ঢাকা, ২৪ এপ্রিল ২০২৫, বৃহস্পতিবার, ১১ বৈশাখ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ২৪ শাওয়াল ১৪৪৬ হিঃ

প্রথম পাতা

আল জাজিরার বিশ্লেষণ

কাশ্মীরে সন্ত্রাসী হামলায় ফের তুঙ্গে ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনা

মানবজমিন ডেস্ক
২৪ এপ্রিল ২০২৫, বৃহস্পতিবার

মঙ্গলবার ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পহেলগাঁওয়ে মনোরম পর্যটন কেন্দ্রে হামলা চালিয়েছে সন্দেহভাজন বিদ্রোহীরা। এতে কমপক্ষে ২৮ জন পর্যটক নিহত হয়েছেন। বিশ্লেষকরা মনে করছেন কাশ্মীরে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনাটি ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনার পারদ যোগান দেবে। কাশ্মীরের দক্ষিণাঞ্চলীয় জেলা অনন্তনাগে এই হামলার ঘটনায় ভারত জুড়ে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে। পর্যটন মৌসুমকে টার্গেট করে এই হামলা চালানো হয়েছে। ভারতের এই অঞ্চলটিতে প্রতি বছর লাখ লাখ পর্যটক ছুটি কাটাতে যান। যদিও ওই অঞ্চলে বেশ কয়েকটি সশস্ত্র বিদ্রোহী গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে। হামলার পরপরই পুলিশ ও আধা-সামরিক বাহিনীর একটি দল আহত পর্যটকদের সরিয়ে নিয়ে আসে এবং সন্ত্রাসীদের ধরতে অভিযান শুরু করেছে। পুরো বিষয়টি খুব নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করতে ঘটনাস্থলে গিয়েছেন ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। তার সঙ্গে দেশের শীর্ষ নিরাপত্তা কর্মকর্তারাও রয়েছেন। অন্যদিকে সৌদি সফর সংক্ষিপ্ত করে নয়াদিল্লিতে ফিরে এসেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। দিল্লিতে ফিরেই বুধবার সকালে জরুরি বৈঠক করেছেন তিনি। এ ছাড়া এমন এক সময়ে এই হামলা চালানো হয়েছে যখন যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট তার পরিবার নিয়ে ভারত সফরে রয়েছেন। তিনি সোমবার দিল্লিতে পা রাখেন। বৃহস্পতিবার তিনি ভারত ছাড়বেন বলে কথা রয়েছে। এই হামলা কাশ্মীর ও ওই অঞ্চলের ওপর কেমন প্রভাব ফেলবে এবং ভারত কীভাবে এর প্রতিক্রিয়া জানাবে তা নিয়ে বিশ্লেষণ করেছে কাতারভিত্তিক গণমাধ্যম আল জাজিরা। 

ঘটনার বিবরণ: কাশ্মীরের ভাষায় পহেলগাঁও অর্থ হচ্ছে ‘মেষপালকের উপত্যকা’। পর্যটকদের জন্য এই স্থানটি বেশ আকর্ষণীয়। কাশ্মীরের প্রধান শহর শ্রীনগর থেকে এর দূরত্ব প্রায় ৫০ কিলোমিটার। মঙ্গলবার প্রত্যক্ষদর্শীরা আল জাজিরাকে জানিয়েছেন, ওই স্থানটিতে ছিল পর্যটকদের উপচে পড়া ভিড়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, স্থানীয় সময় দুপুর ২টা ৪৫ মিনিটে কাছের একটি জঙ্গল থেকে বেরিয়ে আসে মুখোশধারী একটি সশস্ত্র দল। এরপর বাইসারান তৃণভূমিতে নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে তারা। হামলার ওই স্থানটিতে পায়ে হেঁটে অথবা ঘোড়ায় করে যাওয়া যায়। ওই কর্মকর্তা বলেন, হঠাৎ গুলির শব্দ শুনে বহু পর্যটক জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যান। ভারতের পশ্চিমাঞ্চলের নাগপুর থেকে আসা সিমরান চন্দনি নামের এক পর্যটক জানিয়েছেন, তিনি নিশ্চিত ছিলেন না যে, হামলার পরও তার প্রাণ থাকবে কিনা। এই পর্যটক বলেছেন, আমরা চা ও নুডুলস খাওয়া শেষ করে বাইরে ঘুরতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। ঠিক তখনই অতর্কিতভাবে হামলা শুরু হয়। যাতে ২৮ পর্যটক নিহত হয়েছেন। যাদের মধ্যে দুইজন বিদেশি পর্যটক রয়েছেন। এ ছাড়া কয়েক ডজন মানুষ আহত হয়েছেন। নিহত ব্যক্তিদের প্রায় প্রত্যেকেই বেসামরিক। তবে এতে ভারতীয় নৌবাহিনীর একজন সদস্যও ছিলেন বলে নিশ্চিত করেছে কর্তৃপক্ষ। তিনি তার স্ত্রীকে নিয়ে সেখানে হানিমুনে গিয়েছিলেন। এ ছাড়া দক্ষিণাঞ্চলীয় রাজ্য অন্ধ্র প্রদেশের পান্ডুরঙ্গাপুরমের একজন সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তাও নিহত হয়েছেন। তার বয়স ৬৮ বছর। তিনিও তার স্ত্রীকে নিয়ে পহেলগাঁওয়ে বেড়াতে গিয়েছিলেন। নিহতদের মধ্যে সরকারি কর্মকর্তাসহ বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ীও ছিলেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য ওড়িশার একজন হিসাবরক্ষক, উত্তরাঞ্চলীয় একটি প্রদেশের একজন সিমেন্ট ব্যবসায়ী এবং দক্ষিণাঞ্চলীয় রাজ্য কেরালার একজন বাসিন্দা। যিনি উপসাগরীয় অঞ্চলে কাজ করতেন।

