বাংলারজমিন
ডেঙ্গুর হটস্পট বরগুনা
ভুল রিপোর্টে বিপাকে রোগীরা
বরগুনা প্রতিনিধি
১৮ জুন ২০২৫, বুধবারবরগুনায় মহামারি আকার ধারণ করেছে ডেঙ্গু, বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যাও। এ অবস্থায় হাসপাতালে রোগীদের বাড়তি চাপে পরীক্ষা সংকটে বেশির ভাগ রোগী ছুটছেন বাইরের বিভিন্ন বেসরকারি ক্লিনিক অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারে। তবে এসব পরীক্ষায় একের পর এক ভুল রিপোর্ট ধরা পড়ায় চিকিৎসা দিতে বিপাকে পড়ছেন চিকিৎসকরা। অপরদিকে একই পরীক্ষা বারবার করায় বাড়তি টাকা খরচের ভোগান্তি ভুক্তভোগীদের।
সরজমিন বরগুনা ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতাল ঘুরে দেখা যায়, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীদের জন্য নির্ধারিত ৫৫টি বেডের বিপরীতে প্রায় দেড় শতাধিক রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। এদের মধ্যে গত তিনদিন আগে ৯৩ হাজার প্লাটিলেট নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন বরগুনা সদর উপজেলার খেজুরতলা নামক এলাকার বাসিন্দা মো. সাগর। এর একদিন পর ১৬ই জুন হাসপাতালের বাইরের একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে তিনি পরীক্ষা করেন। এ সময় ওই ডায়াগনস্টিক সেন্টারের দেয়া রিপোর্টে সাগরের মাত্র ১ হাজার ২৬০ প্লাটিলেট পরিমাপ করা হয়। পরে হাসপাতালের চিকিৎসকদের সন্দেহ হলে পুনরায় পরীক্ষা করতে বললে একই দিনে তিন থেকে চার ঘণ্টার ব্যবধানে আরেকটি ক্লিনিকের পরীক্ষায় সাগরের প্লাটিলেট পরিমাপ করা হয় ১ লাখ ৪৯ হাজার।
ভুক্তভোগী ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী সাগর বলেন, ডাক্তারকে শারীরিক অবস্থা জানাতে বাইরের একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পরীক্ষা করি। সেখান থেকে আমার ১ হাজার ২৬০ প্লাটিলেট পরিমাপ করে রিপোর্ট দেয়া হয়। রিপোর্ট দেখে আমি ভয় পেয়ে তড়িতড়ি করে বরিশাল যেতে চাই। এছাড়া ভয়ে আমার বুক কাঁপা শুরু করে। পরে ওই রিপোর্টটি ডাক্তারকে দেখালে রিপোর্টে ভুল হয়েছে জানিয়ে আবারও পরীক্ষা করতে বলেন। পরবর্তী অন্য একটি ক্লিনিকে পরীক্ষা করলে ১ লাখ ৪৯ হাজার প্লাটিলেট আছে এমন রিপোর্ট দেয়া হয়।
বরগুনার বেসরকারি ক্লিনিক অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মানোন্নয়নে নিয়ন্ত্রণকারী দপ্তরকে উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে হাসপাতালে দায়িত্বরত মেডিসিন কনসালটেন্ট ডা. আশিকুর রহমান বলেন, রিপোর্ট নিয়ে আমাদের চিন্তায় পড়তে হয়। কিছু কিছু রিপোর্ট দেখেই তা অসামঞ্জস্য মনে হয়। তখন আমরা রোগীকে কষ্ট হলেও আরেকবার আরেক জায়গায় পুনরায় পরীক্ষা করতে বলি। তবে এতে রোগীদের অতিরিক্ত টাকা খরচ হয়। আমাদের হাসপাতালে পরীক্ষা হয় তবে অতিরিক্ত রোগীর চাপে ভিড় এড়াতে অনেকেই বাইরে থেকে পরীক্ষা করেন। প্লাটিলেট যেহেতু আমরা চোখে দেখি না তাই রিপোর্টটের ওপর ভিত্তি করেই চিকিৎসা দিতে হয়। তবে আমরা আগের রিপোর্টের সঙ্গে বর্তমান রিপোর্ট মিলিয়ে দেখে যদি খুব বেশি পার্থক্য আসে তাহলে রোগীকে আবারও পরীক্ষা করতে বলি।
