বাংলারজমিন
দারিদ্র্যতা ও নিরাপত্তাহীনতায় শহীদ সোহাগের পরিবার
তোফাজ্জল ইসলাম, জামালগঞ্জ (সুনামগঞ্জ) থেকে
১৭ এপ্রিল ২০২৫, বৃহস্পতিবার‘দেশ টা তো স্বাধীন হইলো কিন্তু আমরার ভাগ্যের কি কোনো পরিবর্তন অইলো না, আমরার খোঁজ কেউ নেয় না, অখন আরো ডর বাড়ছে’। চোখ মুছতে মুছতে এমনই আক্ষেপ প্রকাশ করলেন জুলাই অভ্যুত্থানে নিহত শহীদ সোহাগের মা। জামালগঞ্জ উপজেলার ভীমখালী ইউনিয়নের গুলামিপুর গ্রামের সোহাগ মিয়া (২৩) অসহায় দিন-মজুর আবুল কালামের ছেলে। ঢাকার বাড্ডা এলাকায় বসবাস করতেন ভাই শুভ মিয়া ও বিল্লাল মিয়াকে নিয়ে। তারা ছিলেন গার্মেন্ট শ্রমিক। ৫ই আগস্ট স্বৈরাচার পতনের খবর পেয়ে ঢাকার রাজপথের মিছিলে যোগ দিয়েছিলেন দুই ভাই। মিছিলটি বাড্ডা থানার সামনে এলেই পুলিশ গুলি ছুড়ে। গুলিবিদ্ধ হন দুই সহোদর সোহাগ মিয়া ও শুভ মিয়া। গুরুতর গুলিবিদ্ধ সোহাগ মিয়াকে বাঁচানো না গেলেও আহত হয়ে বেঁচে যান শুভ মিয়া। স্বাধীন দেশের স্বাদ না নিয়েই ৫ই আগস্ট শহীদ হন সোহাগ মিয়া। ৬ই আগস্ট তাঁর গ্রামের বাড়ির সামনে পঞ্চায়েতি কবর স্থানে শহিদ সোহাগের দাফন করা হয়।
বড় ভাই শহীদ হলেও কষ্টে যন্ত্রণায় দিন কাটছে আহত শুভ মিয়ার। তাঁর বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জামালগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মাঈন উদ্দিন আলমগীর জানতে চাইলে তিনি বলেন, শুভ মিয়া দাবি করেছেন, তার পায়ের হাঁটুতে ১টি ও হাঁটুর নিচে ১টি রাবার বুলেট রয়ে গেছে। গুলি বের করতে বিশেষজ্ঞ মেডিকেল বোর্ড গঠন করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। বিষয়টি আমি সিভিল সার্জনকে অবগত করেছি। শুভ মিয়ার হাঁটা-চলায় কোন সমস্যা হচ্ছে না, তাকে ভিটামিনসহ কিছু ওষুধ দিয়েছি। পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের যে কোন চিকিৎসা সেবার প্রয়োজন হলে আমরা তাদের পাশে থাকব।’ শহীদ সোহাগের ৮ সদস্যের পরিবারটির বসবাস এক শতক জায়গার ওপর একটি ছোট্ট ঘরে। বাঁশের নড়েবড়ে, খুঁটির দুই চালার ঝংধরা টিনের ঘরটির চাল দিয়ে বৃষ্টির পানি পড়ে। হাওর পাড়ে অবস্থান ছিল বলে, ছেলেদের মৌসুমী শ্রমে সংসার চলতো তার। সোহাগই পরিবারের চালিকা শক্তি। সৌদি আরবে যাবেন বলে পরিবারের শেষ সম্বল কয়েকটি গরু বিক্রি করে দালালকে দিয়ে পরে ঐ টাকা আর ফেরত পাননি।
সোহাগ শহীদ হওয়ার পর এলাকাবাসীর ও রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে কিছু সাহায্য পেয়েছিলেন পরিবারের সদস্যরা। সরকারের পক্ষ থাকি ডিসি (জেলা প্রশাসক) ড. মোহাম্মদ ইলিয়াস মিয়া সোহাগের কবর জিয়ারত করে ১ লাখ টাকা দিয়েছিলেন। একটি ঘর তৈরি করে দেয়ার ঘোষণাও দিয়েছেন। এরপর থেকে ঘর তৈরি দেখা মিলেনি, মিলেনি আর কোন বড় সাহায্যের দেখা। এখন ৭ জনের পরিবারের উপার্জনক্ষম ১ ছেলের মৃত্যু ও অন্য ছেলের গুলিবিদ্ধ হওয়াতে তাদের দারিদ্রতা চরম পর্যায়ে বৃদ্ধি পেয়েছে। ঈদে পার্বনেও এখন সরকারি কোন সাহায্য পাচ্ছে পরিবার এমনকি চিকিৎসার অগ্রগতি নেই আহত শুভ মিয়ার।
ভাই বিল্লাল জানিয়েছেন, শুভর সুষ্ঠু চিকিৎসার প্রয়োজনে বা উন্নত চিকিৎসার জন্য যদি তাকে যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করতে হয়, তাও করবেন বলে কথা দিয়েছিলেন জেলা প্রশাসক ড. মোহাম্মদ ইলিয়াস মিয়া। এখনো চিকিৎসার ব্যবস্থা হয়নি।
অন্যদিকে, সোহাগের মৃত্যুর ঘটনাকে কেন্দ্র করে পতিত শেখ হাসিনাকে প্রধান আসামি করে ১৭৯ জনের নামে বাড্ডা থানায় নিহতের আরেক ভাই বিল্লাল মিয়া বাদী হয়ে মামলা দায়ের করেন। তবে অনেকেই বলছেন বিল্লাল মিয়াকে দিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা লুটার জন্য শহীদ সোহাগের ভাই বিল্লাল মিয়াকে দিয়ে মামলা করিয়েছে। মামলার পর বাড্ডা এলাকার নির্দোষ অনেকেই বিল্লালকে খুঁজতে থাকেন, মামলা দায়েরের পর থেকে মামলা তুলে নিতে মুঠোফোনে একাধিকবার প্রাণনাশের হুমকি দেয়া হয় তাকে। প্রাণভয়ে গ্রামের বাড়িতে চলে এলেও নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছেন বিল্লাল ও তার পরিবার। মামলার অনেক আসামিই বিল্লাল মিয়ার গ্রামের বাড়িতে চলে আসছেন মামলা থেকে নাম তুলে নেয়ার জন্য। শহীদ সোহাগের পরিবারে একদিকে দরিদ্রতা অন্যদিকে নিরাপত্তাহীনতায়। দুই প্রেক্ষাপটের জন্যই সরকারের সুদৃষ্টি কামনা করেছেন জামালগঞ্জের শহীদ সোহাগের পরিবার।