ঢাকা, ২০ এপ্রিল ২০২৫, রবিবার, ৭ বৈশাখ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ২০ শাওয়াল ১৪৪৬ হিঃ

প্রথম পাতা

ঐকমত্য কমিশনে দিনভর আলোচনা

তিন ইস্যুতে অনড় এনসিপি

স্টাফ রিপোর্টার
২০ এপ্রিল ২০২৫, রবিবার
mzamin

জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বৈঠকে রাষ্ট্রের মৌলিক সংস্কার, সংবিধান পুনর্লিখন বা রি-রাইট এবং শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরের বিষয়ে তিনটি মূল দাবির ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছে। এ ছাড়াও ক্ষমতার ভারসাম্য, নির্বাচনকালীন সরকারের রূপরেখা, গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক বন্দোবস্ত প্রতিষ্ঠা, বিচার ও সংস্কার দৃশ্যমান করার মধ্য দিয়ে নির্বাচনের দিকে অগ্রসর হওয়াসহ বিভিন্ন বিষয়ে ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে আলোচনায় গুরুত্ব আরোপ করেছে বলে জানিয়েছে দলটি। গতকাল সকাল ১০টা ৩০ মিনিটে জাতীয় সংসদ ভবনের এলডি হলে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বৈঠক শুরু হয়ে চলে দিনব্যাপী। এনসিপি’র আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামের নেতৃত্বে ৮ সদস্যের প্রতিনিধিদল অংশ নেয় আলোচনায়।

আলোচনা শেষে সাংবাদিকদের নাহিদ ইসলাম বলেন, সংবিধান সংস্কারের জন্য গণভোট চায় এনসিপি। প্রধানমন্ত্রী নয়, মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকারের প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। জনগণের মধ্যে যে আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে, তা অবশ্যই পূরণ করতে হবে। এটা জাতির প্রতি আমাদের সবারই অঙ্গীকার। ১০০ আসনে নারীর প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচন করার কথা বলেছি। আমরা বলেছি রাষ্ট্রের মৌলিক সংস্কার করে আমরা গণতান্ত্রিক কাঠামোতে প্রবেশ করতে পারবো। দুইবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না, একবার প্রধানমন্ত্রী হলে পরে রাষ্ট্রপতি হতে পারবেন না, সাংবিধানিক কাউন্সিল সাংবিধানিক পদগুলোতে নিয়োগ দেবে- এসব বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।

সংবিধানে মূলনীতির মাধ্যমে দলীয় মূলনীতি প্রবেশ করানো হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, সংবিধানের মূলনীতির প্রয়োজন আছে কিনা, বিষয়টি বলেছি। বাহাত্তরের মূলনীতি এবং দলীয় মূলনীতি বাদ দিতে হবে।

সূচনা বক্তব্যে নাহিদ ইসলাম বলেন, ২০২৪ সালের জুলাই মাসের গণঅভ্যুত্থান কেবল একটি ব্যক্তির পতনের জন্য নয়, বরং রাষ্ট্র কাঠামোর গুণগত ও মৌলিক পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা নিয়ে এসেছিল। আমাদের আন্দোলনের মূল লক্ষ্যই ছিল ফ্যাসিবাদী শাসনের অবসান এবং একটি নতুন গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক বন্দোবস্ত প্রতিষ্ঠা করা।

বাংলাদেশ একটি রূপান্তরের মধ্যদিয়ে যাচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের প্রেক্ষিতে আমাদের নতুন বাংলাদেশের যে আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে। সেই আকাঙ্ক্ষাকেই বাস্তবায়নের জন্য রাষ্ট্রসংস্কারের কথা বলা হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের যে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে এজন্য ঐকমত্য কমিশনের প্রতি জাতীয় নাগরিক পার্টি ও বাংলাদেশের মানুষ বরাবরই কৃতজ্ঞ।

নাহিদ ইসলাম বলেন, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি আলী রীয়াজ স্যারও বললেন আজকে আমাদের বসার প্রেক্ষাপট ২০২৪ সালের জুলাই মাসের গণঅভ্যুত্থান।  যে গণঅভ্যুত্থানের মধ্যদিয়ে ১৬ বছরের একটি ফ্যাসিস্ট  শাসককে পলায়ন করতে বাধ্য করেছিল বাংলাদেশের জনগণ। হাজারো মানুষের শাহাদতবরণ, আহতদের কারণেই আজকের এই প্রেক্ষাপট।  

তিনি আরও বলেন, জাতীয় নাগরিক পার্টি জুলাই অভ্যুত্থানের ধারাবাহিকতায় একটি নতুন রাজনৈতিক দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। যে দলের প্রধান ভিত্তির জায়গাটা হচ্ছে এ দেশের তরুণরা এবং আমরা মনে করি জুলাই অভ্যুত্থানের সেই প্রেক্ষিতে আমাদের যে বক্তব্য ছিল। ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার বিলোপ এবং একটি নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত করতে চাই। অর্থাৎ জুলাই গণঅভ্যুত্থান কেবল কোনো ব্যক্তির পরিবর্তন নয়। ক্ষমতা থেকে একটি দল থেকে আরেকটি দলকে বসানোর পরিকল্পনা ছিল না; বরং কীভাবে রাষ্ট্রের গুণগত পরিবর্তন করে রাষ্ট্রকাঠামোর মৌলিক ও গুণগত সংস্কারের মাধ্যমে জনগণের অধিকার রক্ষা করবে এমন একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার আকাঙ্ক্ষা ছিল সেই জুলাই গণঅভ্যুত্থানে।  

