ঢাকা, ২০ এপ্রিল ২০২৪, শনিবার, ৭ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

প্রথম পাতা

ভোগান্তির নাম বিআরটি প্রকল্প

নূরে আলম জিকু
১৮ আগস্ট ২০২২, বৃহস্পতিবার

রাজধানীর বিমানবন্দর থেকে গাজীপুর। প্রতিদিনই এই পথে লেগে থাকে তীব্র যানজট। কখনো সড়কে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে থাকছে যানবাহন। ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন লাখ লাখ যাত্রী। বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট ‘বিআরটি’ প্রকল্পের কাজ চলছে প্রধান সড়কের উপর। মূল সড়কের ওপরে রাখা হয়েছে নির্মাণসামগ্রী। কোথাও নেই নিরাপত্তার বালাই। এতে প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা। ঘটেছে প্রাণহানিও। এদিকে বিআরটি’র ৪ বছরের প্রকল্প শেষ হয়নি ১০ বছরেও।

বিজ্ঞাপন
এখন পর্যন্ত কাজের অগ্রগতি হয়েছে প্রায় ৮০ শতাংশ। প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়া নিয়ে রয়েছে অনিশ্চয়তা। বিআরটি চালু হলে এর সুফল মিলবে কিনা তা নিয়েও রয়েছে ধোঁয়াশা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সঠিক পরিকল্পনার অভাবেই উন্নয়ন প্রকল্পগুলো যথাসময়ে শেষ হচ্ছে না। প্রতিটি প্রকল্পে সময়ক্ষেপণ করে বাজেট বাড়ানো হচ্ছে। ব্যস্ততম সড়কে যেকোনো উন্নয়ন কাজ শুরু হলে মানুষের যাতায়াতে ভোগান্তি বাড়ে। তবে বিআরটি’র এ প্রকল্পটি গত ৫/৬ বছর ধরে মানুষকে বেশি ভোগান্তিতে ফেলেছে। অপরিকল্পিতভাবে কাজ চলায় প্রায় ঘটছে দুর্ঘটনা। মানা হচ্ছে না নিয়মনীতি। যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ প্রকল্পের যথাযথ পরিকল্পনার অভাব রয়েছে। ব্যস্ততম এই সড়কটি বিআরটি’র জন্য উপযুক্ত নয়। ফলে বিআরটি চালু হলে ভোগান্তি আরও বাড়বে। তেমন সুফলও মিলবে না। এদিকে, গত সোমবার বিকালে রাজধানীর উত্তরায় নির্মাণাধীন বিআরটি ফ্লাইওভারের গার্ডার চাপা পড়ে একটি প্রাইভেটকার। 

এতে ২ শিশুসহ ৫ জনের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় আহত হয়েছেন আরও ২ জন। এমন দুর্ঘটনা এটিই প্রথম নয়, এর আগেও একই প্রকল্পের গার্ডার দুর্ঘটনা ঘটেছে। প্রাণহানিও হয়েছে। গত ১৫ই জুলাই গাজীপুরে কে চৌধুরী অ্যান্ড কোম্পানি ফিলিং স্টেশনের সামনে ফ্লাইওভারের কাজ করার সময় লঞ্চিং গার্ডার টেইলার গাড়িতে উঠানোর চেষ্টা করেছিলেন প্রকল্পের নির্মাণ শ্রমিকরা। এসময় গার্ডারটি টেইলার থেকে কাত হয়ে জিয়াউর রহমান নামের এক নিরাপত্তারক্ষীর উপর পড়ে। এতে ঘটনাস্থলেই নিহত হন তিনি। সে সময় এক শ্রমিক ও এক পথচারী গুরুতর আহত হন। তার আগে গত বছরের ১৪ই মার্চ সকালে বিমানবন্দর এলাকায় বিআরটি’র গার্ডার ভেঙে দুই চীনা নাগরিকসহ চারজন      আহত হন। এর ৮ ঘণ্টার মধ্যে আব্দুল্লাহপুরে আবারো ধসে পড়ে পিআর ক্যাপ। বিআরটি প্রকল্পে বারবার এমন দুর্ঘটনা ঘটলেও টনক নড়েনি কর্তৃপক্ষের। উল্টো নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে নির্মাণকাজে সময়ক্ষেপণ করছেন প্রকল্পের কর্মকর্তারা। মেগা প্রকল্পের নির্মাণকাজের সময় যথাযথ নিরাপত্তা নিশ্চিতের কথা উল্লেখ আছে প্রকল্পের চুক্তিতে। তবে তার কিছুই মানা হচ্ছে না।  এসব দুর্ঘটনার জন্য প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, মেগা প্রকল্পের কাজ চলছে সরকারের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে। আন্তর্জাতিক মানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে প্রকল্পের কাজ করার কথা। তবে ঢাকার বেশির ভাগ প্রকল্পে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হচ্ছে না। 

