প্রথম পাতা
জুলাই আন্দোলন নিয়ে প্রতারণা
আহত সেজে প্রধান উপদেষ্টার কাছ থেকে চেক নিয়েছিল হিরণ
সাজ্জাদ হোসেন
১৭ এপ্রিল ২০২৫, বৃহস্পতিবার
ব্যক্তিগত ঝামেলায় আহত হয়ে গত ৭ই আগস্ট জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান (নিটোর) এ চিকিৎসা
নিতে আসেন মো. ইলিয়াস হোসেন হিরন। জুলাই আন্দোলনে আহত ভেবে কয়েকজন আহত পরিবারের সদস্যরা হিরনের জন্য দুপুরের খাবার নিয়ে হাসপাতালে আসেন। খাওয়া-দাওয়ার একপর্যায়ে হিরন বলে ফেলে সে আসলে জুলাই আন্দোলনের আহত না। উত্তরা এলাকায় ব্যক্তিগত দন্দ্বের কারণে হিরনকে পিটিয়ে আহত করে প্রতিপক্ষ। কিন্তু ততক্ষণে হিরন জেনে যায়, যারা জুলাই আন্দোলনে আহত হয়েছেন কিংবা নিহত হয়েছেন তাদের সরকারিভাবে বিভিন্ন সহায়তা দেয়া হবে। এতে লোভে পড়ে যায় হিরন। জুলাই আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হয়েছে এমন ভুয়া মেডিকেল সার্টিফিকেট তৈরি করে সে। জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের সহায়তার জন্য সরকারি তালিকায় এমআইএস-এ নাম অন্তর্ভুক্তি করে ফাউন্ডেশন থেকে সহায়তাও তুলে নেয়। এমনকি গত ১০ই ফেব্রুয়ারি জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের শহীদ পরিবার ও আহত ব্যক্তির মধ্যে রাষ্ট্রীয়ভাবে আর্থিক সহায়তার চেক হস্তান্তর করেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। সেখান থেকেও হিরন আহত সেজে প্রধান উপদেষ্টার হাত থেকে সহায়তার চেক গ্রহণ করেন। বিষয়টি টের পেয়ে জুলাই আন্দোলনে কয়েকজন প্রকৃত আহত হিরনকে ধরে জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনে নিয়ে আসেন। কিন্তু কৌশলে হিরন তার স্ত্রীকে নিয়ে পালিয়ে যায় ফাউন্ডেশনের অফিস থেকে। কিন্তু ফাঁসিয়ে দিয়ে যায় হিরনকে বাঁচাতে আসা আরেক ভুয়া আহত লিটনকে। গতকাল জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে ফাউন্ডেশনটির প্রধান গ্রাহকসেবা কর্মকর্তা মাহফুজুর রহমানের করা রমনা থানার মামলায় লিটন জেলে গেলেও হিরন পলাতক রয়েছেন।
সূত্রগুলো বলছে, জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের সহায়তার টাকা নিতে কিছু প্রতারক প্রথম থেকেই সক্রিয় ছিল। এসব প্রতারকের নিয়ে সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন হিরনরা। ফাউন্ডেশনে এসে কর্মকর্তাদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করা, তাদের হুমকি দেয়া, ফাউন্ডেশনে ‘মব’ সৃষ্টির মাধ্যমে ভাংচুরের হুমকি দেয় সহ নানা অভিযোগ রয়েছে হিরনদের বিরুদ্ধে। এতদিন জুলাই আন্দোলনের আহত ভেবে সবাই বিষয়গুলো নিয়ে তেমন প্রতিক্রিয়া না দেখালেও প্রতারণার বিষয়টি ধরা পড়ায় ক্ষোভ বিরাজ করছে ফাউন্ডেশনের কর্মকর্তাদের মাঝে। হিরনসহ প্রতারণার পুরো সিন্ডিকেটটি ধরতে কাজ করে যাচ্ছে জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন।
জুলাই আন্দোলনে আহত আরমান মানবজমিনকে বলেন, ভুয়া আহত সন্দেহে প্রথমে হিরনকে ফাউন্ডেশনে নিয়ে আসা হয়। তাকে জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে হিরনের স্ত্রী ফোন দেয় জুলাই আন্দোলনে আরেক আহত মো. লিটনকে। লিটন ফাউন্ডেশনে এসে হিরনকে ছাড়িয়ে নিতে সেখানকার কর্মকর্তাদের হুমকি দেয়াসহ বিভিন্ন ঔদ্ধত্যপূর্ণ ব্যবহার করতে থাকে। শুরু হয় হিরন ও লিটনকে জিজ্ঞাসাবাদ। একপর্যায়ে হিরন স্বীকার করে সে ৭ই আগস্ট উত্তরায় ব্যক্তিগত রেষারেষি থেকে মারামারি হলে সামান্য আহত হয়। পরে ওইদিনই জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান (নিটোর) এ চিকিৎসা নিতে আসে। কিন্তু ওই সময়ে জুলাই আন্দোলনে যারা