দেশ বিদেশ
বাবা একের ভেতর সব
মো. সিরাজুল ইসলাম
১৬ জুন ২০২৫, সোমবার
বাড়ির কাছেই প্রতি বছরের মতো মেলা বসেছে। নাতি দাদুকে বলছে, দাদু মেলা থেকে আমাকে একটা ঢাক কিনে দাও না!
দাদু বলছে- না, তোকে ঢাক কিনে দেয়া যাবে না। ঢাক কিনে দিলে তুই আমাকে ঘুমাতে দিবি না।
নাতি তখন বলছে, না দাদু, তুমি যখন ঘুমিয়ে থাকবে, তখন ঢাক বাজাবো! বাবা তোমার কাছ থেকে এরকম গল্প কৌতুক শুনেই তো আমি বেড়ে উঠেছি। তোমার রসবোধ ছিল প্রবল। যেকোনো পরিস্থিতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হাস্যরসাত্মক কথা দিয়ে পরিবেশকে আনন্দমুখর করে তুলতে। আবার আমার দুষ্টুমি অপছন্দ হলে ব্যঙ্গ করে বলতে, ‘আসেন আব্বা, আমরা ঠাট্টা করি’।
রাতে ঘুমিয়ে যেতাম তোমার গল্প শুনে। আলীবাবা চল্লিশ চোর, ভূতের গল্প, কৃষকের চার অলস ছেলের গল্প, সূরা ইউসূফের কাহিনি, রানী বিলকিসের কাহিনি, আসহাব-কাহাফের গল্প, নকশিকাঁথার মাঠ, আরও কতো যে গল্প ছিল তোমার ঝুলিতে! খাবারের অভাবে শিশুদের জন্য মায়ের পানিতে পাথর জ্বাল দেয়ার গল্প শুনে আমিই সেই শিশু হয়ে যেতাম। নকশিকাঁথার মাঠের রূপাই আর সাজুর কাহিনি শুনে শোকগাঁথার ক্যানভাস এঁকে নিতাম অন্তরে।
আমি তখন গ্রামের স্কুলে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ি। স্কুল ফাঁকি দিয়ে পড়শি ছেলেদের সঙ্গে মার্বেল খেলায় মেতে আছি। তুমি ঠিকই আমাকে খুঁজে বের করেছো। তমিজউদ্দিন মাস্টার এখানে স্কুল খুলছে? এই বলে- পিটুনি দিয়ে স্কুলে নিয়ে হাজির করলে। সেদিন স্কুলে না পাঠালে হয়তো গ্রাম্য রাখাল বালক হয়ে আমার দিন গড়াতে পারতো।
তোমার কাঁধে চড়েই ফুপুবাড়ি বেড়াতে গেছি ছোট্ট আমি। চাঁদপুর, কানাইপুর বাজারে মণীন্দ্র ময়রার দোকানে বসে ইচ্ছেমতো মিষ্টি খাবার জন্য খাতির পেতাম। তোমার দৈনিক নামাজ আদায়ের ক্বিরাত শুনেই সূরা ফাতেহা আমার মনে গেঁথে গেছে।
ফরিদপুর মধুখালির মির্জাকান্দি গ্রাম থেকে ৫ মাইল দূরের কানাইপুর হাই স্কুলে দশম শ্রেণি পর্যন্ত তোমার লেখাপড়া। পুরোদস্তুর কৃষক হয়ে ফসল ফলাতে নিজ হাতে। অথচ মনে-প্রাণে ছিলে পুরোপুরি আধুনিক। নিজের পরিশ্রম দিয়ে আমাদের ৪ ভাইবোনকে লেখাপড়া শিখিয়েছো। ভোরে টিউবওয়েলের হাতলের শব্দ হলেই বুঝা যেতো তুমি উঠে পড়েছো। অত্যন্ত সময় সচেতন মানুষ যে! আষাঢ়, আশ্বিন, পৌষ, চৈত্র বারোমাস নিয়মিত ভোরে উঠে নামাজ সেরে, কোরআন তিলাওয়াত করতে, মুখস্ত ইয়াসিন সূরাসহ ওজিফা পড়তে। এরপর শোনা যেতো সুর করে মিলাদ পড়া। গ্রামের ঈদের জামাতে প্রথম মুসল্লি কে? সে তো তুমিই বাবা!