এনসিপি’র আহ্বায়ক বলেন, আমরা মনে করি যে, বাংলাদেশের ইতিহাসে বিভিন্ন সময় জনগণ রাস্তায় নেমেছে, আন্দোলন করেছে। ’৯০-এর গণঅভ্যুত্থানের কথাও ইতিহাসে পড়েছি। সেই আকাঙ্ক্ষাগুলো আমরা দেখেছি ব্যর্থ হয়েছে। সেই ব্যর্থতার ফলেই একটি ফ্যাসিবাদী শাসনব্যবস্থা তৈরি হয়েছিল।

এনসিপি খুব পরিষ্কারভাবে মৌলিক সংস্কারের কথা বলেছে উল্লেখ করে নাহিদ ইসলাম আরও বলেন,  যে সংস্কার করলে রাষ্ট্রকাঠামোর আমূল পরিবর্তন, গুণগত পরিবর্তন সম্ভব হবে। কারণ আমরা দেখেছি বিগত সময়ে আমাদের সংবিধান থেকে শুরু করে আমাদের যে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান সেই প্রতিষ্ঠাগুলোর দলীয়করণ ঘটেছিল। আমাদের সংবিধানে এক ব্যক্তিকেন্দ্রিক একটি কাঠামোর বীজ বপন হয়েছিল। ফলে সেই কাঠামোকে অক্ষুণ্ন রেখে যেই ক্ষমতায় যাক, রাষ্ট্রপরিচালনার দায়িত্ব পাক, তার ভেতরেও ফ্যাসিবাদী প্রবণতা থাকবে স্বৈরতান্ত্রিক হয়ে ওঠার। সেই জায়গায় রাষ্ট্রের মৌলিক সংস্কার সেক্ষেত্রে আমরা সংবিধান,  প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা,  বিচারব্যবস্থা, নির্বাচনব্যবস্থা ইত্যাদি বিষয়ে জাতীয় নাগরিক পার্টি বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছি। 

সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেন, বিচার এবং সংস্কার দৃশ্যমান করার মধ্যদিয়ে নির্বাচনের দিকে অগ্রসর হওয়া প্রয়োজন। নির্বাচন অবশ্যই হতে হবে, তবে তার আগে বিচার এবং সংস্কার দৃশ্যমান করতে হবে। এজন্য যেটুকু সময় প্রয়োজন, সেটি সরকার পেতে পারে। তবে কোনোভাবেই সরকার কাজ বেঁধে রেখে সময় পেতে পারে না।

তিনি বলেন, বর্তমান সংবিধান দিয়ে গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিত করা সম্ভবপর নয়। বরং এখানে প্রধানমন্ত্রীকে একচ্ছত্র ক্ষমতায়ন করা হয়েছে। তার মধ্যদিয়ে সাংবিধানিকভাবে স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সুযোগগুলো রয়েছে। আমরা ক্ষমতার ভারসাম্যের কথা বলছি। বর্তমান সংবিধানের মৌলিক সংস্কারের কথা বলছি। গণপরিষদের বাস্তবতা নিয়ে কথা বলেছি। 

সদস্য সচিব বলেন, নাগরিকদের মৌলিক অধিকার যেন নিরঙ্কুশ হয় এবং ক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়া যেন শান্তিপূর্ণ হয়- সেই বিষয়টিও বলেছি। বাংলাদেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক কাঠামোয় শুধুমাত্র আইনপ্রণয়নের ভিত্তিতে নয়, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সহাবস্থান এবং আস্থার ভিত্তিতে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়ায় ঐকমত্যে পৌঁছানোর বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেছি।

এনসিপি’র দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেন, যেসব বিষয়ে আমরা একমত হয়েছি সেসব বিষয়ে আমাদের নোট রয়েছে। সংযোজন, বিয়োজন এসব বিষয়ে নোট দিয়েছি আমাদের পক্ষ থেকে। মূলত আমরা তিনটি বিষয়ে কথা বলেছি প্রথম যে বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছি প্রটেকশন অব সিটিজেন। অর্থাৎ আমরা দেখেছি যে নাগরিকদের যে নিরঙ্কুশ রাষ্ট্রের মধ্যে যে অধিকারগুলো রয়েছে। নিরঙ্কুশ স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে কখনোই স্বীকৃত হয়নি। সেইসব বিষয় নিয়ে আমরা একদম ডিটেইল কথা বলছি। দ্বিতীয় যে বিষয়টি পিসফুল ট্রানজিশন অব পাওয়ার। আমরা দেখেছি রাষ্ট্রে পাওয়ার ট্রানজিশনের একটি সময় এসেছে। তখনই একটি গৃহযুদ্ধ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। একটা সরকার থেকে আরেকটি নির্বাচিত সরকার ট্রানজিশনটা কীভাবে হবে। এই বিষয়টা নিয়ে সবচেয়ে বেশি আলোচনা হচ্ছে। যাতে করে আমাদের অতীতে যে দুঃখ স্মৃতিগুলো রয়েছে। সেগুলো যাতে আর কখনোই পুনরাবৃত্তি না হয়। এই বিষয়গুলো নিয়ে আমাদের কথা হচ্ছে। তৃতীয় যে বিষয়টি আমাদের সংসদের স্থিতিশীলতার নামে যে ভয়েস মাচ করে রাখা হয়েছে। আর্টিকেল সেভেনটি সেটি নিয়ে কথা হচ্ছে।  যেটির মধ্যদিয়ে একইসঙ্গে সংসদের স্থিতিশীলতা, সংসদ সদস্যদের স্বাধীনতা এবং আমাদের সংসদকে কীভাবে আরও বেশি কার্যকর করা যায়। এখনো পর্যন্ত এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। 