আহত-নিহত হয়েছেন তারা এসে ভিড় করছেন নিটোর হাসপাতালে। হিরনের আহত হওয়া এবং জুলাই আন্দোলনের আহতদের সময় কাছাকাছি হওয়ায় সেও জুলাই আন্দোলনের আহত সাজার সিদ্ধান্ত নেয়। হিরন উত্তরার আরএমসি হাসপাতালের প্যাডে একটা ভুয়া প্রেসক্রিপশন তৈরি করে। এই ভুয়া প্রেসক্রিপশন দেখিয়ে সরকারি তালিকায় এমআইএস-এ নাম অন্তর্ভুক্তি করে। সেখানে হিরন গুলিবিদ্ধ হয়েছে এমন মেডিকেল সার্টিফিকেট তৈরি করে। কিন্তু তার সার্টিফিকেটে কোনো চিকিৎসকের সিল কিংবা স্বাক্ষর না থাকায় সন্দেহ হয় ফাউন্ডেশনের কর্মকর্তাদের। জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে সে তার ভুল স্বীকার করে মুচলেকা দেয় ফাউন্ডেশনের কাছে। কিন্তু হিরনকে পুলিশে দেয়ার বিষয়টি টের পেয়ে তাকে ছাড়িয়ে নিতে হিরনের স্ত্রী নূপুরের ফোনে জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনে আসে লিটন। জিজ্ঞাসাবাদে যখন লিটনের প্রতারণার বিষয়টিও সামনে আসে তখন কৌশলে লিটনকে রেখে হিরন তার স্ত্রীকে নিয়ে পালিয়ে যায়।
মো. লিটনের মেডিকেল ডকুমেন্টে দেখা যায়, গত ১৪ই অক্টোবর সরকারি শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বহির্বিভাগে চিকিৎসা নেয়। কিন্তু সেই ডকুমেন্টের তারিখ ঘষামাজা করে ১৪ই অক্টোবরকে ১৪ই জুলাই বানায় লিটন। জুলাই আন্দোলনে ১৪ই এবং ১৫ই জুলাই শাহবাগে আন্দোলন করতে গিয়ে ছাত্রলীগের পিটুনিতে আহত হয়েছে এমন তথ্য দেয় লিটন। কিন্তু ওই ২ দিন শাহবাগে ছাত্রলীগের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের কোনো সংঘর্ঘ হয়নি। পরে বলে বিজয় একাত্তর হলের সামনে আহত হয়। কিন্তু এটাও মিথ্যা প্রমাণিত হয়। এছাড়াও মেডিকেল ডকুমেন্টে তারিখ পরিবর্তনের বিষয়টি ধরা পড়ার পরে স্বীকার করে সে আসলে জুলাই আন্দোলনের আহত নয়। যে কোনোভাবে মাথায় আঘাত পেলে সোহ্রাওয়ার্দী হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়। সেই চিকিৎসার ডকুমেন্ট দিয়ে সরকারি তালিকায় এমআইএস-এ নাম অন্তর্ভুক্তি করা সহ ফাউন্ডেশন থেকে তুলে নেয় আর্থিক সহায়তা।
এসব অভিযোগের ব্যাপারে জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের গ্রাহকসেবা কর্মকর্তা মাহফুজুর রহমান বাদী হয়ে হিরন এবং লিটনকে আসামি করে রমনা থানায় মামলা করেন। মানবজমিনকে মাহফুজুর রহমান বলেন, লিটন সোহ্রাওয়ার্দী কলেজের ছাত্র। কিন্তু কলেজের লিস্টে লিটন গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হওয়ার তথ্য দেয়া। কিন্তু গুলিবিদ্ধ হওয়ার কোনো শারীরিক ক্ষত কিংবা মেডিকেল ডকুমেন্ট লিটন দেখাতে পারে নাই। আবার জিজ্ঞাসাবাদে সে প্রতারণার বিষয়টি স্বীকারও করেছে।
জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের প্রধান ভেরিফিকেশন কর্মকর্তা মো. হারুন-অর রশিদ মানবজমিনকে বলেন, হিরন প্রতারণার মাধ্যমে মিথ্যা তথ্য দিয়ে জুলাই জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের সহায়তা নিয়েছে। আবার গত ১০ই ফেব্রুয়ারি জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের শহীদ পরিবার ও আহত ব্যক্তির মধ্যে রাষ্ট্রীয়ভাবে আর্থিক সহায়তার চেক হস্তান্তর করেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। সেখানেও হিরন প্রধান উপদেষ্টার কাছ থেকে সহায়তার চেক গ্রহণ করে। আমরা প্রতারক হিরনকে আইনের আওতায় আনার পাশাপাশি হিরনের মতো ভুয়া আহতদের পুরো চক্রটাকে খুঁজছি। সবাইকে আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে।
পাঠকের মতামত
Capital Punishment for this Culprit
Make him return the amount and also impose 100time tht amount as fine