বাংলারজমিন
মানিকগঞ্জে ফের সক্রিয় মাটিখেকো বাশার
রিপন আনসারী, মানিকগঞ্জ থেকে
৭ এপ্রিল ২০২৫, সোমবার
আওয়ামী লীগ সরকারের সময় মানিকগঞ্জ জেলা জুড়ে সবচেয়ে বেশি আলোচিত ছিল ফসলি জমি কাটা ও নদী থেকে অবৈধ বালু উত্তোলন। তারই ধারাবাহিকতায় অন্তর্বর্তী সরকারের সময়েও চলছে একই কাণ্ড। তখন মানিকগঞ্জ জেলায় অবৈধ মাটি ব্যবসায়ীদের ডন হিসেবে পরিচিত ছিল জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক আবুল বাশার।
৫ই আগস্টের পর আবুল বাশার আত্মগোপনে যায়। কিন্তু পর্দার আড়ালে থেকে অবৈধ মাটি ব্যবসার কলকাঠি নাড়াচ্ছে এমন তথ্য বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া যাচ্ছে। তার নামে এখনো রয়েছে সরকারি দু’টি বালু মহলের ইজারাও। তা ছাড়া তার ছত্রছায়া থেকে বিগত সরকারের শাসনামলে মাটি ব্যবসায়ীরা অনেকেই এখনো সক্রিয়। বিশেষ করে ঘিওর, দৌলতপুর ও শিবালয় উপজেলা অর্থাৎ পশ্চিম মানিকগঞ্জে অবৈধ মাটি ব্যবসার মূল হোতাই ছিলেন বাশার।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, গত সাড়ে ১৬ বছরে সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক, মানিকগঞ্জ-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য নাঈমুর রহমান দুর্জয়, মানিকগঞ্জ-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মমতাজ বেগম এবং সর্বশেষ মানিকগঞ্জ-১ আসনের আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র এমপি কেন্দ্রীয় যুবলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম জাহিদের আস্থাভাজন ছিলেন আবুল বাশার। সর্বশেষ ২০২৪ সালের নির্বাচনে মাটি ব্যবসাকে টিকিয়ে রাখতে জাহিদের পক্ষে বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচ করেছেন। সেটা ছিল ওপেন সিক্রেট। ফলশ্রুতিতে মানিকগঞ্জ জেলায় ৭টি বালুমহলের মধ্যে তার একক নামেই ২টি বালুমহলের ইজারা বাগিয়ে নেন। শুধু তাই নয় কালিগংগা ধলেশ্বরী যমুনা নদীসহ বিভিন্ন নদ-নদীতে অবৈধভাবে ড্রেজার বসিয়ে বালু উত্তোলন করেছে ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে।
সরকারি বড় বড় দপ্তরের কর্তা ব্যক্তিদের সঙ্গেও তার ঘনিষ্ঠতা ছিল। কাজকর্ম বাগিয়ে নিতে যেখানে যেটা প্রয়োজন সবই করতেন বাশার। ইট তৈরির অত্যাধুনিক প্রতিষ্ঠান স্টোন ব্রিকসের মাটির ওয়ার্ক পারমিট এবং সেখানেও তার খবরদারি ছিল সবচেয়ে বেশি। এ কারণে তিন ফসলি জমি থেকে অবৈধভাবে মাটি কেটে অবাধে বিভিন্ন ইট ভাটা ও সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে মাটি ভরাট করে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। পশ্চিম মানিকগঞ্জ তার সিন্ডিকেটের মাধ্যমেই চলতো নদী থেকে অবৈধ বালু উত্তোলন ও ফসলি জমি কাটার মহোৎসব। এসব টাকার ভাগ যেত সাবেক মন্ত্রী-এমপি, প্রভাবশালী নেতৃবৃন্দ, উপজেলা ইউএনও অফিস, এসিল্যান্ড অফিস, ভূমি অফিস থেকে শুরু করে জেলা প্রশাসনসহ বিভিন্ন দপ্তরের এক শ্রেণির কর্তা ব্যক্তিদের পকেটে। ঘিওর উপজেলার সিংজুরী ইউনিয়নের বাসিন্দা হলেও জেলা শহরে আলিশান ফ্ল্যাটসহ বিভিন্ন জায়গায় তার বাড়ি, গাড়ি, জমিজমা এবং ব্যবসা রয়েছে। তার অর্থবিত্ত ও অঢেল টাকার কাছে আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী এমপি মন্ত্রী ও নেতারাও ধরাশায়ী ছিলেন। লেখাপড়া বলতে হাইস্কুলের গণ্ডি পাড়ি দিতে না পারলেও উচ্চশিক্ষিত লোকের পাশের চেয়ারে বসতেন তিনি। স্বেচ্ছাসেবক লীগের মতো একটি সংগঠনের জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদকের পদও বাগিয়ে নিয়েছেন মোটা অঙ্কের অর্থ খরচ করে। এর আগে জেলা যুবলীগের একটি পদও একই কায়দায় বাগিয়ে নেন। শুধু তাই নয়, বাশার মানিকগঞ্জ জেলা পরিষদের মতো জায়গায় টানা দুইবারের সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন ভোট কেনার মাধ্যমে। আওয়ামী লীগের পতনের পর তার বিরুদ্ধে মানিকগঞ্জ জেলা বিএনপি কার্যালয় অগ্নিসংযোগসহ আরও কয়েকটি ঘটনায় একাধিক মামলা হয়েছে।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, আরিচার যমুনা নদী ও পাটুরিয়ার, হরিরামপুরের পদ্মা নদী থেকে অবাধে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। তা ছাড়া ঘিওর, দৌলতপুর ও শিবালয় উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় অবৈধ ড্রেজার বসিয়ে বালু উত্তোলন ও ফসলি জমি কাটার পেছনে পর্দার আড়াল থেকে বাশারের সম্পৃক্ততা রয়েছে। আগে বাশারের হয়ে যারা ফসলি জমি কেটেছে তাদের অনেকেই বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে মাটি কাটার উৎসবে মেতে উঠেছে। স্থানীয় অনেকেই বলছেন, মাটি কাটার যন্ত্রসহ অর্থনৈতিক জোগান পর্দার আড়াল থেকে বাশারই দিয়ে যাচ্ছেন। শুধু তাই নয়, এক শ্রেণির কৃষকও অধিক লাভের আশায় মাটি ব্যবসায়ীদের কাছে জমি বিক্রি করে দিচ্ছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক মাটি ব্যবসায়ী জানান, প্রশাসন ও এক শ্রেণির অর্থলোভী রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে ম্যানেজ করেই তারা মাটি কাটছেন। তাদের ভাষ্য, আওয়ামী লীগ সরকারের জমানার সাড়ে ১৬ বছরেও তো মাটিকাটা হয়েছে, এখন করলে সমস্যা কি? জেলা কৃষকদলের সভাপতি গোলাম কিবরিয়া সাঈদ মানবজমিনকে বলেন, যেকোনো মূল্যে ফসলি জমি আমরা নষ্ট হতে দেবো না। দুষ্কৃতকারীদের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তুলতে ইতিমধ্যে আমি আমার ফেসবুক আইডিতে ফসলি জমি কাটার বিরুদ্ধে স্ট্যাটাস দিয়েছি। জেলা শহরসহ প্রত্যেকটি উপজেলায় আমরা ফসলি জমি কাটার প্রতিবাদে মানববন্ধন কর্মসূচি হাতে নেবো। দলীয় কিছু নেতৃবৃন্দের সম্পৃক্ততা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, দল-মত বুঝি না। এই দুষ্কর্মের হোতারা দেশের শত্রু, কৃষকের শত্রু। যে কোনো মূল্যে আমরা এদের প্রতিহত করবো।