শরীর ও মন
যে কারণে সোরিয়াসিস একটি জটিল চর্মরোগ
ডা. দিদারুল আহসান
১৭ আগস্ট ২০২২, বুধবারসোরিয়াসিস চর্মরোগটি শরীরের বিভিন্ন অংশে হতে পারে। যেমন- মাথার ত্বকে, জিহ্বা, অণ্ডকোষের থলের চামড়ায় পর্যন্ত, পিঠের ওপরের অংশ থেকে নিচের অংশ, ঘাড়, হাতের কনুই, আঙ্গুল, ত্বকের ভাঁজে, তালু, পিঠ, নখ ও তার আশপাশে; পায়ের তালু, হাঁটু, হাত-পায়ের জয়েন্টে এটি বেশি দেখা যায় এবং এসব স্থান থেকে ক্রমাগত চামড়া বা আবরণ উঠতে থাকে।
প্রকারভেদ এই রোগটি বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে। নিম্নে তা তুলে ধরা হলো- পেক সোরিয়াসিস এই প্রকারের সোরিয়াসিস লালচে প্রদাহজনিত। এই সোরিয়াসিস হলে সিলভার বা সাদা রঙের মতো আবরণ বা আঁশ ওঠে। সাধারণত হাতের কনুই, হাঁটু, মাথা ও পিঠের নিচের দিকে এই সোরিয়াসিস দেখা যায়। আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে ৮০ শতাংশ রোগীই পেক সোরিয়াসিসের অন্তর্ভুক্ত।
ইনভার্স সোরিয়াসিস এটি লালচে রঙের হয়ে থাকে, যার কোনো আবরণ থাকে না। অনেকটা মসৃণ ও চকচকে ধরনের হয়। ঘর্ষণ, চুলকানি ও ঘামের কারণে যন্ত্রণা হতে পারে। সাধারণত মোটা চামড়ার গভীর ভাঁজযুক্ত ব্যক্তিদের এই সোরিয়াসিস বেশি হয়।
ইরিথ্রোডার্মিক এটিও লালচে রঙের হয়ে থাকে, যা দেহের পুরো স্থানজুড়ে দেখা যায়। চামড়া উঠতে থাকে, প্রচণ্ড চুলকানি হয়। এর প্রভাবে শরীরের তাপমাত্রা ওঠানামা, নিউমোনিয়া, হার্টফেলিওর সহ নানা সমস্যা হতে পারে।
গাট্টেট সাধারণত শিশু বা যুবক বয়সে দেখা দেয়। এটিও লাল ছোট ছোট স্পটের মতো হয়। পেক সোরিয়াসিসের মতো এতেও আবরণ ওঠে। এ ধরনের সোরিয়াসিসে ঊর্ধ্ব শ্বাসতন্ত্রের অসুস্থতা, স্ট্রেপটোকক্কাল প্রদাহ, টনসিলে প্রদাহ ইত্যাদি কিছুদিন অনুপস্থিত থেকে আবারও ফিরে আসতে পারে বা পেক সোরিয়াসিসে রূপান্তরিত হতে পারে।
পাস্টুলার এটা হলে চামড়া লাল হয়ে যায়, শরীরের নির্দিষ্ট স্থানে সাদা পুঁজ বা ফোসকা তৈরি করে, আবরণ উঠতে থাকে। চারদিকে লালচে ধরনের চামড়া থাকে। তবে এটি দ্রুত ছড়ায় না এবং সহজে অন্যকে সংক্রমিতও করে না।
সোরিয়াটিক আর্থ্রাইটিস এটা শরীরের বিভিন্ন জয়েন্ট আক্রান্ত করতে পারে। হাতের আঙ্গুুলের ছোট ছোট জয়েন্ট আক্রান্ত হতে পারে এবং হাত বিকৃতও করতে পারে।
লক্ষণসমূহ শরীরের কিছু নির্দিষ্ট জায়গা, যেমন- কনুই, হাঁটু, হাত-পায়ের তলা, মাথা, পিঠ ইত্যাদি স্থান থেকে সাপের মতো চামড়া বা খোলস উঠে যায়। মাথা থেকে খুশকির মতো উঠতে থাকে। তা ছাড়া উল্টো জায়গাগুলো, বিশেষ করে শরীরের ভাঁজের মধ্যে বেশি হয়।