হামলার দায় স্বীকার: এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে  রেসিস্ট্যান্স ফ্রন্ট (টিআরএফ) নামের একটি সশস্ত্র গ্রুপ এই হামলার দায় স্বীকার করেছে। ধারণা করা হচ্ছে এটি পাকিস্তানের নিষিদ্ধঘোষিত সন্ত্রাসী সংগঠন লস্কর-ই- তৈয়বার একটি শাখা। ২০১৯ সালে কাশ্মীরের আধা-স্বায়ত্তশাসিত মর্যাদা কেড়ে নেয় ভারত সরকার। এর মাধ্যমে অঞ্চলটিতে কেন্দ্র তাদের নিয়ন্ত্রণ আরও জোরদার করে। তারা রাজ্যটিকে কেন্দ্রশাসিত দুটি অঞ্চলে ভাগ করেছে। মোদি সরকারের এই পদক্ষেপের ফলে অঞ্চলটির রাজনৈতিক উত্তেজনা বৃদ্ধি পায়। এ ছাড়া মোদি সরকার এই আইনের মাধ্যমে কাশ্মীরের বাইরের মানুষকে সেখানে বসবাস করার অনুমতি দেয়ার পথ প্রশস্ত করেছে, যা এর আগ পর্যন্ত নিষিদ্ধ ছিল। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ভারতীয় এক কর্মকর্তা আল জাজিরাকে জানিয়েছেন, তারা সন্দেহ করছেন যে, এই হামলায় মোট চারজন সন্ত্রাসী অংশ নিয়েছিলেন। যাদের মধ্যে দুজন পাকিস্তানের এবং দুজন ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের। 

অতীতে কি পর্যটকদের লক্ষ্য করে এমন হামলার ঘটনা আছে: যদিও কাশ্মীরের অস্থিরতার মধ্যে পর্যটকদের লক্ষ্য করে সরাসরি হামলার ঘটনা বিরল। তবে ১৯৯৫ সালে পহেলগাঁওয়ে একটি অপহরণের ঘটনা ঘটে। সেসময় আল ফারান নামের একটি সশস্ত্র গোষ্ঠী ছয় বিদেশি পর্যটককে অপহরণ করে নিয়ে যায়। এর মধ্যে একজনকে হত্যা করা হয় আর আরেকজন পালিয়ে যায়। বাকি চারজনের হদিস এখনো পাওয়া যায়নি। এ ছাড়া ২০০০ সালের দিকে একটি অতর্কিত হামলায় ৩২ জন নিহত হয়েছিলেন। যাদের মধ্যে ২১ জন হিন্দু তীর্থযাত্রীও ছিলেন। এর এক বছর পর একই এলাকার শেষনাগ হ্রদের কাছে ১১ জন তীর্থযাত্রী এবং দুই স্থানীয় বাসিন্দাকে হত্যা করা হয়। ২০১৭ সালে অনন্তনাগ জেলায় গুলিবিদ্ধ হয়ে আটজন তীর্থযাত্রী নিহত হন। গত বছরের জুন মাসে জম্মুর কাঠুয়ার দক্ষিণ অংশে আটজন হিন্দু তীর্থযাত্রী নিহত হন। যদিও বলা হয় যে, বাসের চালক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খাদে পড়ে তাদের মৃত্যু হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, মঙ্গলবারের হামলাটি সম্ভবত ২০০০ সালের পর পর্যটকদের উপর সবচেয়ে মারাত্মক হামলা। সবদিক বিবেচনায় ২০০১ সালের অক্টোবরে জম্মু-কাশ্মীরের রাজ্য আইনসভার বাইরে বোমা হামলার পর এর বাইরে কোনো হামলায় এত প্রাণহানি দেখেনি কাশ্মীরের বাসিন্দারা। ওই হামলায় প্রায় ৩৫ জন নিহত হয়েছিলেন। 