আমরা দুটি নির্বাচন চাচ্ছি, এমন নয় উল্লেখ করে হাসনাত বলেন, আমরা একটি নির্বাচনই চাচ্ছি, যেটি আইনসভার নির্বাচন। একইসঙ্গে ওই নির্বাচনটিকেই গণপরিষদের স্ট্যাটাস দেয়া হবে। কারণ, যেকোনো ধরনের কনস্টিটিউশনাল অ্যামেন্ডমেন্ট যেকোনো সময় হাইকোর্টের চ্যালেঞ্জের শিকার হতে পারে। সংবিধানের বেসিক ফান্ডামেন্টাল রিফর্মেশনের এখতিয়ার শুধুমাত্র গণপরিষদের থাকে। সেজন্য আমরা আসন্ন নির্বাচনকে একইসঙ্গে আইনসভার নির্বাচন ও গণপরিষদের স্ট্যাটাস চাই। যাদের প্রথম কাজ হবে, সংবিধানকে রি-রাইট করা। একইসঙ্গে পার্লামেন্টের রুটিন কাজ করবে। 

বিএনপি ও এনসিপি কিছু সুপারিশের ক্ষেত্রে দ্বিমত আছে। সেক্ষেত্রে ঐক্য কীভাবে সম্ভব সাংবাদিকরা জানতে চাইলে হাসনাত বলেন, আলোচনার মধ্যদিয়ে ঐক্যে পৌঁছাতে হবে। ঐক্য তো দলীয় নয় বরং জাতীয় স্বার্থে। 

আলোচনার শুরুতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, সংস্কার কমিশনগুলোর পক্ষ থেকে যে সুপারিশ দেয়া হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে আপনাদের কিছু একমত, কিছু ভিন্নমত আছে। আমরা একমতের জায়গাগুলো চিহ্নিত করতে পেরেছি, সেগুলো নিয়ে অগ্রসর হবো। যেসব জায়গায় আংশিকভাবে একমত বা ভিন্নমত সেগুলো নিয়ে আজ আলোচনা করবো এবং প্রয়োজনে আলোচনা অব্যাহত থাকবে। কেননা আমরা চাই, জাতির আকাঙ্ক্ষার জায়গা থেকে একটি জাতীয় সনদ তৈরি করতে।

আলী রীয়াজ আরও বলেন, আপনারা প্রাণবাজি রেখে, লড়াই করে ফ্যাসিবাদী শাসককে পলায়ন করতে বাধ্য করেছেন। সেই বিজয়ের পাশাপাশি আপনারা সুস্পষ্টভাবে বলেছেন, একটি নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত চান এবং আপনাদের এই বক্তব্যের মধ্যদিয়ে মানুষের মধ্যে রাষ্ট্র সংস্কারের আকাঙ্ক্ষা উন্মত্ত হয়ে উঠেছে।

নতুন বাংলাদেশ গড়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশে যেন ফ্যাসিবাদী শাসন ফেরত না আসে, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো স্থায়ী রূপ নেয় এবং যেন মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। গুম, খুন, বিচারবহির্ভূত হত্যা এবং সমস্ত নিপীড়ন মোকাবিলা করতে পারি। সেই ব্যবস্থাগুলোকে অপসারণ করতে পারি।

বৈঠকে কমিশনের সদস্য ড. বদিউল আলম মজুমদার, ড. ইফতেখারুজ্জামান, সফররাজ হোসেন ও প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার উপস্থিত ছিলেন। অন্যদিকে উপস্থিত ছিলেন- এনসিপি’র আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম, সদস্য সচিব আখতার হোসেন, জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শারমিন, যুগ্ম আহ্বায়ক সারোয়ার তুষার, জাবেদ রাসিন, মুখ্য সমন্বয়ক নাসিরুদ্দিন পাটোয়ারী, দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আব্দুল্লাহ ও সিনিয়র যুগ্ম সদস্য সচিব নাহিদা সরওয়ার চৌধুরী।
 

প্রথম পাতা থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

প্রথম পাতা সর্বাধিক পঠিত

   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2025
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status