেদপুর বাজারে আমার সঙ্গে মনিরের দেখা হয়। তার দুই হাতে দুই ড্রাম ২০ লিটার ডিজেল ছিল। আমি তার সঙ্গে ঘাটে গিয়ে দেখি একটি বোটে সাজ্জাত মোল্যা, ইমদাদুল, আলিমদার, সোহাগ মোল্যা, কাওছার মোল্যা, রাজন, সোহেল ও সাইদুল বসে আছে। তারপর সাজ্জাত মোল্যা আমাকে বোট চালিয়ে মাওয়া ঘাটের দিকে যেতে বলে। তখন প্রায় ৩টা বাজে। আমি বোট চালিয়ে পদ্মা ব্রিজের কাছে যাই।  সেখানে আমরা পদ্মা ব্রিজ ঘুরে দেখি। এর মধ্যে সন্ধ্যা হয়ে যায়।

 সন্ধ্যার পর ইমদাদুল আমাকে বোট ঘুরিয়ে দোহারের দিকে যেতে বলে। বোটটি ছিল চঞ্চল মোল্যার। কিছুদূর আসার পর ইমদাদুল পদ্মার একটি ছোট্ট বালুর চরে বোট থামাতে বলে। তখন ওরা সবাই বোট থেকে নেমে ইয়াবা আর মদ খায়। ইমদাদুল কিছুক্ষণ পর সাইদুলের পিঠে গুলি করে। তখন সোহেলকে বোটের বৈঠা দিয়ে আলিমদার আর সোহাগ বাড়ি দিয়ে ফেলে দেয়। তখন সাজ্জাত গুলি করে। এরপর নাইলনের দড়ি দিয়ে সবাই মিলে সোহেল ও সাইদুলের গলায় প্যাঁচ দিয়ে চাপ দেয়। ওরা মারা যায়। গর্ত খোঁড়া হলে ওরা সবাই মিলে সোহেল আর সাইদুলের লাশ ওই গর্তে ফেলে। ইমদাদুল একটা ড্রাম এনে ডিজেল ফেলে দেয়। তারপর সবাই মিলে বালু দেয়। এরপর আবার ডিজেল ঢালে। তারপর সবাই আবার বোটে উঠে রওনা দেয়। এ সময় সাজ্জাত মোল্যা ফোনে একজনকে জানায়, দাদা কাজ হয়ে গেছে। দুইটারেই মেরে বালু চাপা দিয়ে দিয়েছি।

শেষের পাতা থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

   

শেষের পাতা সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status