ভারতের প্রতিক্রিয়া: অতর্কিত এই হামলার প্রতিক্রিয়া কী হবে তা ঠিক করতে বুধবার বৈঠক করেছেন সরকারি পক্ষের নেতারা। এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রী নিজে তার সৌদি আরবের সফর সংক্ষিপ্ত করে দিল্লিতে ফিরে এসেছেন। সেখানে সৌদির ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের সঙ্গে দেখা করার কথা ছিল। তবে হামলার পর তা বাদ রেখেই সফর শেষ করেছেন মোদি। সন্ত্রাসী হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়ে এক্সে পোস্ট করেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী। সেখানে তিনি বলেছেন, যারা তাদের প্রিয়জনদের হারিয়েছেন তাদের প্রতি সমবেদনা জানাই। আহতদের দ্রুত আরোগ্য কামনা করছি। হামলায় ক্ষতিগ্রস্তদের সম্ভাব্য সকল সহায়তা করা হচ্ছে বলেও জানান মোদি। যারা এই হামলার সঙ্গে জড়িত তাদের বিচারের আওতায় এনে কঠিন শাস্তির মুখোমুখি করা হবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। বলেছেন, হামলাকারীদের রেহাই দেয়া হবে না। ঘটনার পরপরই শ্রীনগর ছুটে গিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। তিনি ওই অঞ্চলের শীর্ষ নিরাপত্তা কর্মীদের সঙ্গে  বৈঠক করেছেন। এদিকে ২০১৯ সালে কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিলের তীব্র সমালোচনা করেছেন ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের শীর্ষ বিরোধী দলের নেতা রাহুল গান্ধী। তিনি বলেছেন, সন্ত্রাস দমনে গোটা দেশ ঐক্যবদ্ধ। জম্মু-কাশ্মীরের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার ফাঁকা বুলি আওড়ানো বাদ দিয়ে সরকারকে জবাবদিহিতার আওতায় আনার দৃঢ় পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। গান্ধী বলেছেন, এমন বর্বর ঘটনা যেন আর না ঘটে এবং নিরীহ ভারতীয়রা যেন আর প্রাণ না হারান সে বিষয়ে জোর পদক্ষেপ নিতে হবে। 

ফের তুঙ্গে ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনা: বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই নৃশংস হামলায় পাকিস্তানের বিরুদ্ধে প্রতিশোধমূলক প্রতিক্রিয়া দিতে পারে ভারত। পাকিস্তানের  সেনাপ্রধান অসীম মুনিরের ভাষণের কথা উল্লেখ করেছেন নয়াদিল্লি-ভিত্তিক থিঙ্কট্যাঙ্ক সেন্টার ফর ল্যান্ড ওয়ারফেয়ার স্টাডিজ (সিএলএডব্লিউএস) এর পরিচালক তারা কার্থা। যেখানে বলা হয়েছিল, এটা যুদ্ধের একটা পদক্ষেপ। আমরা এ বিষয়টিকে এভাবেই দেখছি। পাকিস্তানের সেনাপ্রধানের এই বক্তৃতার কয়েকদিন পরেই এমন হামলার ঘটনা ঘটলো। কার্থা ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের সাবেক একজন কর্মকর্তা। ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের বিষয়টি উল্লেখ করে ওই ভাষণ দিয়েছিলেন পাকিস্তানের  সেনাপ্রধান। কার্থা বলেছেন, পহেলগাঁওয়ের হামলা ১৬ই এপ্রিল মুনিরের দেয়া ভাষণের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ। এক্ষেত্রে পাকিস্তান যদি এই হামলার তীব্র নিন্দা জানায় এবং আগামী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয় তাহলেই কেবল এই সংকট এড়ানো সম্ভব। 

বুধবার ভোরে হামলার প্রতিক্রিয়া দিয়েছে পাকিস্তান।  দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ভারতের অবৈধভাবে দখলকৃত জম্মু-কাশ্মীরের অনন্তনাগ জেলায় এক হামলায় পর্যটকদের প্রাণহানি হয়েছে। এতে আমরা উদ্বিগ্ন। আমরা নিহতদের নিকটাত্মীয়দের প্রতি সমবেদনা জানাই এবং আহতদের দ্রুত আরোগ্য কামনা করি। এখানে বলে রাখা ভালো, ভারত ও পাকিস্তান- উভয় দেশই গোটা কাশ্মীর নিজেদের বলে দাবি করে। তবে বর্তমানে কাশ্মীরের দুটি অংশ এ দুই দেশের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। যদিও এই বিবৃতিতে ভারতে উত্তেজনা কমানোর সম্ভাবনা কম। কেননা,  মোদি সরকার পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে চাপের সম্মুখীন হবে। তবে এক্ষেত্রে আবেগপ্রবণ প্রতিক্রিয়া জানানোর বিরুদ্ধে সতর্ক করেছেন বেশ কয়েকজন বিশেষজ্ঞ।   
 

প্রথম পাতা থেকে আরও পড়ুন

প্রথম পাতা সর্বাধিক পঠিত

   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2025
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status