কারণসমূহ সোরিয়াসিস হওয়ার পেছনে অনেক কারণ রয়েছে বলে একে ‘মাল্টিফ্যাক্টরিয়ান’ বলা যেতে পারে। সাধারণত যে কারণগুলো চিহ্নিত করা হয়।
স্থূলতা ওজন বেড়ে গেলে সোরিয়াসিস হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে বা এই রোগ হওয়ার প্রবণতা বেড়ে যায়। বংশগত পরিবারের কারো সোরিয়াসিস হলে অন্যদেরও হওয়ার ঝুঁকি থাকে। কারো যদি পিতা-মাতা উভয়ের হয়, তবে এই ঝুঁকি আরও বেড়ে যায়।
ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস সংক্রমণ ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস বা ছত্রাকজনিত সংক্রমণের কারণে সোরিয়াসিস হতে পারে।
ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কিছু কিছু ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া যেমন- উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ বিটা বকার, ব্যথার ওষুধ এনএসএআইডি (নন- স্টেরয়েডাল অ্যান্টি-ইনফ্লামেটরি ড্রাগ), মানসিক রোগীর ওষুধ লিথিয়াম, মুখে খাওয়ার স্টেরয়েড ইত্যাদি ওষুধের ব্যবহার রোগকে জটিল করতে পারে বা বাড়িয়ে দিতে পারে।
মানসিক চাপ অতিরিক্ত টেনশন দেহের ইমিউন সিস্টেমকে প্রভাবিত করে। অতিরিক্ত মানসিক চাপ সোরিয়াসিস হওয়ার আশঙ্কা বাড়ায়।
পরিবেশগত লাল মাংস, বিশেষ করে গরু ও খাসির মাংস বেশি খেলে হতে পারে। ধূমপান, অতিরিক্ত মদ্যপান ধূমপান, অতিরিক্ত মদ্যপানের প্রভাব পড়তে পারে সোরিয়াসিসের ক্ষেত্রে। অতিরিক্ত কোলেস্টেরল যদি কোলেস্টেরলের পরিমাণ বেশি থাকে, তাহলে সোরিয়াসিস রোগীদের হার্টের সমস্যা বেশি হতে পারে। এ ছাড়া ত্বকের সংক্রমণ, ক্ষত, আঘাত বা কাটা- ছেঁড়া, সানবার্ন, ভিটামিন ‘ডি’র ঘাটতি প্রভৃতি কারণে সোরিয়াসিস হতে পারে।
চিকিৎসা সোরিয়াসিস একেবারে নির্মূলযোগ্য রোগ নয় বা নির্মূল করা যায় না তবে নিয়ন্ত্রণযোগ্য। নিয়মিত সঠিক চিকিৎসা নিলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সোরিয়াসিস নিয়ন্ত্রণে থাকে। এখন নতুন নতুন অনেক চিকিৎসা বের হয়েছে এবং এর অনেক ভালো ওষুধ আছে। রোগী যদি চিকিৎসকের পরামর্শ মতো নিয়ম মেনে ওষুধ সেবন করে তাহলে রোগটি নিয়ন্ত্রণে থাকে। সোরিয়াসিসের একটি চিকিৎসা ভিটামিন ‘ডি’। এ ছাড়া ‘ক্যালসিপটট্রিয়ল’ ব্যবহার করারও পরামর্শ দেওয়া হয়। যে কোষগুলোর কারণে সোরিয়াসিস হয়, ফটোথেরাপি সেই কোষগুলোকে কমিয়ে দেয় বলে এটা খুব কার্যকর। এর নিরাপদ ব্যবহারে শিশুদের সোরিয়াসিসও নিয়ন্ত্রণ হয়। এ ছাড়া কিছু ‘ইমিউনোসাপ্রেসিভ’ ওষুধের পাশাপাশি রয়েছে ভিটামিন ‘এ’-জাতীয় ‘রেটিনয়েড’ (ব্যবহার করার সময় গর্ভধারণ নিষিদ্ধ), ‘সাইক্লোসপোরিন’ ইত্যাদি। বায়োলজিকস ওষুধগুলো এখন ইনজেকটেবল ফর্মেও মিলছে, এগুলো অবশ্য একটু দামি।
