প্রথম পাতা
কাঠগড়ায় এনসিপি নেতারা
‘৬০ ভাগ রাজনীতি আমরা শেষ করে দিয়েছি’
স্টাফ রিপোর্টার
২০ এপ্রিল ২০২৫, রবিবার
দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, দলীয় নীতিবিরুদ্ধ কর্মকাণ্ড, সংগঠন বিস্তারে কার্যকর কোনো উদ্যোগ না নেয়াসহ বিভিন্ন ইস্যুতে দলীয় কাঠগড়ার মুখোমুখি হতে হয়েছে জাতীয় নাগরিক পার্টি- এনসিপি’র শীর্ষ নেতাদের। জবাবদিহিতা চাওয়া হয়েছে আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামসহ শীর্ষ নেতাদের কাছে। বৃহস্পতিবার দলটির তৃতীয় সাধারণ সভায় দলীয় কার্যক্রম নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন কেউ কেউ। বলা হয়, নানা কর্মকাণ্ডে আমাদের ৬০ ভাগ রাজনীতি শেষ হয়ে গেছে। বাকি ৪০ ভাগ কতোটুকু ধরে রাখতে পারবো এটা নিয়েও শঙ্কা আছে। বৈঠকে একজন নেতা বলেন, জাতীয় রাজনীতিতে এনসিপি’র যে সম্ভবনা ছিল তার ৩০ শতাংশ একজনের কারণেই নষ্ট হয়ে গেছে বলে উল্লেখ করেন। গণঅভ্যুত্থানের সময় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করা শীর্ষ ওই ছাত্রনেতার নাম উল্লেখ করেই তিনি বলেন, এনসিপি বা নাগরিক কমিটির কোনো পদে না থেকেও তিনি সব জায়গায় হস্তক্ষেপ করার চেষ্টা করছেন। তার কারণে আমাদের বৈঠকের সিদ্ধান্তও অনেক সময় গুরুত্ব পায় না।
সভায় দুর্নীতি ও দলীয় নীতিবিরুদ্ধ কর্মকাণ্ডের জন্য উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম, সংগঠক প্রতীম সোহাগ, যুগ্ম সদস্য সচিব গাজী সালাউদ্দিন তানভীরকে আর্থিক অনিয়ম ও নীতিবিরুদ্ধ কাজের জন্য জবাবদিহিতার মুখোমুখি হতে হয়েছে। আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামের বিষয়েও অসন্তোষ প্রকাশ করেন কেউ কেউ। তারা বলেন, এখন পর্যন্ত তার কাছ থেকে প্রত্যাশিত নেতৃৃত্ব পাচ্ছেন না। একইসঙ্গে আর্থিক বিষয়ে অস্বচ্ছতার বিষয়টিও উঠে আসে এনসিপি’র সাধারণ সভায়।
রাজধানীর রূপায়ন ট্রেড সেন্টারে এনসিপি’র অস্থায়ী কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এ সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারেও শৃঙ্খলা মেনে চলার বিষয়টি গুরুত্ব পায়।
এছাড়া তৃণমূলে সংগঠন বিস্তারের বিষয়টি আলোচনায় ছিল। যেখানে জেলা ও উপজেলা কমিটির ক্ষেত্রে আহ্বায়ককে ন্যূনতম ৪০ বছর বয়সী হতে হবে বলে সিদ্ধান্ত হয়। শৃঙ্খলা ও তদন্ত বিষয়ক একটি কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত হয়েছে বৈঠকে। ৯ ঘণ্টার বেশি সময় ধরে চলা সভায় অঞ্চলভিত্তিক সাংগঠনিক নীতিমালা নির্ধারণ, সংস্কার বিষয়ক প্রস্তাবনা প্রণয়ন, গণহত্যাকারী আওয়ামী লীগের বিচার ও গণপরিষদ নির্বাচনের দাবিতে কর্মসূচি নির্ধারণ, সীমান্ত হত্যা বন্ধে কার্যকর পলিসি গ্রহণে সরকারের কাছে দাবি জানানো; ফিলিস্তিনের গাজায় চলমান ইসরাইলি সহিংসতা ও ভারতে ওয়াক্ফ বিলের বিরুদ্ধে চলমান আন্দোলনে দমন-নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এবং দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধ করে জনমনে স্বস্তি আনতে সরকারের কাছে জোর দাবি জানানোর বিষয়ে আলোচনা হয়।