কর্মকর্তাদের খামখেয়ালিপনায় বার বার ঘটছে দুর্ঘটনা। একাধিক দুর্ঘটনায় প্রাণহানি হলেও কর্তৃপক্ষ যথাযথ পদক্ষেপ নেয়নি। যার কারণে ১৫ই আগস্ট ৫ জনের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। রাজধানীর ব্যস্ততম সড়কে নিরাপত্তা বেষ্টনী ছাড়া কর্মযজ্ঞ চালানোর দায়ে এমন দুর্ঘটনার দায় বিআরটি প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা এড়াতে পারে না। নিরাপত্তার বিষয়ে ভবিষ্যতে কোনো পরিকল্পনা না নিলে এ ধরনের দুর্ঘটনার শঙ্কা থেকেই যাবে। জানা যায়, ঢাকা ও গাজীপুর এলাকার যানজট নিরসনে ‘গ্রেটার ঢাকা সাসটেইনেবল আরবান ট্রান্সপোর্ট প্রজেক্ট (বিআরটি, গাজীপুর-এয়ারপোর্ট) অনুমোদন পায় ২০১২ সালের ২০শে নভেম্বর। তখন এ প্রজেক্টে ব্যয় ধরা হয়েছিল ২ হাজার ৪০ কোটি টাকা। ২০১৬ সালের শেষদিকে কাজ শেষ হওয়ার কথা। তবে ২০২২ সালেও এই কাজ সমাপ্ত হয়নি। গত ১০ বছরে প্রকল্প এগিয়েছে মাত্র ৮০ শতাংশ। এতে ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ২৬৮ কোটি টাকায়। চলতি বছরের জুনে এ প্রকল্পের কাজ শেষ করার সংশোধিত সময়কাল নির্ধারণ করা হলেও সেই সময় অতিবাহিত হয়েছে। এখানো প্রায় ২০ শতাংশ কাজ বাকি রয়েছে। আগামী আরও এক বছরে কাজ শেষ হবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করছেন বিশেষজ্ঞ ও প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা। প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, বিমানবন্দর থেকে আব্দুল্লাহপুর পর্যন্ত সড়কের প্রশস্ততা ১৮০ থেকে ১৯০ ফুট। 

অন্যদিকে গাজীপুর অংশের কোথাও কোথাও সড়কের প্রশস্ততা ৬০ থেকে ৬৫ ফুট। বিআরটি প্রকল্পের কাজ শুরু হওয়ার পর ব্যস্ততম এই সড়কটি সরু হয়ে যায়। এতে প্রশস্ততা কোথাও কোথাও অর্ধেকের নিচে নেমে আসে। সড়কের মাঝে বসানো হয়েছে বিআরটি প্রকল্পের পিলার। সড়কের পাশে ও উপরে পড়ে আছে বিভিন্ন নির্মাণসামগ্রী। কোথাও কোথাও দীর্ঘদিন কাজ না হলেও তা সংস্কার করা হচ্ছে না। প্রকল্প চলাকালীন এসব সড়ক সংস্কারের দায়িত্ব প্রকল্পের ঠিকাদারদের। এজন্য বরাদ্দও আছে। কিন্তু ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এসব সংস্কারে আগ্রহ দেখাচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে। এ প্রকল্পের ১৬ কিলোমিটার সড়কের উন্নয়ন-প্রশস্তের কাজ করছে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর। সাড়ে ৪ কিলোমিটার উড়াল সড়ক, বিআরটি লেন, স্টেশন ও ১০ লেনের একটি সেতু নির্মাণ করছে সেতু বিভাগ। গত ১০ বছরে এ দুই সংস্থার প্রকল্প পরিচালক হয়ে এসেছেন ৭ থেকে ৮ জন। তবুও নির্দিষ্ট সময়ে কাজ শুরু ও সমাপ্ত হয়নি। পথচারী, পরিবহন যাত্রী ও চালকরা জানান, ২০১৮ সালের শুরু থেকে সড়কে ভোগান্তি আর দুর্ভোগ বেড়েছে। সড়কের উপরে কাজের কারণে বিভিন্ন অংশে তৈরি হয়েছে ছোট-বড় অসংখ্য গর্ত।  বর্ষা মৌসুমে এসব গর্তে জমে থাকে পানি। এতে যানবাহন ও পথচারীদের চলাচলে বিঘ্ন হচ্ছে। সড়কের উপর নির্মাণকাজ চললেও নেই কোনো বেষ্টনী। রাখা হয়নি বিকল্প পথ। ফলে নির্মাণাধীন প্রকল্পের গা ঘেঁষেই চলাচল করছে যানবাহন ও পথচারী। এতে নানা সময় দুর্ঘটনা ঘটছে। গাজীপুর থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত নির্মীয়মাণ বিআরটি করিডোর নিয়ে সংস্থাটি জানায়, ২০১২ সালের ডিসেম্বর মাসে প্রকল্পটি অনুমোদনের পর নকশা প্রণয়ন, দরপত্র আহ্বান ও ঠিকাদার নিয়োগের পর ২০১৭ সালের এপ্রিলে পূর্ত কাজ শুরু হয়।