দিনের আলো ফুটে ওঠার আগেই ঝাঁপিয়ে পড়তে কাজে। কাজ থেকে ফিরে গোসল সেরে হালকা বিশ্রাম। একটু আগেই লোকটি ধুলা-কাদা মেখে মাঠে কাজ করেছে, তা বোঝা যেতো না। তখন ভঙ্গিটা এমন হতো যেন গজ ফুটে মাপ নেয়ার জন্য লাশটাকে টান টান করে রাখা হয়েছে। নিজে শেভ করে, কাপড় কেচে, জুতা পলিশ করে পরিপাটি হয়ে তোমার চলা চাই। সঠিক সময় দেয়া ঘড়ি শোভা পেতো তোমার হাতে। দূরের যাত্রায় বের হতে অতি ভোরে। বই, হাদিস, কোরআন ছিল তোমার নিত্য সাথী। কোথাও বেড়াতে গেলে ব্যাগ থেকে বের করে হাদিস পড়ে শোনাতে সেখানকার মানুষদের। ঘরে রাখতে প্রতি বছরের পঞ্জিকা। এ অভ্যাসটা পেয়েছো আমার দাদার কাছ থেকে। এখন আমিও রাখি। সংসারের দৈনন্দিন খরচ লিখতে হিসাবের খাতা। চাষবাস, বীজ, ফসল বোনার তালিকা রাখতে। ডায়রি লিখতে মাঝে মাঝে। আমি কেন লিখে রাখতে পারি না? ডাকঘরে আমার নামে সঞ্চয়ী হিসাব খুলে দিয়েছিলে। তবুও তোমার মতো মিতব্যয়ী হতে পারলাম না কেন, বলতে পারো?
ডাকযোগে গ্রাহক হয়ে পত্রিকা পড়ার অভ্যাস ছিল তোমার। ১০/১১ মাইল সাইকেল চালিয়ে ফরিদপুর শহরে গেলে পত্রিকা আনতে ভুল হতো না। পত্রিকাগুলো চাচাদের ঘরসহ বাড়ির চার ধারের ৪ ঘরে হাতবদল করে পড়া হতো। এখন সে পাঠাভ্যাস নাই কেন, বলতে পারো? হৃদয়বৃত্তিতে প্রচণ্ড আবেগপ্রবণ ছিলে তুমি। কবি নজরুলের ‘পদ্মার ঢেউরে.. মোর শূন্য হৃদয়-পদ্ম নিয়ে যা যা রে...’ গানটি খুব পছন্দ করতে।
কবি জসীম উদ্দীন-এর কবর কবিতা পড়ে আবেগাপ্লুত হয়ে চোখের পানি ফেলতে দেখেছি তোমাকে।
আমরা সে হৃদয়বৃত্তি কী করে ফিরে পাবো, বলতে পারো?
আত্মীয়দের সঙ্গে ছিল পত্রযোগাযোগ। প্রতি শীতে সব আত্মীয়দের বাড়িতে একবার ঘুরে আসতে। সম্ভব হলে হেঁটেই যেতে। তরুণ বয়সে পাশের গ্রাম বেড়াদিতে ঘূর্ণি উপদ্রুত মানুষের সাহায্যে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলে। মুক্তিযুদ্ধকালে স্থানীয় সংখ্যালঘুদের জান-মাল রক্ষায় সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিলে তুমি। গ্রামের চাষী হয়েও ৫ম শ্রেণির ছাত্র আমাকে নিয়ে ঢাকায় গিয়েছিলে, রাজধানী শহর দেখানোর জন্য। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ হলে গিয়ে ছাত্রদের সঙ্গে আলাপ করলে। দেখালে, উঁচু টেবিলে হালকা বার দিয়ে সেঁটে রাখা খবরের কাগজ পড়ার ব্যবস্থা। এয়ারপোর্ট, জাদুঘর এবং আরও অনেক কিছু।
বড়বোনের খোঁজখবর নিতে দেরি হলেই ‘তোমরা ভুলেই গেছো মল্লিকাদির নাম..’ গানের সুরে এভাবে বলে আফসোস করতে, আপত্য স্নেহে উতলা হতে দেখেছি। সদা ব্যস্ততার মাঝেও তুমি ছিলে রেডিওর খুব ভক্ত। খবর, নাটক, গানের শ্রোতা ছিলে। দেশের রেডিও ছাড়াও বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকা, আকাশবাণী শুনতে। রাত জেগে তোমার সঙ্গে নাটক শুনতাম। এখন একসঙ্গে আমরা বসতে পারি না কেন? অসুস্থ হয়ে পড়ে থাকলে পাশের রুমের নিকটজনরাও আসে না কেন? তোমার হৃদয়ের নরম পলিতে স্থান থাকলেও তোমাকে যমের মতো ভয় পেতাম কেন? যা বলতে পারিনি কখনো।
পরশপাথর কবিতার ভাবার্থ তোমার কাছেই প্রথম শুনি। অনন্তের পথে আমরা সবাই খুঁজে ফিরি ক্ষ্যাপা হয়ে। পেয়েও বেখেয়ালে হারিয়ে ফেলি। আবার খুঁজতে থাকি। কিংবা মানুষের জীবনে সবচেয়ে আশ্চর্য কী? ঘুমের মধ্যে প্রতিদিন মৃত্যুপুরীতে পৌঁছে আবার ফিরে আসি।’ এরকম সব জীবন-দর্শন, জীবন জিজ্ঞাসা, জীবনলিপি সহজ কথায় আর কার কাছ থেকে পাবো? গোটা পৃথিবী হাতের মুঠোয়, অথচ সাড়ে তিনহাত গভীরে তোমার সঙ্গে কথা নেই!
লেখক: অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, সরকারি বিএল কলেজ, খুলনা।