ঝুঁকি সমূহ সোরিয়াসিস রয়েছে যাদের, কিছু রোগের ঝুঁকি বেশি থাকে তাদের। যেমন- পরিবারের কারো এই রোগ হলে অন্য সদস্যদেরও হতে পারে। সোরিয়াসিস আক্রান্তদের উচ্চ রক্তচাপ, কার্ডিওভাসকুলার ডিজিজ বা হৃদরোগের আশঙ্কা দ্বিগুণ হয়। কিছু চোখের সমস্যা, যেমন- চোখ ওঠা, ইউভাইটিস ইত্যাদি হতে পারে। আক্রান্তপ্রর কিডনি রোগ, পরিপাকতন্ত্রের নানা রোগ, ক্রনস ডিজিজ হতে পারে। ৩০ শতাংশের আর্থ্রাইটিস, গুাঁট রোগ বা জয়েন্টের প্রদাহ হতে পারে। সোরিয়াসিসের কারণে ‘টাইপ টু’ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ে। সোরিয়াসিস হলে মোটা বা স্থূল হয়ে যাওয়ার প্রবণতা বাড়ে, তবে এর সঠিক কারণ জানা যায়নি। সোরিয়াসিস মানুষের জীবনমান প্রভাবিত করতে পারে। এটা হীনম্মন্যতা বাড়িয়ে মানুষকে মানসিক রোগীতে পরিণত করে। একসময় তা সারা শরীরে ছড়িয়ে যেতে পারে (এক্সফনয়েটিভি ডার্মাটাইটিস)। অনেক সময় সারা গায়ে পুঁজের মতো হতে পারে। এগুলো খুব জটিল অবস্থা। তবে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া এই রোগের কোনো ওষুধ সেবন না করাই ভালো। এই রোগে আক্রান্ত রোগীদের নিয়ম-কানুন টেনশনমুক্ত থাকার চেষ্টা করা। রোগকে মোকাবিলা করার মতো দৃঢ় মনোবল রাখা। অন্যান্য আক্রান্ত রোগীর সঙ্গে মিলে দুঃখ-কষ্টের কথা শেয়ার করলে মনের স্ট্রেস বা চাপ কমে। স্বাস্থ্যকর ও পুষ্টিকর খাদ্যাভ্যাস তৈরি করতে হবে। অতিরিক্ত ফ্যাট, চর্বিযুক্ত, উত্তেজক খাবার পরিহার করতে হবে। ধূমপান, অ্যালকোহল, ক্ষারীয় সাবান, অস্বাস্থ্যকর পোশাক ও পরিবেশ বর্জন করতে হবে। নিয়মিত গোসল, প্রতিদিন খুব ভোরে একটু নিয়ম করে হাঁটা ও ব্যায়াম করা ভালো। সোরিয়াসিস হলে অতিরিক্ত চুলকানো ঠিক নয়, এটা ত্বকের জন্য খুব ক্ষতিকর। চামড়াকে সব সময় ময়েশ্চারাইজ করে রাখার চেষ্টা করা উচিত। সকাল ৮-১০টার রোদ খুব উপকারী। তবে এই সময়ের পরের রোদ সোরিয়াসিসের জন্য ক্ষতিকর।
লেখক: চর্ম, যৌন ও এলার্জি রোগ বিশেষজ্ঞ ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক আল-রাজী হাসপাতাল, ফার্মগেট ঢাকা। এ ধরনের রোগে আক্রান্ত হলে যোগাযোগ করতে পারেন- ০১৭১৫-৬১৬২০০