 বিভিন্ন কারণে প্রথম পর্যায়ে ২০১৩ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ডিজাইন ফ্রেমওয়ার্ক প্রস্তুত, পরামর্শক নিয়োগ, ডিজাইন প্রস্তুতকরণ ও অনুমোদন, বিডিং ডকুমেন্টস প্রস্তুতকরণ, মূল্যায়ন ও পরিকল্পনা করা হয়েছে। দ্বিতীয় পর্যায়ে ২০১৬ ও ২০১৭ সালে ঠিকাদার নিয়োগ ও সেবা ক্রয়ের কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে। তৃতীয় পর্যায়ে ২০১৭ সালে থেকে প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ চলছে। সর্বশেষ চতুর্থ পর্যায়ে ২০২৩ সালে বিআরটি সিস্টেম চালুকরণ করা হবে। পরিকল্পনাবিদ ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান মানবজমিনকে বলেন, এই প্রকল্প দীর্ঘায়িত হওয়াতে জনভোগান্তি বেড়েছে মাত্রাতিরিক্তভাবে। একইসঙ্গে প্রকল্প ব্যয়ও বেড়েছে অনেক। এই প্রকল্পের দীর্ঘসূত্রতার কারণে সৃষ্ট অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষতিগুলো এই প্রকল্পের উপযোগিতা অনেকাংশে হ্রাস করেছে। এখান থেকে প্রাপ্ত শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যতে অন্যান্য অবকাঠামোগত প্রকল্পে এ ধরনের জনভোগান্তি কমাতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া উচিত। বিআরটি প্রকল্পের দীর্ঘসূত্রতার পেছনে দায়ীদের চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া উচিত। যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান মানবজমিনকে বলেন, যে করিডোরে বিআরটি প্রকল্প হচ্ছে এটি আরবান এরিয়া নয়। এটা বাণিজ্যিক ও ন্যাশনাল করিডোর। এখানে বিআরটি প্রকল্প হওয়ার কথা না। অথচ সেখানেই হয়েছে এই প্রকল্পটি। সমন্বয়হীনতার কারণে এমনটি হয়েছে। এই প্রকল্পটি ভালো ভূমিকা রাখবে না। ভবিষ্যতে উত্তরা, আবদুল্লাহপুর ও চৌরাস্তা এলাকার মানুষ নানা অসুবিধায় পড়বেন। বিমানবন্দর থেকে গাজীপুর পর্যন্ত বিআরটি কাজের মধ্যে সমন্বয় না হওয়ায় কাজ শেষ করতে বিলম্ব হচ্ছে। তিনি বলেন, উত্তরায় বিআরটি প্রকল্পে আন্তর্জাতিক স্বীকৃত নিরাপত্তার চর্চাগুলো অনুসরণ হচ্ছে না। এতে বারবার ঘটছে দুর্ঘটনা।   ঢাকা বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট কোম্পানি লিমিডেট (বিআরটি) প্রকল্পের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সফিকুল ইসলামের সঙ্গে একাধিক বার যোগাযোগ করেও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।  

প্রথম পাতা থেকে আরও পড়ুন

   

প্রথম পাতা সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status