বরগুনা জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. মো. রেজওয়ানুর আলম বলেন, বর্তমানে হাসপাতালে সিবিসি পরীক্ষা শুরু হয়েছে। তবে অতিরিক্ত ভর্তি থাকায় শুধু ইনডোরের রোগীদের পরীক্ষা করা হয়। আশা করি খুব দ্রুতই বেশি পরিমাণ পরীক্ষা হাসপাতালেই করা যাবে। তবে বাইরের ক্লিনিক থেকে উল্টাপাল্টা রিপোর্ট হলে রোগীর চিকিৎসা করাটাও চিকিৎসকের জন্য বিপদজনক।
অনুসন্ধানে আইইডিসিআর প্রতিনিধিদল
স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষ থেকে বরগুনাকে ডেঙ্গুর হটস্পট হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। বর্ষা মৌসুম থেকে শুরু হওয়ায় ডেঙ্গু এখন মহামারি আকার ধারণ করেছে। হঠাৎ করে ডেঙ্গুর প্রকোপ বৃদ্ধি পাওয়ার কারণ অনুসন্ধানে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) এর ছয় সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল এসেছে বরগুনায়।
মঙ্গলবার (১৭ই জুন) সকাল থেকে বরগুনা ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে রোগীদের সাথে আলাপচারিতা, তথ্য সংগ্রহ ও বিভিন্ন নমুনা সংগ্রহ কার্যক্রম বাস্তবায়ন করেন তারা। যেসব এলাকায় ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বেশি সেই সকল এলাকা পরিদর্শন ও স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সাথেও কথা বলবেন তারা। চলতি মাসেই বরগুনায় ডেঙ্গুতে একাধিক প্রাণহানি ঘটেছে। স্বাস্থ্যসেবার অপ্রতুলতা, শয্যা সংকট, চিকিৎসক ও ওষুধের অভাবের পাশাপাশি জনসচেতনতার ঘাটতি সব মিলিয়ে ভয়াবহ অবস্থার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে জেলার পরিস্থিতি।
বরগুনা জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী বরগুনায় এখন পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছে ১ হাজার ৯৮৫ জন। সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ১ হাজার ৭৫২ জন। গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন ভর্তি হয়েছে ৮২ জন। বর্তমানে চিকিৎসাধীন রয়েছেন ২৩৩ জন। সরকারি হিসেবে এখন পর্যন্ত চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছেন ৫ জন তবে বেসরকারি হিসেবে এই সংখ্যা ১৫ জন।
আইইডিসিআর এর প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. রত্না দাস বলেন, বর্ষা মৌসুম শুরু হওয়ার আগেই কেন বরগুনায় ডেঙ্গুর এত প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে সেই বিষয়ে অনুসন্ধান করতেই তারা বরগুনায় এসেছেন। অনুসন্ধান কার্যক্রম এখনো চলমান রয়েছে সঠিক কি কারনে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বৃদ্ধি পেয়েছে অনুসন্ধান শেষেই সেটা বলা যাবে।
আইইডিসিআর অনুসন্ধানী প্রতিনিধি দলের টিম লিডার ডা. মো. তারিকুল ইসলাম লিমন বলেন, অপরিষ্কার অপরিচ্ছন্ন জায়গায় মশা জন্মায় কিন্তু এডিস মশা পরিষ্কার স্বচ্ছ পানিতেও জন্মায়। আমরা ধারণা করছি উপকূলীয় জেলা বরগুনায় সুপেয় পানি সংরক্ষণের জন্য যে প্লাস্টিকের ব্যবহার করা হয় তার মাধ্যমেও এডিস মশা জন্মাতে পারে।
তিনি আরো বলেন, ডেঙ্গু প্রতিরোধে আমাদের সকলকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে এগিয়ে আসতে হবে। ব্যক্তি ও পরিবার কেন্দ্রিক সচেতনতা বৃদ্ধি করা গেলেই ডেঙ্গু প্রতিরোধ সম্ভব।