সভাসূত্র জানায়, এনসিপি’র সব সিদ্ধান্ত নির্দিষ্ট এক জায়গা থেকে আসছে বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন যুগ্ম সদস্য সচিব আরিফ সোহেল। আরেক যুগ্ম সদস্য সচিব ‘জুলাই ঘোষণা’র দাবির প্রক্রিয়া নিয়ে সমালোচনা করেন। যেখানে তিনি উল্লেখ করেন- হঠাৎ করে বলা হচ্ছে ৫ দিনের মধ্যে জুলাই ঘোষণা লাগবে, যেটি কোনো ফোরামে আগে আলোচনা করা হয়নি। সভায় একাধিক নেতা জোর দিয়ে বলেন, সবাইকে নিয়ে কেন্দ্রীয় কমিটি আলোচনার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেন। কাউকে জিজ্ঞেস না করে নিজেদের মতো সিদ্ধান্ত নিলে সংগঠন ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কোনো নির্দিষ্ট জায়গা থেকে আসা সিদ্ধান্ত দলের সিদ্ধান্ত হতে পারে না। দলের আর্থিক বিষয়ে অস্বচ্ছতার জন্য ক্ষোভ প্রকাশ করেন যুগ্ম আহ্বায়ক মনিরা শারমিন। তিনি দাবি করেন, এ বিষয়ে যেন জবাবদিহিতা থাকে। কোথা থেকে টাকা আসছে, কোথায় খরচ করা হচ্ছে তা কেন্দ্রীয় কমিটির কাছে স্পষ্ট থাকতে হবে। কোনো ব্যক্তির আর্থিক দায়ভার পুরো দল নিতে পারে না বলেও তিনি স্পষ্ট করেন। কেন্দ্রীয় কমিটির অনেকে মনে করেন, আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম প্রত্যাশা অনুযায়ী দল চালাতে পারছেন না। দুর্নীতি ও দলীয় নীতিবিরুদ্ধ কাজ করাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেননি। এ ছাড়া সংগঠনের বিস্তারেও নাহিদ ইসলাম ও সদস্য সচিব আখতার হোসেনের কার্যক্রমে খুশি নন বলে অনেকে সভায় উল্লেখ করেন। প্রায় দুই মাস অতিবাহিত হতে চললেও কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যদের দায়িত্ব নির্ধারিত হয়নি। বিশেষ করে আহ্বায়ক কমিটির সদস্যরা ক্ষোভ প্রকাশ করেন তাদের কোনো দায়িত্ব দেয়া হচ্ছে না বলে। তারা দাবি করেন, নতুন করে হতে যাওয়া ৩০ সদস্যের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটিতে যেন অন্তত ৫ জন আহ্বায়ক সদস্য থেকে নেয়া হয়।
এদিকে সভায় আগামী ঈদুল আজহার আগে তৃণমূলে সভা সমাবেশ ও জনসংযোগের মাধ্যমে সংগঠন গোছানোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়। একই সঙ্গে নির্বাচনের প্রস্তুতিও নেবে দলটি। সেক্ষেত্রে দলীয় নেতাকর্মীদের বাইরে এলাকায় গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে এমন ব্যক্তিদের নির্বাচনে প্রার্থী করার বিষয়ে ভাবছে দলটি।
ওদিকে গতকাল এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে দলটি জানিয়েছে, সাংগঠনিক গতিশীলতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় নীতিমালা প্রস্তাব করেন মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) সারজিস আলম এবং মুখ্য সংগঠক (দক্ষিণাঞ্চল) হাসনাত আব্দুল্লাহ। নীতিমালায় সাংগঠনিক কাজের স্বার্থে ৬৪টি জেলাকে ১৯টি জোনে ভাগ করা হয়। এ ছাড়াও, কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে জেলা কমিটি সর্বনিম্ন ৩১ সদস্য থেকে সর্বোচ্চ ৫১ সদস্য নিয়ে গঠিত হবে এবং উপজেলা কমিটি সর্বনিম্ন ২১ সদস্য থেকে সর্বোচ্চ ৪১ সদস্য নিয়ে গঠিত হবে। উভয় কমিটির আহ্বায়ক নির্ধারণে বয়স সর্বনিম্ন ৪০ বছর হতে হবে মর্মে সভায় সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সামপ্রতিক সময়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও জনপরিসরে এনসিপি’র কিছু নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে উত্থাপিত সাংগঠনিক শৃঙ্খলাবিরোধী কার্যক্রমের অভিযোগের প্রেক্ষিতে সভায় সর্বসম্মতিক্রমে একটি সাংগঠনিক ‘শৃঙ্খলা ও তদন্ত কমিটি’ গঠন করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। আজকের মধ্যে উক্ত কমিটি ঘোষিত হবে। সর্বশেষ, চলতি সপ্তাহে বিচার, সংস্কার ও গণপরিষদ নির্বাচনের দাবিতে জাতীয় নাগরিক পার্টি- এনসিপি, ঢাকা মহানগর বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করবে মর্মে সভায় সিদ্ধান্ত হয়।